Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

ঋতুতে ঋতুতে লেখা হয় নব নব রূপকথা

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। এই সপ্তাহে বাঙালির প্রাণের শান্তিনিকেতন। লিখেছেন কেকা চৌধুরী

কী সুর বাজে আমার প্রাণে

আমিই জানি, মনই জানে ॥

যখন প্রথম যাই শান্তিনিকেতন, সেটা ‘৭১ বা ‘৭২ সাল হবে। অবাক হয়ে দেখছিলাম চার-পাঁচটি মেয়ে, চুলে তাদের ফুল গোঁজা, গান গেয়ে চলেছে রাঙামাটির পথ ধরে। শীতের রোদ্দুর পিঠে নিয়ে ছাত্রছাত্রীর দল–চলছে গাছের তলায় পড়াশোনা। এই সবই আগে শুনেছিলাম, পড়েওছিলাম। কিন্তু যখন প্রত্যক্ষ করলাম, তখন একরাশ মুগ্ধতা। সেই থেকে যাওয়া শুরু। আজও বৃষ্টিভেজা লালমাটির পথ হাতছানি দিয়ে ডাকে। আজও সুযোগ পেলেই পালিয়ে যাই শান্তিনিকেতন।

আশ্রমিক

বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্টটাকে পাশে রেখে, মনোরম এক শৈশবকাল তখন সাজানো ছিল শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পরিবেশে। শহুরে ইট-বালির বদ্ধ ঘরের বাইরে অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুমনের বিকাশে একটু একটু গড়ে ওঠে শুদ্ধতা। শীতকালে গাছের তলায় চলছে ক্লাশ। হঠাৎ ছাত্রীর চাদরের তলা থেকে ছাগলছানা বেড়িয়ে মাটিতে নেমে ভ্যাঁ ভ্যাঁ রবে চো-চা দৌড়। শিক্ষক স্তম্ভিত। গাছ থেকে কুল, কাঁচা আম পেড়ে, ক্যান্টিন থেকে নুন-তেল জোগাড় করে স্নানের বালতির মধ্যে মেখে একসাথে হাত চেটে খাওয়া। রাতে দলবেঁধে গান গাইতে গাইতে ক্যান্টিনে খেতে যাওয়া।

বিদ্যাপাঠের সব বিষয়ের সাথে নাচ, গান, আঁকা, হাতের কাজ একই সাথে শেখা। বুধবার সকালে মন্দিরে উপাসনা। স্লোক পাঠের সাথে ব্রহ্মসংগীত। কচি-কন্ঠ, পরিনত-কন্ঠের পরিশীলিত নিবেদন। সবুজের সমারোহের মাঝে মন্দির প্রাঙ্গণে বসে, কবিগুরুকে নতুন করে চেনা। প্রেম ও প্রকৃতির মাঝে পূজাকে খুঁজে ফেরা। এখন পরিবর্তিত হয়েছে অনেক কিছু। খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘিরে তৈরি হয়েছে পাঁচিল। সময়ের সাথে পাল্টাতে হতোই। চারদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের চিহ্ন, সংস্কৃতি ভাঙনের পালা। আশ্রমিক পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখতে পাঁচিল তোলা হল।

Img 20220912 Wa0000
ঋতুতে ঋতুতে লেখা হয় নব নব রূপকথা 18

আশ্রমে উৎসবে

বছরের শুরুর প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালিত হয়। উপাসনা গৃহে গান ও পাঠের অত্যন্ত মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান পরিবেশন করে আশ্রমিকরা গুরুদেবের জন্মদিন উদযাপন করেন। ২২শে শ্রাবণ গুরুদেবের প্রয়াণ দিবসে পালিত হয় বৃক্ষরোপণ এবং হলাকষর্ণ অনুষ্ঠান। ১৫ই অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন খুবই সুন্দরভাবে পালিত হয় শান্তিনিকেতনে। সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সমবেত স্বদেশী গানের মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। বিকেলে আলোকসজ্জা। মোমবাতির আলোতে সাজানো হয় গৌড়প্রাঙ্গণকে। অপরূপ মায়াবী পরিবেশ। এরপর নাট্যঘরে অনুষ্ঠান। পরের দিন ১৬ই অগাস্ট নাট্যঘরে উদযাপিত হয় বর্ষামঙ্গল। প্রকৃতি পর্যায়ে বর্ষার গান-কবিতা পাঠ এবং নাচের ডালি সাজিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মিলিত প্রয়াসে অভিনবত্ব ছাপ রেখে যায়।

মহালয়ার বিকেলে ‘আনন্দ বাজার’ খুব সুন্দর ও অভিনব এক অনুষ্ঠান। সকাল থেকেই ছাত্রছাত্রীরা সেদিন খুব ব্যস্ত। হাতের তৈরি কাজ, বিভিন্ন খাবারের পসরা সাজিয়ে ছোট্ট মেলা আনন্দ বাজার। আরেকটি মজাও আছে। সেদিন থেকেই শুরু পুজোর ছুটি। নভেম্বর থেকেই শান্তিনিকেতনে হালকা শীতের আমেজ। ডিসেম্বরের ১-২ তারিখে নন্দলাল বসুর জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি কলাভবনে নন্দন মেলা। অসাধারণ শিল্পকর্মের নানান সামগ্রীর আকর্ষণে শিল্পমনস্ক মানুষ ছুটে আসবেই।

৭ই পৌষ নির্দিষ্ট দিনে শুরু হয় পৌষমেলা। হুজুগে মানুষ যাঁরা মেলার মাঠে ভিড় জমান, তাঁরা অনেকেই হয়তো জানেন না পৌষমেলার তাৎপর্য। তাঁদের জন্য কিছু তথ্য। সেদিন আশ্রমিকরা জেগে ওঠে সানাইয়ের সুরে। অনুষ্ঠান শুরু হয় বৈতালিক দিয়ে। গান গাইতে গাইতে প্রদক্ষিণ। এরপর ছাতিমতলার অনুষ্ঠান। বেদমন্ত্র পাঠ এবং ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন। অনুষ্ঠান শেষে গান গাইতে গাইতে উত্তরায়ণ ভবনের সামনে সমবেত হওয়া। সেখানে কয়েকটি সমবেত সংগীত পরিবেশনের পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি এত সুন্দর, মন ভরে যায়।

রঙে রঙে ভরিয়ে দেওয়ার উৎসব দোল বা হোলি। এই দিনটি পালনে রবীন্দ্রনাথ ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নিয়েছিলেন বসন্তোৎসব নামকরণ করে। শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব একটি বড় উৎসব। শুরু হয় আগের দিন সন্ধ্যায় বৈতালিক দিয়ে। চাঁদের আলোয় খোল-মন্দিরা বাজিয়ে ‘ও আমার চাঁদের আলোয়’ গানটির সাথে আশ্রম প্রদক্ষিণ। পরদিন ভোরে বৈতালিকের পর ছোট থেকে বড় ছাত্রছাত্রীরা, যারা অনুষ্ঠান করবে, এক জায়গায় সমবেত হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে লাইন দিয়ে ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটির সাথে নাচ করতে করতে এগিয়ে চলে গৌড়প্রাঙ্গণের দিকে। এরপর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান।

যদিও এখন আশ্রমের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অনুষ্ঠানটি খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মিলিত প্রয়াস সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়, বিশ্বভারতীর প্রতিটি অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত রবীন্দ্রভাবনায় অনুসৃতি সাজপোশাকের নিজস্ব ঘরানা। রং-তুলি, কাগজ আর ফুল-পাতা দিয়ে তৈরি নজরকাড়া অলঙ্কার এবং পোশাকের সম্ভার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, কোভিডের আকাশছোঁয়া সংক্রমণ এবং লকভাউনের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল শিল্প-সংস্কৃতি জগৎ। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠছে জীবন। শান্তিনিকেতনেও ফিরে আসছে পরিচিত ছন্দ। ।

কি কি দেখবেন

উত্তরায়ণ এবং রবীন্দ্রভবন ঘুরে দেখবেন। ফেরার পথে দু-পা হেঁটে উপাসনা গৃহ। কাচের কারুকাজ করা মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে অনুভব করবেন মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম। স্কুল খোলা থাকলে দূর থেকে দেখুন, প্রাকৃতিক পরিবেশে চলছে পাঠভবনের পঠন প্রক্রিয়া। দেখুন বিশ্বভারতী আশ্রম। সন্ধেবেলা গাড়ি, টোটো বা হেঁটেই চলে যান কোপাই নদীর ধারে। কোপাইয়ের নির্জন সৌন্দর্যে মন ভালো হয়ে যাবে। এখানে ভোরবেলায় গেলেও ভালো লাগবে। হাঁটু জলে নামতেই পারেন। শান্তিনিকেতনের বিশেষ আকর্ষণ খোয়াইয়ের সৌন্দর্য আজ অনেকটাই ম্রিয়মান। প্রয়োজনের তাগিদে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। খোয়াইয়ের পায়ে চলার পথ চাপা পড়েছে পিচঢালা রাস্তার নিচে।

অন্যদিকে, পাশেই সোনাঝুড়ির হাট কলেবরে বেড়েছে কয়েকগুণ। শহুরে মানুষের চাহিদা মেটাতে গ্রামের মানুষ, দরিদ্র শিল্পী, ছোট ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছেন। হাটের মাঠে রয়েছে শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী শাড়ি, পোশাক, গয়না, হাতের কাজের পর্যাপ্ত সম্ভার। বাউলের গান শুনতে শুনতেই আস্বাদন করুন বিভিন্ন স্বাদের লোভনীয় খাবার। ঝাল-নুনে মাখা মিষ্টি আমড়া, আলুকাবলির পাশাপাশি উন্নাসিক পাটিসাপটা, নারকেল নারুর বৈচিত্র্যময় মেলবন্ধন। আমার কুটিরে সকালেই যেতে হবে। নাহলে, সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়মমতো বন্ধ হয়ে যাবে। ডোকরার গয়না, চামড়ার ব্যাগ, পাটি-মাদুর এবং কাঠের নানান সামগ্রী রয়েছে এখানে। পকেট সমর্থন করলে চটপট সংগ্রহ করে ফেলুন। অবশ্যই দেখবেন প্রদর্শনী কক্ষটি। অতীতে স্বদেশীদের গোপন কর্মভূমি ছিল এই অঞ্চল। আজও সেই স্মৃতিচারণ আমাদের শিহরিত করে।

শিল্প সুষমামণ্ডিত কারুকাজে সমৃদ্ধ প্রকৃতি ভবন এবং সৃজনী শিল্পী গ্রাম অবশ্যই যাবেন। কঙ্কালীতলা সতীপীঠ দর্শনের জন্য একটি সকাল রাখুন। সাথে গাড়ি না থাকলে আগে থেকেই বলে রাখুন টোটো চালককে ভোরে চলে আসার জন্য। সাথে ছোটরা থাকলে অবশ্যই যাবেন সায়রবীথি উদ্যান। প্রকৃতির মাঝে অনাবিল নির্জনতা ভালো লাগবে আপনারও। এই উদ্যানটির বিশেষ আকর্ষণ, বিশাল জলাশয়ের মাঝে ছোট্ট একটি দ্বীপ। সেই নির্জন দ্বীপে পাখিদের বাস। শীতকালে তারা উড়ে আসে সাগর পাড়ি দিয়ে।

কোথায় থাকবেন

শান্তিনিকেতন এবং বোলপুরে রাত্রিবাসের জন্য প্রচুর হোটেল এবং সরকারি ট্যুরিস্ট লজ থাকলেও আগে থেকে বুকিং করে রাখুন। এখানে ইদানীং পর্যটকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আপনার সাধ্যমতো সাধারণ মান থেকে বিলাসবহুল–সব রকমের হোটেল ও রিসর্টের ব্যবস্থাই রয়েছে। এছাড়াও শান্তিনিকেতনে গড়ে উঠেছে আকর্ষণীয় কিছু হোমস্টে। পুরাতন আবাসিকেরা অনেকেই তাদের বাগান ঘেরা বাড়িতে চালু করেছেন হোমস্টে-র ব্যবস্থা, শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যরীতি বজায় রেখেই। যাঁরা শহুরে জীবনের বাইরে গিয়ে ক’টা দিন নির্জন ও খোলামেলা পরিবেশে কাটাতে চান, তাঁরা অনেকেই পছন্দ করেন হোমস্টে-তেই রাত্রিবাস।

কিভাবে যাবেন

ট্রেন : হাওড়া ও শিয়ালদহ থেকে বোলপুরগামী অনেক ট্রেন রয়েছে। অনেকেই সুবিধার্থে প্রান্তিক স্টেশনেও নামেন। সেক্ষেত্রে দেখে নেওয়া প্রয়োজন কোন কোন ট্রেন প্রান্তিক স্টেশনে থামে। উত্তরবঙ্গগামী অনেক ট্রেন বোলপুর স্টেশনে থামে। অবশ্যই সময়কাল দেখে নিতে হবে।

বাস : ধর্মতলা থেকে বোলপুরগামী এসি/নন-এসি বাস পাওয়া যাবে।

গাড়ি : কলকাতা থেকে জাতীয় সড়ক ২ ধরে বর্ধমান, পানাগড় এবং ইলামবাজার হয়ে অজয় নদের ব্রিজ পার হয়ে প্রথমে শ্রীনিকেতন পৌছবেন। সেখান থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শান্তিনিকেতন। মিনিট দশেকের পথ। আরেকটি রাস্তা হল, বর্ধমান থেকে ১০৮ শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে গুসকরা এবং ভেদিয়া হয়ে অজয় নদ পার হয়ে প্রথমে শ্রীনিকেতন পড়বে। তারপরেই শান্তিনিকেতন পৌঁছে যাবেন। যাঁরা বোলপুর যাবেন তাঁরা শান্তিনিকেতন হয়ে পৌঁছে যাবেন বোলপুর।

শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির ছয়টি ঋতু নিজেদের অপার সৌন্দর্যের ভিন্নতা ছড়িয়ে রেখেছে লালমাটির আনাচেকানাচে। তাই গুরুদেব প্রতিটি ঋতুকেই বরণ করে নিয়েছেন স্বীয় রচনার সম্ভার সাজিয়ে ভিন্নতর আঙ্গিকে। শান্তিনিকেতনে না এলে সত্যিই উপলব্ধি করা যায় না বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যকে। গ্রীষ্মের রুক্ষ প্রান্তরে একাকী রাখাল বালক বেণু বাজায় আপন মনে। বর্ষার ঘন সবুজে, মালতীলতা দোলে, পিয়ালতরুর কোলে পুব-হাওয়াতে। বসন্তে আঙুনরঙা পলাশের অপরূপ রূপ বৈচিত্র্য আকুল করে মন-প্রাণ, চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে সে। এমনই আমাদের শান্তিনিকেতন, বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন। তাই তো দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে পর্যটকের দল। এখানে যে প্রেম ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার।

ছবি : লেখক