Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

মনুষ্যত্বের পাঠও মেলে তাঁর রচনায়

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবস পালন উপলক্ষে প্রকাশিত হচ্ছে  ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। আজ লোপামুদ্রা মিত্র।আলোচনা অজন্তা সিনহা

সাংবাদিকতার সূত্রেই আমার পরিচয় লোপামুদ্রা মিত্রর  সঙ্গে। একটি চ্যানেলের জন্য কখনও সাক্ষাৎকার, কখনও তাদের বিশেষ কোনও অনুষ্ঠানের জন্য–বার বার যোগাযোগ হয়েছে আমাদের। আমি যে সংবাদপত্রে কাজ করতাম, সেই সংবাদপত্রেও তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি একাধিকবার। এছাড়া সেখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এসেছেন তিনি। শুরু থেকেই এক স্বতন্ত্র গায়নভঙ্গি নিয়ে পেশাদারি সঙ্গীতজগতে পা রাখেন লোপামুদ্রা। সেই ভঙ্গি লোপামুদ্রার চরিত্রের মতোই বলিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাসী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে খোলা গলায় তাঁর প্রাণবন্ত পরিবেশন শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিজের শহর থেকে ভিন রাজ্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলা গানের শ্রোতা লোপামুদ্রার ভক্ত। তাঁর মতো করে আর কে বলবেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুধাবন ও পরিবেশন প্রসঙ্গে !

একদিকে নতুন ধারার বাংলা গানে যেমন নিজের স্বতন্ত্র ছাপ রেখেছেন লোপা, তেমনই রবীন্দ্রসঙ্গীতেও স্বকীয়তা বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। মঞ্চে তাঁর উপস্থাপনা, অনুষ্ঠান প্রেক্ষিতে গান নির্বাচন–এইসবই যেমন আজকের কমার্শিয়াল গানবাজনার অঙ্গ, তেমনই প্রতি অনুষ্ঠানে কী পরিধান করেন তিনি, সেটিও আলাদাভাবে নজর কাড়ে। আদতে চিরন্তন বাঙালি পোশাক শাড়িতেও যে চূড়ান্ত স্মার্ট, উজ্জ্বল, আবেদনময়ী হয়ে ওঠা যায়, লোপার মঞ্চে বা টিভি চ্যানেলে অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সেটাও লক্ষ্যনীয়। এরই সঙ্গে মাইক্রোফোনের ব্যবহার, সহযোগী যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে তাঁর আদানপ্রদান, শ্রোতা দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন–লোপা এককথায় পেশাদারিত্বের চরম দৃষ্টান্ত। এতকিছুর পরও কেউ বলতে পারবেন না, গান গাইবার ক্ষেত্রে কোথাও এতটুকু ত্রুটি, অবহেলা বা অযত্ন করেন তিনি। তাঁর প্রশিক্ষণ, চর্চা, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার বিশুদ্ধতা প্রশ্নাতীত।

এবার লোপামুদ্রার নিজের মুখেই শোনা যাক তাঁর অনুভবের কথা,”রবীন্দ্রসংগীত এমন একটি বিষয়, যা একইসঙ্গে চিরকালীন ও আধুনিক। আমরা যারা গানবাজনা করি, তারা তো রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেই বেঁচে আছি। রবীন্দ্রসংগীত তৈরি হয়েছিল বলেই  বাংলা গানের ইন্ডাস্ট্রি এইরকম একটা জায়গায় পৌঁছেছে।” এই আনুগত্য, এই নিবেদন, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঘিরে তাঁর অন্তহীন শ্রদ্ধা পরের প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যেও প্রত্যাশা করেন লোপা। “রবীন্দ্রনাথ তো শুধু একজন স্রষ্টা নন, তিনি আমাদের আশ্রয়, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, বাঁচার রসদ”–জানান তিনি। এই যে উপলব্ধি, এও তো একজন শিল্পীর পাথেয়। আর গাইতে শুরু করা মাত্রই এই উপলব্ধি হওয়া সম্ভব নয়। একজন শিল্পীর উত্তরণে পৌঁছনোর জন্য তাই সময়টা দিতেই হয়। এটা রাতারাতি ঘটে না। নতুনদের এটাই পরামর্শ লোপার–বিশ্বাস ও অনুভবে ধৈর্য ধরে সাধনা ও চর্চার পথে এগিয়ে যেতে হবে। 

“আজকের সময়ে পৃথিবীটা এতটাই ছোট হয়ে এসেছে, যে সারা পৃথিবীর গানবাজনা আমরা শুনতে পাচ্ছি। আজকের যুগের ছেলেমেয়েরা, যারা ইংরেজি গানবাজনা ছাড়া জানেইনা প্রায়, তারা শুধু রিদম বোঝে, নাচ বোঝে–সেই একটা সময়ে দাঁড়িয়েও একমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত”–জানালেন লোপা। এটাও যোগ করলেন,”রবীন্দ্রসঙ্গীত এতটাই আধুনিক যে তাঁকে নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সম্ভব ! গানেই এমন উপাদান আছে, যেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সব গান নয়। নিজের কাছেও সেটা একটা বিবেচনার যে, কোন গানটা নিয়ে আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো, আর কোনটা নিয়ে করবো না। কেমনভাবে করবো, সেটাও বোঝার আছে !” বলা বাহুল্য, এটাই একজন পরিণতমনস্ক শিল্পীর অনুধাবন, যা পর প্রজন্মের ক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষনীয়।

একটি অত্যন্ত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন লোপামুদ্রা এই আলোচনা প্রেক্ষিতে–”যেভাবেই গাই, প্রথাগত পদ্ধতিতে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে–মনে রাখা জরুরি, যে সাফল্য আমরা অর্জন করি, তার কৃতিত্ব এই গানের। এখানে ‘আমি সফল’ বলার থেকেও সেই সৃষ্টিকে সফল বলাই অধিক উপযোগী।” তাঁর বক্তব্য, শুধু তো গান নয়, কেউ যদি শুধু গানগুলো পড়ে, মনুষ্যত্বেরও একটা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছতে পারবে সে। মানুষের গোটা জীবনের ওঠাপড়া, ভালোমন্দ–সব ওই গানের মধ্যে আছে। গানগুলো পড়লেই সব প্রশ্নের উত্তর মেলে। নিষ্ঠুর এক সময়ের হাত ধরে চলেছি আমরা। যখন কেউ কারও জন্য ভাবে না। শুধু নিজেকে নিয়ে এগিয়ে চলে। চূড়ায় উঠতে চাইছি শুধু। সবাই খুব একা। আজ তাই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবচেয়ে বড় সঙ্গী।