Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

জীবন হারিয়ে জীবনের দাম

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই  নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

শিলিগুড়িতে থাকা শুরু করবার পর আর যাই হোক, ট্রাফিক নিয়ে চলতে ফিরতে এত চিন্তা করতে হবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় জন্ম ইস্তক এতগুলো বছর কাটালাম! শিলিগুড়ি তো তার তুলনায়–আমার এই ভুল ভাঙতে খুব বেশি দেরি হলো না! কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম এখানে পথ চলায় গাড়িঘোড়া, মানুষ কারও জন্যই কোনও নিয়ম নেই। রাস্তায় পা রাখা মাত্রই আতঙ্ক ঘিরে ধরে। এই বুঝি গাড়ি ধাক্কা মেরে চলে গেল ! সবচেয়ে মারাত্মক হলো বাইক আরোহীদের কান্ড-কারখানা। অধিকাংশই হেলমেট পরে না। এমনও দেখেছি, এক বাইকে ৩/৪ জন চলেছে। তাদের মধ্যে কেউ হেলমেট পরেছে, কেউ পরেনি অথবা কেউই পরেনি। সেখানে একেবারে ছোট বাচ্চাও আছে।

এহেন কাণ্ডকারখানার ফলে পথে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। যাঁরা খুব নিয়মকানুন মেনে চলেন, আক্ষেপ তাঁরাও এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। আমি নিজেও বেশ বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়ি, শিলিগুড়িতে আসার এক বছরের মধ্যে। তবে, এই প্রতিবেদন সেই কাহিনি বলার জন্য নয়। এটি আর একটি ঘটনা, চোখের সামনে ওই নিয়ম মেনে না চলার পরিণতি দেখেছিলাম। এক সন্ধ্যায় বাগডোগরা থেকে ফিরছি।  ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে গাড়ির চালক বড় রাস্তা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ছোট এক রাস্তা ধরে। ততক্ষণে আরও কয়েকটি গাড়ি আমাদের আগেই ওই পথে ঢুকে গেছে। মাঝারি গতিতে হলেও চলমান, এটাই শান্তি ভেবে ধৈর্য ধরে বসে আছি।

কিছু দূর এভাবে যাবার পর আবার জ্যাম। কারণ, সামনে একটি লোহার ব্রিজ এবং সেখানে পাশাপাশি দুটি গাড়ি যেতে পারে না। তাই এই অবস্থা। পরিস্থিতি এমন, উল্টোদিক থেকেও গাড়ি আসা বন্ধ হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়, গাড়ির চালকরা নেমে দেখার চেষ্টা করে সামনের অবস্থা–কতদূর পর্যন্ত জ্যাম এবং কখন সেটা স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনা ইত্যাদি। এইসবের মাঝেই চোখের সামনে ঘটে যায় অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। আমাদের ঠিক আগের গাড়ির চালক সবে তার দরজাটি খুলেছে, সম্ভবত পিছনে না তাকিয়েই–শাঁ করে এক মোটরবাইক এসে ধাক্কা মারে দরজায়। চালক এক তরুণ ও তার পিছনে বসা তরুণী, দুজনেই ছিটকে পড়ে রাস্তায়। দুর্ভাগ্যবশত মেয়েটির মাথা ঠুকে যায় পাশের বাড়ির দেয়ালে। হেলমেট পরলে চুলের স্টাইল হবে না, মাথা অরক্ষিত থাকে থাক ! ফলে, সঙ্গে সঙ্গেই রক্তারক্তি কান্ড। মুহূর্তে পুরো রাস্তা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আমার গাড়ির ড্রাইভার মেয়েটির কতখানি চোট লেগেছে, সেটা বোঝার জন্য এগিয়ে গিয়েও ফিরে আসে। অকুস্থলে ঢোকা ততক্ষণে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভিড় ও উত্তেজনা তুঙ্গে। আশপাশের লোক, ড্রাইভাররা সকলেই নেমে পড়েছে রণাঙ্গনে। ওরাই তখন পুলিশ ও কোর্ট। দোষী তো খুঁজে বের করা হয়েই গেছে, মানে ওই ড্রাইভার, যার গাড়িতে ধাক্কাটা লাগে, এবার সবাই মিলে তাকে এই মারে তো সেই মারে। একটা ভালো ব্যাপার দেখলাম, এই সংকটের মধ্যেও সেই ‘অপরাধী’ ড্রাইভার ছেলেটি তার মাথা ঠান্ডা রেখেছে। বেশ বিবেচনাও আছে। কথা না বাড়িয়ে মেয়েটিকে সে গাড়িতে তুলে নেয়, দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লক্ষ্য করলাম, লোকজনও ব্যাপারটা বুঝল।

Images 2 10
জীবন হারিয়ে জীবনের দাম 7

ইতিমধ্যে আমার গাড়ির ড্রাইভার খবর জেনে এসে বললো মেয়েটির অবস্থা নাকি যথেষ্ট খারাপ। এদিকে মেয়েটির সঙ্গের ছেলেটি, মানে দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত যে বাইক চালাচ্ছিল একেবারে বলিউডি কায়দায়, এখন তার একেবারে হতভম্ব দশা। বাইকে যেভাবে বসেছিল তারা, তাতে রোমান্টিক কাপল বলেই মনে হয়। বন্ধুও হতে পারে। আজকাল এসব বোঝা কঠিন। সে যাই হোক, আপাতত ছেলেটিরই সব চাইতে বেশি টেনশন। মেয়েটির বিশেষ কিছু ক্ষতি হলে, জবাবদিহি তো তাকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, এই সন্ধ্যায় তার মাথাতেও হেলমেট ছিল না। এছাড়াও ওইরকম এক সরু রাস্তা দিয়ে প্রবল জ্যামের মধ্যে অত স্পিডে ওভারটেক করাটাও উচিত হয়নি তার।

কিছুক্ষণ পর ট্রাফিক পুলিশের হস্তক্ষেপে রাস্তা সচল হয়। একে একে গাড়ি যেতে থাকে। মেয়েটির খবর জানি না। উপায় নেই। সবাইকেই নিজের দিশায় চলতে হবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, যেন তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে সে। ছেলেটির হতভম্ব মুখ মনে পড়ে। এই দুর্ঘটনা তাদের দুজনকে এবং বাকি যারা চাক্ষুষ করলো, তাদেরও কিছু শেখাবে কি ? অনুভূত হবে কি, হেলাফেলার নয় জীবন ? কিন্তু এসব তো আমার ভাবনা। আমার বা আমাদের, যারা এখনও ভাবি পথঘাটে নিয়ম মেনে চলা জরুরি। বয়সের জোশে বোধহয় তরুণরা সেটা মানতে চায় না। স্কুটার বা বাইকে বসলেই হিরোর ক্যারিশমা মাথায় চেপে বসে। আর গার্লফ্রেন্ড পিছনে বসে থাকলে তো কথাই নেই। তখন পুরো রাস্তাই হয়ে যায় বন্ধনহীন গ্রন্থি। মাথার উপর খোলা আকাশ আর সামনে খোলা রাস্তা। খোলা না হলেও খুলে নিতে চায় ওরা। ভিড় বা ট্রাফিকের রক্তচক্ষু কোনওটাই মানতে চায় না মন। মনের দাবি মানতে গিয়ে পথের দিশা হারিয়ে যায়।

পথ কোথায় গিয়ে শেষ হবে, সেটা কেউ জানে না ! কিন্তু জীবনপথ তো কোথাও শেষ হবেই ! আর এটা কিন্তু সকলেরই জানা। হেলমেট পরে বাইক চালাবার নিয়ম তো তাদের ভালোর জন্যই। অকালে জীবনের সিলেবাস শেষ হবে, এটা যে মোটেই কাম্য নয় ! নিয়ম মেনে না চললে সময়ের আগেই বাজতে পারে ছুটির ঘন্টা। এ ছুটিও তো নিজের হিসেবে মেলে না। কেউ সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত। কারওর আবার সচল জীবন থেকে ছুটি নিয়ে অথর্ব হয়ে পরের অনুগ্রহে জীবনধারণ করা। দুঃখ ও আক্ষেপ, ঘটনার মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত সবাই সব জেনেও উদাসীন।