Tuesday, May 13, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

আমাদের ছবি

Img 20220518 Wa0042

‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’ নিয়ে যথার্থই আবেগাপ্লুত পিয়ালী চৌধুরী–এ ছবির হয়ে ওঠা যাঁকে ছাড়া অসম্ভব ছিল। যিনি বরাবর পাশে থেকে স্বামী, ছবির পরিচালক কুমার চৌধুরীকে ছবিটি শেষ করায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন…’ ছবির বীজ বপন থেকে সূর্যের আলোর মুখ দেখার কাহিনি পড়ুন তাঁরই কলমে।

সাল ২০১২। সংবাদ মাধ্যম উত্তাল। খবরের কাগজের পাতা উল্টোলে, একটাই শিরোনাম–অশান্ত মায়ানমার। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের গৃহযুদ্ধে রণক্ষেত্র মায়ানমার। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিজেদের দেশ, ভিটেমাটি ছাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। আমাদের ছবির ভাবনার বুননটা শুরু হয়তো সেখান থেকেই। তবে, সেটা শুধুই সলতে পাকানো। এরও বেশ কয়েক বছর পরের কথা। ২০১৫-য় এই বিষয় সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে খবর সংগ্রহ শুরু হলো। কুমারকে দেখতাম কাগজে রোহিঙ্গাদের উপর সব আর্টিকেল কেটে কেটে ফাইলবন্দি করছে। সেখান থেকেই কলকাতার হোমে আটকে পড়া এক রোহিঙ্গা মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায় এক ম্যাগাজিনে।

এরপর ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে কুমার। তিনি সব শুনে, ওকে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার ফোন নাম্বার দেন, যাঁরা এখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। কিন্তু তাঁদের কাছে কোনও তথ্যই মেলে না। দিতে ভয় পান তাঁরা। তবু, কিছু কথাবার্তা জানা যায়। পরে তাঁরা সবাই আবার নিজেদের নম্বর চেঞ্জ করে ফেলেন। যাই হোক, শেষে সেই ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ এবং একজন লেখক সেই হোমের মেয়েটির সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। কুমার মেয়েটির সাথে কথা বলে। সেই লেখকের সঙ্গেই রোহিঙ্গাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচার আচরণ ইত্যাদি নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হয়।

Img 20220125 Wa0129
আমাদের ছবি 8

এই ছিল ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন… ‘ ছবির চিত্রনাট্য লেখার পটভূমি। ধীরে ধীরে চিত্রনাট্য লেখা শুরু। ফার্স্ট ড্রাফট লেখা শেষ হয় ২০১৬-র মার্চে। তারপর দু’বছর ধরে স্ক্রিপ্টটাকে ঘষামাজা করে, ফাইনালি ২০১৮-র একদম শুরুর দিকে কুমার ওটাকে কমপ্লিট করে। এবার ছবির প্রযোজক খোঁজার পালা। না, এই ব্যাপারে আমরা কারোর সহায়তা পাইনি। কতজনের কাছে appointment নিয়েছি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছি। শেষে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছি। কেউ বলেছেন, আপনি আপনার প্রথম ছবিটা করে আসুন, দ্বিতীয় ছবি আমরা করবো। অনেকের আবার অন্য রকম দাবি দাওয়া। আবার কেউ কেউ মুখের ওপর বলে দিয়েছেন ‘না’।

২০১৮-র ডিসেম্বর। বড়দিনের ছুটি সবে পড়েছে। কী মনে হলো, হঠাৎই একদিন বলে উঠলাম, চলো ছবিটা আমরা নিজেরাই প্রযোজনা করি। কত টাকা লাগবে বলো ? কুমার শুনে বলল, পাগল হলে নাকি ? সে তো অনেক টাকার ব্যাপার ! বললাম, হোক অনেক টাকা। লোন নেবো। আমার সব গয়না বিক্রি করে দেবো। তাতে যা টাকা আসে, তাই দিয়েই শুরু তো করো। তখন একটা অদ্ভুত জেদ চেপে গেছে–ছবিটা আমরা বানাবোই। কিন্তু, আমরা যা টাকা তুলতে পেরেছি, তাতে তো পুরো ছবিটা হবে না। এখন উপায় ? দেবদূতের মতো এগিয়ে এলেন কুমারের ছোটবেলার বন্ধু বিশ্বজিত ঘোষ। উনি না থাকলে এ ছবি শেষ করা সম্ভব হতো না। এরপর আমার ছোটবেলার বেশ কয়েকজন বন্ধু, আমার পরিবারের কিছু মানুষ, কুমারের পরিবারের কিছু মানুষ–সবাই একে একে ছবিটার পাশে এসে দাঁড়ান। ওঁদের সবার সহযোগিতায় শেষ হয় আমাদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন… ‘।

Chinar Pata Poster
আমাদের ছবি 9

এক্ষেত্রে, দু-একটা ঘটনা না বললেই নয়। কুমার তখন শ্যুট করার জন্য পাগলের মতো একটা বাড়ি খুঁজছে–চন্দননগর, শ্রীরামপুর, রানাঘাট অঞ্চলে। হঠাৎই খোঁজ পাওয়া গেল, শ্যামবাজারের সেনবাড়ির। কিন্ত ওঁদের বাড়িতে শুটিং করা যাবে কিনা, তা জানা যাবে ওঁদের বাড়ির অন্নপূর্ণা পুজোর দিন। আমাদের সবাইকে ওঁরা নিমন্ত্রণ করেছিলেন ওই বাড়ি থেকে। দুরুদুরু বুকে গেলাম। ওঁরা সম্মতি দিলেন। এক মুহূর্তে মনে হয়েছিল সবটুকু মা অন্নপূর্ণার জন্যই সম্ভব হলো।

আর একবার–আমাদের কাশ্মীরে শ্যুট করতে যেতে হবে। কলকাতা থেকে শ্রীনগরের ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। হোটেল বুক করা হয়ে গেছে। হঠাৎই সরকার ৩৭০ ধারা জারি করলো।  মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শ্রীনগরে তো কোনও ফ্লাইট নামতেই দিচ্ছে না। কি হবে এবার ! কথায় আছে, রাখে হরি মারে কে? আমাদের কে আটকাবে? আমরা গাড়িতে অমৃতসর হয়ে জম্মু ঢুকলাম। হাজারটা বন্দুকের নলের সার্চিং পেরিয়ে পাটনিটপ পৌঁছোলাম। তারপর শ্রীনগর। শুটিং করলাম খুব সাবধানে। যেন বেড়াতেই এসেছি এভাবেই কাটালাম দিনগুলো। আদৌ পুরো শ্যুট করতে পারবো কিনা, তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুম উড়ে গেছিলো। তবু সবটা ভালো ভাবে শেষ করে ফিরতে পেরেছিলাম।

ছবি শুরুর আগে ছবিতে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে প্রচুর পড়াশুনা করতে হয়। কুমারকে রীতিমত রোহিঙ্গা ভাষা রপ্ত করতে হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন আমাদের রোহিঙ্গা ভাষা শেখাতে। আর্টিস্ট সিলেকশনের পর, তাঁদের নিয়ে শুরু হয় ওয়ার্কশপ। সবাইকে ওই ভাষাটা শেখানো হয়। ছবিতে একাধিকবার ভায়োলিন বাজানোর দৃশ্য  আছে। নায়িকা এবং তাঁর বন্ধুদের নিয়ে মিউজিক ক্লাস করানো হয় বেশ কিছুদিন। ভায়োলিন ও অন্যান্য ইন্স্ট্রুমেন্ট বাজানো শেখান আমাদের ছবির মিউজিক ডিরেক্টর।

ছবির শুটিং তো ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। এবার পোস্ট প্রোডাকশনের পালা। ২০২০-র মার্চ থেকে বিশ্বে করোনার প্রভাবে জীবন অতিষ্ঠ। চারদিকে লকডাউন। আমি এত বছর যে চাকরিটা করছিলাম, সেখানকার কর্তৃপক্ষ হঠাৎই পুরো সংস্থা শাটডাউন করে দেয়। এদিকে প্রতিমাসে লোন কাটছে। কোথাও কোনও রোজগার নেই। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। তবু হাল ছাড়িনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেছি। প্রতিজ্ঞা, ছবিটা শেষ করবোই। এদিকে স্টুডিওতে টাকা বাকি পড়েছে। এমন সময় আবার বিপর্যয়। আমফান ঝড়ে সব ওলটপালট। আমাদের আদি বাড়ী গোবরডাঙায় কুমারের হাতে লাগানো মেহগনি গাছ পুরো শিকড় থেকে উপড়ে গেছে ঝড়ের দাপটে। ওখানকার এক কাঠমিস্ত্রী এসে ভাঙা গাছটিকে নিয়ে যান। বিনিময়ে উনি যা দিয়েছিলেন,  তা আমরা স্টুডিওতে দিয়ে দিই। এইভাবে একটু একটু করে ছবিটাকে আমরা শেষ করি ২০২০-র আগস্ট নাগাদ।

Img 20220126 Wa0077
আমাদের ছবি 12

এরপর ছবিটাকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠাতে শুরু করি। গোয়া ফিল্মবাজারে ছবিটা ছিল। সেখান থেকেও অনেক ফেস্টিভালে ডাক পাই। কলকাতা, লন্ডন, বার্লিন, সানফ্রানসিস্কো, মন্ট্রিল, ওয়াশিংটন ডিসি, নিউ জার্সি, বস্টন, নেপাল, ভূটান,  বাংলাদেশ, রাজস্থান, দিল্লীর বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে সিলেকশন ও অ্যাওয়ার্ড পায় ছবিটি। একটাই দুঃখ IFFI GOA-তে ছবিটা পাঠাতে পারিনি। অবশ্যই টাকা ছিলো না বলে। ওদের এন্ট্রি ফি অনেক বেশি। ছবিটা দেশ-বিদেশে ভূয়ষী প্রশংসা পেয়েছে। কলকাতা  ফেস্টিভ্যালের সময় ছবির দু’টো শো-এ প্রচুর মানুষ ছবিটা দেখেছেন। মিডিয়াতেও ছবিটা সম্পর্কে অনেক লেখালিখি হয়। এগুলোই বোধহয় আমাদের পাওনা।

প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, সেন্সর করার টাকা ছিল না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। সেসময় এগিয়ে এলো আমাদের এক ভাই। টাকা দিল। সেই টাকায় আপাতত ছবির সেন্সর হয়ে গেছে। এবার খুব শিগগির আমরা ছবিটাকে প্রেক্ষাগৃহে আনতে চলেছি। আমাদের স্বপ্নের সাথে আপনাদের দেখা করাতে। আশা করি, সবাই ‘প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন… ‘ সিনেমা হলে এসে দেখবেন । একটা সম্পূর্ণ নতুন বিষয় নিয়ে একটা সম্পূর্ণ নতুন ছবি।