কেমন আছো কাশ্মীর?
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম।
নিবিড়, নান্দনিক নিসর্গের কাশ্মীর বরাবর পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রে। ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে আমাদের যত অহংকার, তত যন্ত্রনা। স্বাধীনতার পর কেটে গেল এতগুলি বছর, বদলালো না কাশ্মীরের ভাগ্য। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে কেমন আছেন এখানকার মানুষ ? তাঁদের যাপনও কী এমন সুন্দর ? পড়ছেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। ধারাবাহিক রচনার ষষ্ঠ পর্ব আজ।
গুলমার্গ দর্শনের মুগ্ধতার রেশ অনেকক্ষণ ছিল। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডিনারে এসে দেখি ইতিমধ্যেই অর্ধেকের বেশি টেবিল ভর্তি। বুঝলাম শ্রীনগরে এখন ভালোই পর্যটক সমাগম। আমাদের পাশের টেবিলে ডিনার করছে এক বাঙালি পরিবার। আমরা টেবিলে বসার পরেই তাদের মধ্য থেকে এক মহিলা জানতে চাইলেন, আমরা গুলমার্গ গেছিলাম কিনা। আজই ঘুরে এসেছি শুনে তিনি বললেন, আমরাও গেছিলাম। সে কি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা! ওখানে নামতেই কয়েকজন খিলেনমার্গে বরফ দেখাতে নিয়ে যাবে বলল। আমরা গন্ডোলার খোঁজ করাতে বলল, গন্ডোলার দিকেই নিয়ে যাবে। আমরা ওদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। উঁচু নিচু রাস্তা! ‘এইতো কাছেই’ বলে বলে আমাদের অবশেষে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানে অনেকটা এলাকা জুড়ে বরফ আর স্লেজগাড়ি নিয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। ঠিক করে দরদাম করার আগেই প্রায় জোর করে আমাদের স্লেজগাড়িতে তুলে দিল। আমার হাজব্যান্ডের গাড়িটা বরফে স্লিপ করে উল্টে গেল। প্রবল আঘাত পেলেন তিনি। বাচ্চাগুলো কাঁদতে শুরু করেছে। আমাদের কাছে কোনও ওষুধপত্রও নেই।
খুবই আতঙ্কিত এবং হতাশ হয়ে পড়েছেন দেখলাম সকলে। বুঝতে পারলাম, ওঁরা দালালদের খপ্পরে পড়েছিলেন। স্বাভাবিক, বেড়াতে এসে এমন ঘটলে সবারই মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত ওঁরা বাজে খপ্পরে পড়েছিলেন। ভাবলাম, আমাদের এখানে তিনদিন হয়ে গেল। আমাদের অভিজ্ঞতা তো খুবই ভালো। বললাম, যে কোনও টুরিস্ট স্পটে কমবেশি ঠকবাজ থাকে। যাই হোক একটা ঘটনাতেই নিরাশ হবেন না। বাকি ট্রিপ নিশ্চয় ভালো হবে।
পরদিন সকাল ন’টায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম সোনমার্গের উদ্দেশে। কাশ্মীরীরা বলে সোনামার্গ–সোনা ভরা মাঠ (meadow of gold )। শহর ছাড়িয়ে কিছুদূর এগনোর পরেই দেখা গেল দূর-দুরান্তরে রুপোলি মুকুট পরা সারি সারি পাহাড়ের চুড়া। আরও কিছুক্ষণ পরে সঙ্গী হলো খরস্রোতা সিন্ধুনালা। এই সিন্ধু সেই বিখ্যাত সিন্ধু নদ নয়, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা। প্রসঙ্গত, সিন্ধু নদ হলো ট্রান্স-বাউন্ডারি এশিয়ান রিভার। এশিয়ার তিনটি দেশকে যুক্ত করেছে সিন্ধু । জন্ম হয়েছে চীনের তিব্বতের মানস সরোবরের কাছে হিমালয়ের কৈলাস রেঞ্জ থেকে। এরপরে ভারতের সীমানা ছুঁয়ে ঢুকে পড়েছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট এবং বালতিস্তানে। এরপরে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে বয়ে গিয়ে আরবসাগরে মিশেছে। এই সিন্ধুনালার উৎপত্তি অমরনাথের কাছে মাচোই হিমবাহ থেকে। কিছুদূর এগিয়ে খাজিয়ার হিমবাহ থেকে উৎপন্ন আরও কিছু ছোট ছোট নদী, ঝর্ণাধারা সঙ্গে নিয়ে দুরন্ত বেগে বয়ে অবশেষে মিলেছে ঝিলমের সঙ্গে। ঝিলামের গুরুত্বপূর্ণ শাখানদী –সিন্ধু নালা।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের দূরত্ব ৮১কিমি। মেহরাজ বললো ঘন্টা তিনেক সময় লাগবে। দুদিকে ফার, পাইন, আখরোট দিয়ে সাজানো খাড়াই পাহাড় আর মাঝখানে নুড়ি-পাথর সঙ্গে নিয়ে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে দামাল সিন্ধু। পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসেছে অজস্র ছোটো বড়ো ঝর্না কোনও কোনও ঝর্না আবার শক্ত সাদা বরফ হয়ে জমে আছে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। যত ওপরে উঠছি বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো ক্রমশ কাছে চলে আসছে। ডাইনে বাঁয়ে সামনে —সবটাই এত সুন্দর কোনদিকে তাকাবো ঠিক করা মুশকিল। এত সৌন্দর্য,কি করে সম্ভবব? দৃশ্যপট এমন, শুধু দু’চোখ নয়, মনটাকেও আটকে রেখেছে। সময়ের জ্ঞান হারিয়ে গেছে।
চলতে চলতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম এমন একটা জায়গায়, যেখানে চারদিকে বরফে মোড়া পর্বত শৃঙ্গ। এমন অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, মুহূর্তের জন্যেও চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না। তখনই মেহরাজ ঘোষণা করল, আমরা সোনমার্গে পৌঁছে গেছি। কাছেই ওপরে একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে। আমরা লাঞ্চ করে নিতে পারি।
আমরা এতটাই মুগ্ধ–খিদে-তেষ্টা ভুলে গেছি। মনে হচ্ছিল কোনও স্বপ্নরাজ্যে এসে পড়েছি । বোঝা গেল, হিমালয়ের কাশ্মীর উপত্যকাকে কেন ‘ভূস্বর্গ’ বলা হয়। স্বর্গের ধারণাও হয়তো এখান থেকেই এসেছে। গাড়ির রাস্তা আপাতত এখানেই শেষ। কারণ, নভেম্বর থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাস্তা জমাট বরফে ঢেকে যায়। মে মাসে যখন বরফ গলে যায় তখন রাস্তা মেরামত করে খুলে দেওয়া হয়।
সম্পূর্ণভাবে মিলিটারির দায়িত্বে ওই গুরত্বপূর্ণ রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ। কারণ, ওই পথেই জোজিলা পাস, দ্রাস হয়ে কার্গিল যেতে হয়। কার্গিল থেকে লাদাখ । কাছেই বালতাল–অমরনাথ যাত্রীদের জন্য ক্যাম্প করা হয় ওখানে। এখন আমাদের সামনে দুপাশে শুধু বরফের স্তুপ। এখানেও ঘোড়া আছে, স্লেজ গাড়ি আছে, বরফের জুতোও ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সোনমার্গের উচ্চতা (২৭৩০ মি) কিছু বেশি হলেও গুলমার্গের মতো অত ঠান্ডা নেই। আমরা বরফে হাঁটব না বলে পায়ে হেঁটেই যতটা ঘোরা যায় ভেবে হাঁটা শুরু করতেই হঠাৎ চারিদিক কেমন অন্ধকার হয়ে গেল। মেঘ দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকানোর সুযোগটুকুও পাওয়া গেল না, শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
সে একেবারে বড়ো বড়ো বরফের গোলার মত শিল। আমাদের মত অন্যান্য পর্যটকরাও মাথা বাঁচানোর জন্য ছুটতে ছুটতে রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তখন ঘড়িতে দেড়টা বাজছে। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত বাইরে বেরোনোর উপায় নেই বলে আমরা লাঞ্চের অর্ডার দিলাম। আমাদের লাঞ্চ শেষ হবার আগেই বৃষ্টি থেমে গেল এবং ঝলমলিয়ে রোদ উঠল। ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিলাম রবীন্দ্রনাথ আমাদের চলার পথের প্রতিটি মুহূর্তে কিভাবে ধরা দেন। মনের মধ্যে গুঞ্জন–ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে। আমরা যা দেখছি কিছুতেই যেন ফুরোচ্ছে না। যত দেখছি, সম্মোহনের ঘোর তত বেড়ে যাচ্ছে। মন বললো, ফিরে যাবার আগে মনপ্রাণ দিয়ে সব দেখে নিই। বরফের তলা দিয়ে সিন্ধুর জল কলকলিয়ে বয়ে চলেছে। স্রোতের ধাক্কা সহ্য করেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট মাছের দল দিব্যি খেলা করছে। সাদা বরফের ওপরে সারি দিয়ে লাইন করে ঘোড়ার দল আসছে। কিছুক্ষণ পরেই ফতোয়া নিয়ে হাজির হলো মেহরাজ। সোনমার্গের মনকেমন-করা অনন্য নিসর্গকে বিদায় জানিয়ে চারটে নাগাদ আমরা গাড়িতে উঠলাম।
(চলবে)
ছবি : লেখক