Monday, February 3, 2025
বিনোদন প্লাস স্পেশাললাইম-Light

দর্শককে ভাবনার রসদ যোগাবে ‘মহানন্দা’

লিখেছেন অজন্তা সিনহা

“এত বছর ইন্ডাস্ট্রিতে আছি–দু’দশকের বেশি সময়, এমন একটা চরিত্রে এর আগে কেউ ভাবেননি আমায়। সেইজন্যই অফার পাওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করিনি ‘হ্যাঁ’ বলতে। নিঃসন্দেহে আমার কেরিয়ারের মাইলস্টোন হতে চলেছে এই ছবি”–এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বাংলা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সেরা অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী। বস্তুত, অরিন্দম শীল পরিচালিত ‘মহানন্দা’ ছবিতে মহাশ্বেতা দেবীর অনুপ্রেরণায় নির্মিত মহানন্দা চরিত্রে অভিনয় তাঁর জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে গার্গী নিজেই মনে করেন। উল্টোদিকে গার্গীকে এই চরিত্রে নিয়ে তিনি যে ভুল করেননি, সেটা অরিন্দমের উপলব্ধি। গার্গী কোথাও এতটুকু ফাঁক রাখেননি নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রসঙ্গত, এটা গার্গীর বরাবরের অভ্যাস। মঞ্চ ও পর্দার দক্ষ, মেধাবী, অনুভবী, সমাজ সচেতন এই অভিনেত্রী নিজেই নিজের জন্য ট্রেন্ড সৃষ্টি করেন বারবার। প্রবাহে ভাসেন না। প্রবাহ তৈরি করেন। তাঁর অভিনয়ের বহুমাত্রিকতা ‘মহানন্দা’-য় কতটা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, দেখতেই হবে।

এই মুহূর্তে মুক্তির অপেক্ষায় ‘মহানন্দা’। আর ইতিমধ্যেই বাংলা ছবির দর্শক তো বটেই এই ছবি দেখার জন্য তীব্র অপেক্ষায় ইন্ডাস্ট্রিও। একটা কথা পরিষ্কার বলে দেওয়া জরুরি, ‘মহানন্দা’ একেবারেই মহাশ্বেতা দেবীর বায়োপিক নয়। ওঁর আদর্শ, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা যাবতীয় স্বতন্ত্র, স্বাধীন মনন ও চেতনা, সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ–এই সবই ‘মহানন্দা’-র উৎস, অনুপ্রেরণা বা অবলম্বন। বলা যায়, মহাশ্বেতা দেবী এখানে এক ভাবনা ও দর্শনের প্রতীক। সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন তিনি। গার্গী যথার্থই বলেছেন, “মহাশ্বেতা দেবীর মধ্যে আবেগের যে আগুন আমরা দেখেছি, সেটা যে কতটা প্রবল শক্তিদায়ক একটা ব্যাপার !” সত্যিই তাই। আদিবাসী মানুষের জন্য তাঁর দীর্ঘ লড়াই থেকে রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে মহাশ্বেতা দেবীর প্রতিবাদী আন্দোলন–সবক্ষেত্রেই আমরা অনমনীয়, আদর্শে অটল এক মানুষকে দেখতে পাই।

Images 7 1

সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর জীবনদর্শন ও যাপন কখনওই শুধু লেখাপড়ার টেবিলে থেমে থাকেনি। তাঁর কলম বারবার উদ্যত হয়েছে পিছিয়ে থাকা, অবহেলিত ও কঠিন জীবনযুদ্ধে রত মেহনতি মানুষের জন্য। “লিঙ্গ বৈষম্য থেকে নারীর সম্মান ও স্বীকৃতি, যা নিয়ে আজ আমরা এত কথা বলি, সেটা কত বছর আগে বলেছেন মহাশ্বেতা দেবী। সাঁওতাল নারীদের কথাও তিনিই তুলে আনেন।”–ছবির বিষয় প্রসঙ্গে অভিব্যক্তি অরিন্দমের। আদতে, আমরা যারা মহাশ্বেতা দেবীর লেখা পড়ে নিজেদের কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছি, তারাও মানুষের জীবন, তার সামাজিক প্রেক্ষিতে কী রূপ পায়, সেটা অবলোকন করবার দৃষ্টিক্ষমতা পেয়েছি। আত্মকেন্দ্রিক উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলতে সাহায্য করেছে ওঁর লেখা উপন্যাস ও প্রবন্ধ।

পরিচালক অরিন্দম শীল বলেছেন, “মহাশ্বেতা এক প্রজ্জ্বলিত মশাল বাহকের নাম। যে মশাল আমাদের সঠিক পথ দেখায়। আজকের অস্থির ও জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তের অভিমুখ বলে দেয়।” নিজের বিশ্বাস ও মহাশ্বেতা দেবীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাকে হাতিয়ার করে পরিচালক অরিন্দম ‘মহানন্দা’-কে সাজিয়েছেন বড় যত্নে। ছবি নির্মাণ বা নির্দেশনার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই বহুমুখী ভাবনার অনুসারী তিনি। নানা বিষয় দেখেছি আমরা তাঁর ছবিতে। শুধু তাই নয়, নিবিষ্ট ও গভীর গবেষণার একটি প্রক্রিয়া অরিন্দমের ছবিতে সবসময়ই মেলে। ‘মহানন্দা’-র ক্ষেত্রে সেটা যে আরও নিখুঁত ও নিপুণ হবে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ ছবিতে যে প্রজ্জ্বলিত মশালের কথা বলা হয়েছে, তা মহাশ্বেতা দেবীর হাত ধরে শুরু হলেও, সেখানেই থেমে থাকবে না। প্রজন্মগত ভাবে এগিয়ে যাবে এই মশাল। সময়ের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বাহকের হাতে উঠবে এই মশাল ও মানুষের কাছে পৌঁছবে তার আলোকবার্তা। ১৯০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে ধরা হয়েছে এ ছবিতে। বিশাল এই রেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বদলে যাবে ছবির প্রেক্ষাপট, রং এবং বাকি অনুষঙ্গ–যা প্রাণময় হয়ে উঠেছে সিনেমাটোগ্রাফার অয়ন শীলের ক্যামেরায়। উত্তর কলকাতা ও বীরভূমের লোকেশনে হয়েছে ছবির শুটিং।

ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও মিউজিক বিক্রম ঘোষ। শিল্প নির্দেশনা অমিত চ্যাটার্জি। সাবর্ণি দাস কস্টিউম ডিজাইনার। হেয়ার ড্রেসিং ও মেকআপ সোমনাথ কুন্ডু। ফিরদৌসুল হাসান ও প্রবাল হালদার নিবেদিত ‘মহানন্দা’ প্রযোজনা করেছে ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন। গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ অরিন্দম শীল ও শুভেন্দু দাসমুন্সী। অভিনয়ে গার্গী ছাড়াও আছেন দেবশঙ্কর হালদার, ঈশা সাহা, অর্ণা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ঈশা ছাড়া বাকিরা মুখ্যত থিয়েটার অভিনেতা। ছবির অভিনেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কোথাও এতটুকু ফাঁক রাখেননি অরিন্দম বোঝাই যাচ্ছে। আগামী ৮ এপ্রিল মুক্তি পাচ্ছে মহানন্দা। টানটান অপেক্ষায় তামাম বাংলা ছবির দর্শক। এক মানবীর অনির্বচনীয় জীবনদর্শন ও যাপন, মানুষের জন্য তাঁর দরদ ও লড়াই–সেই পটভূমি চিহ্নিত করবে সমসাময়িক সময়কে। একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবিক দলিল, একটি সুচারু অন্বেষণ, এক গভীর ও ইতিবাচক বার্তা নিয়ে ‘মহানন্দা’ নিঃসন্দেহে ভাবাবে আপনাকে। নাড়া দেবে অন্তঃস্থলে।