ইতিহাস, প্রকৃতি ও আধুনিক প্রযুক্তির অপরূপ মেলবন্ধন কর্ণাটকে
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। সম্প্রতি কলকাতায় অনুষ্ঠিত ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম ফেয়ার (TTF)-এ, কর্ণাটক ট্যুরিজমের পক্ষ থেকে জানানো হলো তাদের বেশ কিছু আকর্ষণীয় অফারের কথা। লিখেছেন লিপি চক্রবর্তী।
একসময় রাজ্যটির নাম ছিল মহীশূর। ১৯৭৩ সালে নাম বদলে হল কর্ণাটক। বহু বছর আগে, সেই মৌর্যদের সময়ে এই স্থানটি করুনাডু নামে পরিচিত ছিল–যার অর্থ উচ্চভূমি। আসলে মালভূমি। মূলত মৌর্যরাই এই অঞ্চলের আবিষ্কর্তা। তাদের পরে সাতবাহনরা এখানে প্রায় তিনশো বছর রাজত্ব করে। তারও পরে, বিভিন্ন সময়ে কদম্ব ও পল্লব, গঙ্গাদিকার, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, কালচারী, হয়সল, যাদব, কাকতীয়, ওয়াদেয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন রাজবংশ রাজত্ব করে কর্ণাটকে। ফলে বিভিন্ন রকম শিল্প, স্থাপত্য, সংস্কৃতির বেশ আকর্ষণীয় এক মেলবন্ধন ঘটেছে এই অঞ্চলে। প্রসঙ্গত, সব থেকে বেশি প্রভাব পড়ে হয়সলদের–তাদের আমলের শিল্প ও স্থাপত্য খুব বেশি দেখা যায় এখানে। কর্ণাটকের সব থেকে শক্তিশালী শাসক ‘মহীশূর বাঘ’ নামে পরিচিত টিপু সুলতানের মৃত্যু হয় ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে। তখন থেকে শাসনভার কার্যত ইংরেজদের হাতে চলে যায়, যা বজায় থাকে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত।
এ তো গেল ইতিহাস। এই ইতিহাসের হাত ধরেই এসেছে পুরাকালের মন্দির, রাজপ্রাসাদ, শতাব্দী প্রাচীন সৌধ, পাথরের তৈরি গুহামন্দিরের স্থাপত্য ইত্যাদির অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের হাতছানি। এ রাজ্যেই আছে অনিন্দ্যসুন্দর সমুদ্র তট, পাহাড়, জঙ্গল, জাতীয় অভয়ারণ্য। ৭৪৭টি ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাচীন মন্দির অত্যন্তু যত্ন সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করছে এখানকার রাজ্য সরকার।কর্ণাটকের বিজয়নগরের ‘হাম্পি’ চতুর্দশ শতকে বানানো অসাধারণ পাথরখোদাই মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। UNESCO এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলির জন্য হাম্পি ও পট্টাডাকালকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দিয়েছে। কর্ণাটকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে নির্মিত বাদামী পাথর খোদাই করা গুহা মন্দিরের কারুকাজ বিস্মিত করবে পর্যটকদের। এছাড়া, মহীশূর প্যালেস, বেলুড় ও হ্যালেবিদুর হয়সালা মন্দিরকেও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে পাহাড়-সমুদ্র-ঝর্নার মেলবন্ধন ঘটেছে কর্ণাটক রাজ্যে। রয়েছে ৩৫টি বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কেন্দ্র, পাঁচটি জাতীয় উদ্যান, ৩২০ কিলোমিটার বিস্তৃত পর্যটক আকর্ষণকারী সমুদ্র সৈকত। দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকতগুলিতে রয়েছে বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টস-এর ব্যবস্থা। প্রাচীন ও আধুনিকের মেলবন্ধন ঘটেছে গোকর্ণ সমুদ্র সৈকতে। নির্জন সৈকত প্রাণের আরাম জোগায় ব্যস্ত নাগরিকের। এরই পাশাপাশি প্রাচীন শিব মন্দিরটিও স্বমহিমায় অবস্থান করে এখানে। পাহাড়ী শহর চিকমাগলুরু, মন্দিরময় শহর উডুপি, বাঘের জন্য বিখ্যাত অভয়ারণ্য বান্দিপুর ও নাগারহোল, শিমোগা ও জগ জলপ্রপাত, খ্রিস্টীয় দশ শতকে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক স্থাপত্য সমৃদ্ধ শহর বিজাপুর, বন্দর শহর ম্যাঙ্গালোর–এই সব কিছুই কর্ণাটকের আকর্ষণের কেন্দ্রে রয়েছে। এই রাজ্যেই আছে জৈনদের বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র শ্রবণবেলগোলা।
কিন্তু যে জায়গার কথা না বললে কর্ণাটকের কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সেটি হল বেঙ্গালুরু। ভারতের এই ‘সিলিকন উপত্যকা’ এখন শিল্প-প্রযুক্তিতে ভারতে এক নম্বর তো বটেই, বিশ্বের নিরিখে চার নম্বরে এর স্থান। তার সঙ্গে রয়েছে বেঙ্গালুরু প্যালেস সহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। কর্ণাটক রাজ্যটিকে সম্পূর্ণভাবে দেখতে হলে–জিভে জল আনা নীর দোসা, মশালা দোসা, বিসি বেলি বাথ, ইডলি, রাগি মাডডে ইত্যাদি খাবারের স্বাদও গ্রহণ করতে হবে। আর এরজন্য হাতে বেশ কিছুটা সময় অবশ্যই রাখতে হবে পর্যটকদের। সম্প্রতি কলকাতায় বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম ফেয়ার (TTF)- এ কর্ণাটক ট্যুরিজমের পক্ষ থেকে জানানো তথ্যে এই সমস্ত কিছুর খোঁজখবর একসঙ্গে পাওয়া গেল। আসন্ন পুজোর ছুটিতে যাঁরা দর্শন তালিকায় একই সঙ্গে ইতিহাস, প্রকৃতি ও আধুনিক প্রযুক্তির নিদর্শন রাখতে চান, তাঁরা অবশ্যই ভেবে দেখতে পারেন
কর্ণাটকের কথা।
ছবি : কর্ণাটক ট্যুরিজম