মগ্ন একাকিনী তিনি…
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সুবাদে কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে সংগীত জগতের বহু গুণী মানুষের। তাঁদের নিয়েই এই কলম পড়ুন অজন্তা সিনহার কলমে।
মাত্র একবারই তাঁর মুখোমুখি হই। ফোনে দু’একবার কথা হয়েছে। আর গান তো শুনছি সেই জ্ঞান হওয়ার বয়স থেকে। রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম সুপারস্টার বলতাম আমরা ওঁকে। যেমন দৃপ্ত গাইবার ভঙ্গি। তেমন কন্ঠ ও আবেদন। রূপসী আর অভিজাত তো ছিলেনই। স্টাইল স্টেটমেন্টের দিক থেকেও তাঁর সময়ের শিল্পীদের তুলনায় অনেকটাই ব্যতিক্রমী ছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে …’ ! যাঁর কণ্ঠে এ গান প্রাণ পেয়েছিল, তিনি সুচিত্রা মিত্র। বড়ই উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত হতাম তাঁর গাওয়া ‘একলা চলো’ শুনে। আজ তাঁর সেই একলা চলার একটি দিনের গল্প।
নৃত্যশিল্পী ও শিক্ষক প্রদ্যুৎ দত্ত একবার অনুরোধ করেছিল, রবীন্দ্রগান সহযোগে নাচের উপযোগী একটি স্ক্রিপ্ট করে দেওয়ার জন্য। সচরাচর যেমন হয়, তেমন নয়। একটু অভিনবত্ব চাই। এছাড়াও, সে কোনওভাবে সুচিত্রা মিত্রকে এলবামটিতে অংশগ্রহণ করানোর একটি জোরদার সোর্স পেয়েছে। উনি বলেছেন, এক্সক্লুসিভ কিছু হলে, তবেই অংশ নেবেন। গান গাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন তখন। ওঁর জন্য একটি পাঠযোগ্য অংশ সংকলন করতে হবে। স্ক্রিপ্ট পছন্দ হলে, তবেই পাঠ করবেন, এটাও আগাম জানিয়ে দিয়েছেন। সব ঠিকঠাক হলে, সুচিত্রাদির ফ্ল্যাটে গিয়ে রেকর্ডিং করতে হবে। স্টুডিওতে যাবার মতো শারীরিক অবস্থা নেই। গড়িয়াহাট অঞ্চলে ওঁর ফ্ল্যাট। সেখানে যাব ভেবে রীতিমতো রোমাঞ্চিত হলাম। তবে, তার আগে স্ক্রিপ্ট লেখা ও সুচিত্রাদির অনুমোদন পর্ব পেরোনো।
সব ফাঁড়া কাটিয়ে একদিন পৌঁছলাম সুচিত্রাদির ফ্ল্যাটের দরজায়। সঙ্গে টিমের বাকিরা। যাঁর প্রোজেক্ট, অর্থাৎ প্রদ্যুৎ, বাচিকশিল্পী প্রবীর ব্রহ্মচারী। ততদিনে জেনেছি প্রবীরদাই সেই সোর্স। সুচিত্রাদি খুব স্নেহ করতেন প্রবীরদাকে। আড়ম্বরহীন এবং রুচিসম্মত সাজানো ফ্ল্যাটটি। বেশ সাদর ও উষ্ণ আপ্যায়ন। প্রবীরদা পরিচয় করাতে যেতেই বললেন, ওকে তো চিনি আমি, মানে লেখা দিয়ে চিনি। তারপরই, “সাংবাদিক পরিচয়টা জানা আছে। সাংস্কৃতিক যোগও। তোমার লেখা পড়ি আমি।” আমি যাকে বলে আপ্লুত, বিগলিত, আরও কি কি, জানি না।
এরপর আমাদের নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে কাজ। দিনটা সত্যিই ভোলার নয়। যে কবিতাটি (পরে গান) ওঁর জন্য রাখা হয়েছিল, সেটি ‘দারুণ অগ্নিবানে’, গানরূপে ওঁর কণ্ঠে প্রবল জনপ্রিয় ছিল। জানতে চেয়েছিলেন, কেন এই গান, আর কেন তার আবৃত্তি-রূপ ! জবাবে সন্তুষ্ঠ হওয়ার পরই রেকর্ডিং করতে রাজি হলেন। রূপ, গুণ ও ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ তো ছিলই। এদিন কাছ থেকে এক পরম স্নেহময়ীকে দেখলাম। কথা বলার ভঙ্গিটি কোমল। কিন্তু, হাঁটাচলা, বসা ও দাঁড়ানো একেবারে শিরদাঁড়া সোজা করে। মনে পড়ছিল, গননাট্য আন্দোলনের শরিক হওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে রবীন্দ্রদর্শনের অপরূপ মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। আর এই সব নিয়েই অতুলনীয় তিনি।
রেকর্ডিং হলো। চা-বিস্কুট-কুকিজ-মিষ্টি ভক্ষণ আর প্রচুর আড্ডা। সুচিত্রাদির অমল সান্নিধ্য–আহা, এর থেকে অমূল্য প্রাপ্তি আর কি হয় ! ওঁর মুড, রসবোধ এসবের পরিচয়ও এর-তার গল্পে জানা ছিল। এদিন তারও অভিজ্ঞতা হলো। সেদিনের কাজ শেষ হওয়ার পর, একটি এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউয়ের আবদার করেছিলাম। বললেন,”আমি তো এখন ঝরাপাতার দলে। তবু, কথা বলতে পারি একটা শর্তে !” কি সেই শর্ত, ওঁর বাড়িতে এক সন্ধ্যায় আমার নিজের বাড়ি (কসবা অঞ্চলে ) থেকে হেঁটে পৌঁছতে হবে। সারারাত আড্ডা। তখনই ইন্টারভিউ। শর্ত রাখা সম্ভব হয়নি নানা কারণে। ওঁর চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই আক্ষেপ যায়নি, যাবে না।
সবশেষে, নিজের জীবনে একলা চলতে শিখেছি মুষ্টিমেয় যাঁদের দেখে, উনি সেই তালিকার প্রথমেই থাকবেন। কি অপূর্ব, কি মহিমময় সেই একলা চলার ছন্দ ! অজস্র গানে, জীবনযাপনে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে গেছেন তিনি।
★★ ছবি : গুগল