Thursday, March 13, 2025
ওয়েব-Wave

সরতাজ থেকে সমরপ্রতাপ – ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অপরিহার্য সইফ

বিনোদন বাণিজ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের শুরুয়াত এবং ক্রম আধিপত্য যেমন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমনই এই প্ল্যাটফর্মকে ঘিরেই নতুনরা তো আছেনই–বাংলা ও হিন্দি সিনেমা-টেলিভিশনের বহু চেনা অভিনেতা, পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটার, ক্রু মেম্বার প্রমুখকে একেবারে নতুন রূপে ও কুশলতায় দেখতে পাচ্ছে দর্শক। বলিউডের ছোটে নবাব থুড়ি সইফ আলি খান এমনই একজন অভিনেতা। ‘সেক্রেড গেমস’ থেকে ‘তান্ডব’–ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিজের অপরিহার্যতা প্রমান করেছেন সইফ। যদিও, অভিনয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি আগেই। ‘ওমকারা’-র ল্যাংড়া ত্যাগি সইফের সেরা অভিনয়ের একটি শুধু নয়, তাঁর কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এছাড়াও ‘বিয়িং সাইরাস’, ‘এক হাসিনা থি’, ‘কুরবান’, ‘ককটেল’, ‘দিল চাহতা হ্যায়’ ইত্যাদি ছবিতে নিজের অভিনয়ের স্বতন্ত্র ছাপ রেখেছেন সইফ। এরই সঙ্গে রয়েছে অজস্র হিট মশালা ছবি, যেগুলো ছাড়া বি টাউনে টিকে থাকা অসম্ভব।

Images 9 2

মা ঠাকুরবাড়ির কন্যা শর্মিলা ঠাকুর একদা বাংলা ও মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঝড় তোলা নায়িকা–আজও যখনই পর্দায় আসেন তিনি প্রতিভা, মেধা ও আভিজাত্যের বিদ্যুৎ ঝলক দেখতে পায় দর্শক। বাবা মনসুর আলি খান, ভারতের ক্রিকেটদলের প্রাক্তন অধিনায়ক, পতৌদির নবাব। ক্রিকেট নয়, মায়ের ধারা মেনে অভিনয়কেই বেছে নেন ছোটে নবাব। যদিও তাঁর শুরুটা খুব বর্ণময় ছিল না। লোকজন সেভাবে গুরুত্বই দিতে রাজি ছিল না সইফকে। ডেবিউ ছবি যশরাজদের মতো বড় ব্যানারের ‘পরম্পরা’। তাতে হিন্দি ছবির দর্শক সেভাবে পছন্দ করেনি তাঁকে। কয়েকটি ছবির পর প্রথম উল্লেখযোগ্য হিট ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’। অভিনেতা হিসেবে প্রথম পৃথকভাবে নজর কাড়েন ‘দিল চাহতা হ্যায়’ ও ‘কাল হো না হো’ ছবিতে। এরপর হিট-ফ্লপ মিলিয়ে মিশিয়ে চলেছে সইফের কেরিয়ার। দক্ষ অভিনেতা হিসেবে সইফকে প্রথম একটি ভিন্ন জায়গা দেয় বিশাল ভরদ্বাজের ‘ওমকারা’। ‘বিয়িং সাইরাস’ তো খুবই সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা একটি ছবি। সেসময়ের দর্শক সেভাবে দেখেনি এই ছবি। আজ তৈরি হলে হয়তো দেখতো। 

‘ওমকারা’-র অনেকদিন পর সেই বুদ্ধিদীপ্ত সহজাত ক্ষমতার অধিকারী অভিনেতা সইফকে খুঁজে পাওয়া গেল ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। ‘সেক্রেড গেমস’ এদেশে ওটিটি জমানার শুরুর দিকের সিরিজ। নেটফ্লিক্স তখন সবে লোকের মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে। নেটফ্লিক্স-এর ওরিজিনাল হিন্দি ক্রাইম থ্রিলার সিরিজ ‘সেক্রেড গেমস’ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় দর্শকের বিনোদনসঙ্গীতে পরিণত হয়। ওটিটি দর্শক, বিশেষত জেন ওয়াই গোগ্রাসে গিলতে থাকে পর্বগুলি। সইফকে একেবারে নতুনভাবে আবিষ্কার করি আমরা। বিক্রম চন্দ্র’র ২০০৬-এর উপন্যাস ‘সেক্রেড গেমস’ একযোগে পরিচালনা করেন অনুরাগ কাশ্যপ ও বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানি। নাট্যরূপ দেন বরুণ গ্রোভার, স্মিতা সিং, বসন্ত নাথ। অর্থাৎ, একদল প্রতিভাবান ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের মস্তিষ্কের ফসল এই সিরিজ।

Images 10 2

সরতাজ সিং নামের পুলিশ অফিসারটির চরিত্রে সইফকে বেছে নিয়ে যে ভুল করেননি অনুরাগ-বিক্রম, তা প্রতি পদক্ষেপে প্রমাণ করেছেন সইফ। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, নীরজ কবি, গিরিশ কুলকার্নি, রাধিকা আপ্তে, পঙ্কজ ত্রিপাঠি, কল্কি কোয়েচলিন, রণবীর শোরে প্রমুখ শক্তিশালী অভিনেতাদের পাশে এতটুকু বেমানান লাগেনি বলিউডের আউট এন্ড আউট মশালা ছবির হিরো সইফকে। দুটি সিজনে প্রদর্শিত এই সিরিজের সিংহভাগ জুড়ে ছিলেন সইফ। সিস্টেমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে করতে বিপর্যস্ত এমনই এক পুলিশ অফিসার সরতাজ। দুর্নীতি, অসাধুতায় ভরপুর প্রশাসন, যেখানে প্রায়ই সর্ষের মধ্যে ভুত দেখে দেখে দিশেহারা হয়েও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে। চরিত্রের এই টানাপোড়েনের ব্যাপারটা নিখুঁত ফুটিয়ে তোলার ফলে দ্রুত ওটিটি দর্শকের হৃদয় জিতে নেন সইফ।

তাঁর নিজেকে ভাঙবার ক্ষমতা যে প্রশ্নাতীত তার প্রমান তিনি পরের হিন্দি সিরিজটিতেও রাখেন। সাম্প্রতিককালে যে সিরিজটি প্রভূত রাজনৈতিক বিতর্কের ফলে বারবার খবরের শিরোনামে উঠে আসে, সেই ‘তান্ডব’-এও মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সইফ। আমাজন প্রাইম ভিডিওতে প্রদর্শিত পলিটিক্যাল থ্রিলার ‘তান্ডব’-এ উঠে এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতি, রাজনৈতিক ডামাডোল ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ! বলা বাহুল্য এই হস্তক্ষেপও রাজনীতি বহির্ভূত নয়। এছাড়াও ‘তান্ডব’ দেখিয়েছে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত কৃষক আন্দোলনের ছায়া। ‘তান্ডব’ কার্যতই তান্ডব তোলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। সেন্সরের কড়া কাঁচি নির্মমভাবে চলে মেকিংয়ের সর্বত্র। শর্ত না মানলে আলোর মুখ দেখবে না ‘তান্ডব’, এই অবস্থায় সমঝোতা করতেই হয় প্রযোজক-পরিচালক আলি আব্বাস জাফরকে। আলির এটা ডিজিটাল ডেবিউ–যথেষ্ট হাঙ্গামা পোহাবার পর ‘তান্ডব’ এ বছর জানুয়ারিতে মুক্তি পায়। কাটাছেঁড়ার পর তার চেহারা কী দাঁড়াতে পারে, সহজেই অনুমেয়। ‘তান্ডব’-এ সইফের সঙ্গে আছেন সুনীল গ্রোভার, ডিম্পল কাপাডিয়া, তিগমাংশু ধুলিয়া, দিনো মোরিয়া, অনুপ সোনি প্রমুখ। স্ক্রিনপ্লে গৌরব সোলাঙ্কি।

তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ সামলেছেন এহেন দেবকীনন্দন সিংয়ের ছেলে সমরপ্রতাপ সিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সইফ। আদ্যন্ত রাজনৈতিক এক চরিত্র, যেখানে রাজনীতির সাদা-কালো-ধূসর সব রংই বর্তমান। মূলত রাজনৈতিক এই থ্রিলারের শুরুতেই সইফের অভিনয়ের তান্ডব দেখেন দর্শক। সেন্সরের কাটাছেঁড়ার পরেও যা রীতিমতো প্রভাবিত করে দর্শককে। বাবাকে গোপনে বিষ খাইয়ে খুন করার মধ্য দিয়ে সমরের মসনদে বসার স্বপ্নপূরণ-যাত্রা শুরু। শুরু সইফেরও আরও এক নতুন চ্যালেঞ্জের। একটি ছোট্ট মুহূর্ত, বাবাকে খুন করছে ছেলে–ক্ষমতার লোভ, উচ্চাশা, বাবার সঙ্গে তার বরাবরের মতবিরোধ–সইফ নিজেকে অপরিহার্য প্রমান করেন। তারপর পর্বে পর্বে সেই অপরিহার্যতা দৃশ্যমান হয়, যা এখনও চলমান।

তারকা বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে কেরিয়ার শুরু করাটা বলিউডে নতুন নয়। কিন্তু সইফ যখনই সুযোগ পেয়েছেন, প্রমান করেছেন, তিনি নিছক তারকাপুত্রের পরিচয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখেননি। ওটিটি প্ল্যাটফর্মও তাঁর মতো আরও অনেককেই স্থান দিয়েছে। সবাই কিন্তু প্রশংসা আদায় করতে পারেননি। অভিনয় এমন এক শিল্পকলা, যেখানে কোনও ব্যাকরণই শেষ কথা বলতে পারে না। শেখাটা এখানে একটা আজন্মের চলা–যাঁরা এই চলমান ব্যাকরণে বিশ্বাসী, সইফ তাঁদের দলেই পড়েন। একজন সুপারস্টার হয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। তাই তো ওটিটি দর্শক সরতাজ বা সমরপ্রতাপের মতো চরিত্রে তাঁকে পেয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম।