ধন্যবাদহীন প্রক্রিয়াটার মধ্য দিয়ে যেতেই হয়
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। আজ সব্যসাচী ভৌমিক। ধারাবাহিক রচনার তৃতীয় পর্ব আজ। আলাপচারিতায় অজন্তা সিনহা
◆ বিষয় ও বাজেটের মধ্যে সমন্বয় সাধন
একদম স্পেসিফিক কোনও গাইডলাইন দেওয়া সম্ভব নয়। আমার তো জানা নেই। মনেও হয়না আছে বলে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, বল যেভাবে আসবে সেভাবেই ব্যাট চালাতে হবে। তবে বাজেট অনুযায়ী পৃথিবীর সব ছবিকেই প্রস্তুত হতে হয়। ধরা যাক, সঞ্জয় লীলা বনশালী–তাঁর ছবিতে জাস্ট একটা সেট যে বাজেট পায়, তিনটে বাংলা ছবি মিলিয়ে সেই বাজেট পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রস্তুতির রকমফের অনেকটাই। তবে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু অন্যরকম। এক্ষেত্রে টার্গেট দর্শকের ব্যাপারে পরিচালককে খুব শিওর থাকতে হয়। বাজেট অনুযায়ী লোকেশন, কাস্টিং, লাইট, নম্বর অফ শ্যুটিং ডেজ, সব সাজিয়ে রাখতে হয়। অনেক অ্যাম্বিশন কমাতে হয়। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হয়, ব্যাপারটা আপোষের জায়গায় না চলে যায়।
আমার ক্ষেত্রে একটা কথা বলতে পারি, যেহেতু আমি নিজের ছবি নিজেই স্ক্রিপ্ট করি নিজেরই গল্পে–তার ফলে বারবার কিছু জিনিস খেয়াল রাখতে হয়। ধরুন কেউ একটা ছবি বানানোর সময় স্ক্রিপ্টে একইসঙ্গে পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র, শহর সব রাখলেন। পরে দেখা গেলো যা বাজেট তাতে আশি পার্সেন্ট ইনডোর হলে ভালো হয়। এবার তিনি কি করবেন? গল্প পাল্টাবেন? তাহলে তাঁর আগের কাজটা পন্ডশ্রম হয়ে গেলো। নাকি পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্রের গল্পকে একসঙ্গে ধর্মতলায় নিয়ে যাবেন। তাহলে তো গল্পের যে স্ট্র্যাটেজি সেটাই গুলিয়ে গেলো। দুটোই ক্ষতি। আগে থেকে হোমওয়ার্ক ঠিকঠাক করে রাখলে সময় ও পয়সা দুইই বাঁচে।
◆ অভিনেতা ও টেকনিশিয়ানদের সহযোগিতা
অনেকটাই মেলে। অন্তত, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। আসলে অভিনেতা, টেকনিশিয়ান সকলেরই কিন্তু ভালো কাজ করার খিদেটা আছে। তবে, এটা তো তাঁদেরও রুটিরুজির ব্যাপারে। তাঁদের তো আর নিঃশর্তে আত্মত্যাগ করতে বলা যায় না। ব্যক্তিগত পরিচয়ের গন্ডি টপকেও অনেকেই সাহায্য করেন। এই একটা বিষয়ে আমি খুব পজিটিভ কথাই বলবো।
◆ সার্বিকভাবে পরিচালকের নিজের প্রস্তুতিপর্ব
প্রস্তুতির একটা ক্লাসিকাল দিক তো আছেই। যে কোনও ছবির ক্ষেত্রেই যেমন হয়–রেইকি, কাস্টিং, রিহার্সাল, স্ক্রিপ্ট সেশন, সবই। তবে, ওই আগেও যা বলেছি, বাজেটের সীমাবদ্ধতার জন্য সবটাই করতে হয় একটু মেপে। লোকেশন চুজ করার ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হয় লাইটস কি লাগবে এবং সেক্ষেত্রেও যতটা সম্ভব ইকোনমিকাল হওয়া। আসল প্রস্তুতি হলো, ছবি যেন গুণগত উৎকর্ষতায় বাজেট ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে যেতে পারে। যেটা আসল চ্যালেঞ্জ, একটা ওটিটি-তে অন্য দশটা হাই বাজেটের ছবিকে যাতে মেকিং ও কনটেন্টে পিছনে ফেলতে পারে।
◆ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি বানানোর ক্ষেত্রে আদর্শ
বিশেষভাবে কয়েকজনের নাম বলাটা প্রায় অসম্ভব। দশজনের নাম বললে আরও পঞ্চাশজনের নাম মনে পড়বে। তবে, বিভিন্ন ফিল্ম মুভমেন্ট বিভিন্ন ফিল্মিমেকারকে সামনে এনেছে। ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে কয়েকজনের নাম তো আগেই বলেছি। মারাঠি, মালায়ালম, অহমিয়া ভাষায় অনেকে ভালো কাজ করছেন। বিদেশে তো ভুরি ভুরি উদাহরণ। যদি খতিয়ে দেখা যায়, পৃথিবীর সেরা ফিল্মমেকাররা তো সবাই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার। চ্যাপলিন থেকে শুরু করে গোদার, কিয়েসলোসকি, হ্যানেকে সবাই। একটা বিশাল উচ্চতায় পৌঁছনোর পর বিগ হাউস এদের কাছে গেছে। কিন্তু স্বাধীনতার কৌলিন্য কেউই খোয়াতে রাজী হননি। বিদেশে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিং ব্যাপারটা এতোই সংগঠিত ও শক্তিশালী যে পরিচালকরা নিজের মনের ছবিটা সহজেই বানাতে পারেন। অন্তত ইউরোপে তো বটেই।
◆ ছবির প্রমোশন ও মেনস্ট্রিম মিডিয়া
এক্ষেত্রেও এক একজনের অভিজ্ঞতা এক একরকম। এমনিতে স্ট্র্যাটেজি বা বিপননের প্রশ্নে মেনস্ট্রিম মিডিয়ার সমর্থন পাওয়া যাবে না, এটা ধরেই নিতে হয়। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচিতি বা যোগাযোগ থেকে অনেকেই কিছুটা আনুকূল্য পান। এক্ষেত্রে আমি দেখেছি মেনস্ট্রিম মিডিয়ার অনেকেরই এই ধরণের ছবির প্রতি একটা সমীহ ও ভালোলাগা কাজ করে। তাঁদের একটু sensibly approach করলে তাঁরা কভার করে দেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে বেশ ইতিবাচক। আমার প্রায় প্রতিটি কাজই বড় কাগজে কভারেজ পেয়েছে। ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা সহযোগিতা পেয়েছি, আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এও বলার, এটা একদম ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতে আমার ক্ষেত্রেও এটা সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যেতেই পারে। এছাড়া মেনস্ট্রিম মিডিয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া যা হয়ে থাকে, সেটাই ধরে চলতে হবে। সুতরাং বিগ মিডিয়া বিরাট কিছু করবে এই ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি নিয়ে, সেটা আশা না করাই ভালো। লড়াইটা একেবারেই অসম এবং সেটা লড়ে যেতে হবে একটা ধন্যবাদহীন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তারপরেও একটা কথা, সহযোগিতা বলতে বড়জোর একটা আড়াইশো শব্দের রাইট আপ। তাতে খুব কিছু কি পাল্টায়? ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির সামগ্রিক লড়াইতে তাঁদের পাওয়া যাবে না, সেটাই স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে দুএকটা অন্যরকম ঘটনা ঘটে। যেমন সানাল শশীধরণের একটি ছবি ছিলো ‘সেক্সি দুর্গা’। দুর্গার আগে সেক্সি বসানো নিয়ে আপত্তি ওঠে। শেষমেষ নাম হয় ‘এস দুর্গা’। এটা মেনস্ট্রিম মিডিয়া কভার করেছিল। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, তারা কভার করেছিল সম্পূর্ণ অন্য জায়গা থেকে। এই কন্ট্রোভার্সিটা তাদের বিপণনকে একটা মাইলেজ দেবে, সেই জায়গা থেকে। এর সঙ্গে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির প্রতি মমত্ববোধের কোনও সম্পর্ক নেই। (চলবে)