সাগর ডাকে…
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। আজ পাঠকের দরবারে ওড়িশার সমুদ্রসৈকত গোপালপুর। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
আমি মূলত সোলো ট্রাভেলার, অর্থাৎ একা একা ঘুরে বেড়াতেই পছন্দ করি। তবে, কখনও কখনও অনুরোধে ঢেঁকি গিলে বন্ধুবান্ধব, পরিচিত বা পরিবারের সঙ্গেও গেছি হেথা-হোথা। আমার গোপালপুর যাওয়ার টিমটা ছিল বেশ বিচিত্র–আমি, আমার মা, আমার কন্যা ও ভাইপো। বিচিত্র এইজন্যই, চারজনের এই টিমে না বয়স, না ভাবনার জগৎ–কোথাও কোনও মিলের ব্যাপার ছিল না। তবু আমরা জোট বাঁধলাম এবং বেরিয়ে পড়লাম। প্রায় রাতভোরে হাওড়া স্টেশন থেকে এক সুপার ফাস্ট ট্রেনে চেপে পৌঁছে গেলাম ওড়িশার বেরহামপুর স্টেশনে, ততক্ষণে সকালের সূর্য আলো ছড়াতে শুরু করেছে। আমরা লটবহর নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। যে হোটেলে থাকবো, আগাম ব্যবস্থামতো তারাই গাড়ি পাঠিয়েছে।
ট্রেনে আসার পথে জানালা দিয়ে এক ঝলক চিল্কা দেখেছি। বিশ্ব বিখ্যাত এই প্রাকৃতিক হ্রদের স্বচ্ছ জলে শরতের ঝকঝকে নীল আকাশ ছায়া ফেলে এক অবর্ণনীয় রূপ ধারণ করেছে। ট্রেন এই সময়টায় বেশ ধীর গতিতে চলছিল। ফলে, চিল্কার রূপসুধা পানের অভিজ্ঞতা দীর্ঘায়িত হলো। চিল্কায় আজ থেকে বহু বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। সেও মনোরম স্মৃতি হয়ে আছে। তা সত্বেও ট্রেনের জানালা দিয়ে চিল্কার মোহময় রূপ দেখাটা এক বিশেষ প্রাপ্তি হয়ে রইলো। আমাদের বুকিং ছিল ‘সং অফ দ্য সি’ হোটেলে। মাঝারি মানের হোটেল। কিন্তু খুব তৃপ্তিদায়ক হয়েছিল থাকার অভিজ্ঞতা। বিচের একেবারে কাছে দোতলায় সমূদ্রমুখী ঘর, সামনেই একটি ছোট্ট সুন্দর টেরেস। এখানে বসে, সমুদ্র দেখে প্রহর কাটিয়ে দেওয়া যায়। যে কদিন ছিলাম, আক্ষরিক অর্থেই ফাঁক পেলেই এখানে বসে ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে প্রহর গুনেছি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিস্তারে যাওয়ার আগে গোপালপুর সম্পর্কে কিছু অন্য অনুভব। মনে পড়ছে কৈশোরে লুকিয়ে বড়দের পড়ার জন্য নির্ধারিত গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে এবং পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমায় প্রথম ‘গোপালপুর অন সি’ নামটা পাই। সমুদ্র তীরবর্তী পুরী, দীঘা, শংকরপুর, চাঁদিপুরের নাম ততদিনে শোনা হয়ে গেছে। প্রশ্ন জেগেছিল, গোপালপুর এমন সাহেবি কেতায় কেন উচ্চারিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো। তার আগে আরও কিছু কথা। বঙ্গোপসাগরের তীরে, ওড়িশার গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত গোপালপুর। এমনিতে পুরীর সমুদ্রের সঙ্গে সত্যি আমি আর কোনও তীরবর্তী সমুদ্রের তুলনা খুঁজে পাইনি। ওই বিশাল উঁচু ঢেউয়ের পাড়ে আছড়ে পড়া, ওই অপরূপ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ! কিন্তু সি বিচে বড্ড ভিড়, দোকানপাট, লোকজনের পাগলের মতো কেনাকাটা আর প্রতি এক পা চললেই চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া, এটা বড্ড বিরক্তিকর !
গোপালপুর ঠিক এর উল্টো। পর্যটন আকর্ষণের ক্ষেত্রে যাঁরা নির্জনতাপ্রেমী, তাঁরাই গোপালপুরকে বেছে নেন। যদিও, সেই সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আমরা গোপালপুর গিয়ে হোটেলে ভালোই ভিড় পেয়েছিলাম। কিন্তু দীঘা বা পুরীর পর্যটকদের সঙ্গে তাদের অমিল আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার মতো। আদতে গোপালপুর নিজেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ ব্যতিক্রমী। শান্ত, কোলাহল-বিহীন এক তটভূমি। পরিবেশ তুলনায় দূষণমুক্ত বলে, সমুদ্রে আকাশের যে ছায়া পড়ে, তা এক স্বর্গীয় নীল বর্ণের আভায় উদ্ভাসিত। নিরলস মুগ্ধ করে রাখে পর্যটকদের। তার এই স্বতন্ত্রতার জন্যই সম্ভবত এখানে আগত পর্যটকরাও কিছুটা একান্তের ভুবনে ডুবে থাকার অনুপন্থী, যেটা আমার বিশেষভাবে নজরে পড়েছিল।
এবার একটু ইতিহাসের পথে যাওয়া যাক। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী গোপালপুর সি বিচের অধিষ্ঠান ও গুরুত্ব সেই কলিঙ্গ যুগে। তখনই সেখানে বন্দর গড়ে ওঠে। বাণিজ্যিকভাবে এখানে সুবৃহৎ কর্মকাণ্ডও ছিল তখন থেকেই। কাজ চলতো সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। তারপর ইতিহাসের নানা অধ্যায় পার করে, হাত বদলে ব্রিটিশ আমলে আর সব বিষয়ের মতোই এই অঞ্চলেরও কর্তৃত্ব এলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হতে। অঞ্চল অর্থাৎ সমুদ্র তীরবর্তী পোর্টও। গোপালপুরে বিশাল বিশাল ওয়ারহাউজ ও গোডাউন তৈরি হলো, বাণিজ্যের খাতিরে। বলা বাহুল্য, এই কর্মযজ্ঞের সূত্রেই গোপালপুরের শরীরে লাগলো সাহেবি কেতার ছোঁয়া। সাহেবদের মুখে মুখে নাম হয়ে গেল গোপালপুর অন সি। ইতিহাসের চিন্হস্বরূপ আজও মাথা উঁচু করে তীরে দাঁড়িয়ে এখানকার প্রাচীন লাইটহাউসটি।
আমাদের বিচিত্র টিমের কথা এবার একটু বলি। এমনিতে বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। শুধু খাবার টেবিলে, ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার–প্রতিদিনের মেনু ঠিক করতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে যাওয়া। দলে মিলে, বিশেষত পারিবারিক পরিধিতে যাঁরা ট্রিপ করেন, তাঁরা হয়তো এতে অভ্যস্ত। আমার পক্ষে বেশ টেনশনের বিষয় হয়ে দাঁড়াতো ব্যাপারটা। তবে, এও এক অভিজ্ঞতা। পরিবার সহ চলা মানেই, ঘরের বাইরে আবার একটি ঘরে প্রবেশ, এই শিক্ষা পেয়েছিলাম সেবারে ! এই পর্বটুকু বাদ দিলে, বাকি সবটাই বড় সুন্দর। আর তার কৃতিত্ব পুরোটাই গোপালপুরের।
প্রথম দিনটা পৌঁছে, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ইত্যাদি সেরে, ঘরে সেট হতে হতে বিকেল হয়ে যায়। মা আর তাঁর নাতি-নাতনি মিলে পায়ে হেঁটে চলে গেল সি বিচ। রাস্তা ভালো। পরিবেশ নিরাপদ। আমি ব্যবস্থাদি সামলাতে গিয়ে কিছুটা ক্লান্ত। তাই দোতলার টেরেসে বসে চোখ রাখলাম সামনের দৃশ্যপটে। সামনে অস্তগামী সূর্য। এক অনির্বচনীয় দৃশ্য রচিত হতে দেখছি চোখের সামনে। আকাশের নীলে, গোধূলী মিলে রঙের যে চিত্রবিচিত্র রূপ অঙ্কিত হচ্ছে, সে শুধু প্রকৃতিই পারে। আমার কাছে প্রকৃতিই ঈশ্বর। পাঠক আপনি চাইলে, এই পুরো দৃশ্যপটকে ঈশ্বর চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই পারেন। এমন ক্যানভাস ব্রহ্মান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী ছাড়া আর কে তৈরি করবেন! মোহ কাটতে কাটতে সন্ধ্যা নামে। আলো জ্বলে উঠতেই অভিমানী সমুদ্র অন্ধকারে মুখ লুকোয়। শুধু হালকা সুরে যেন কোনও প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রের গম্ভীর ধ্বনি–শোনা যায় বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ। পাখিরা আগেই ঘরে ফিরেছে। আমার সহযাত্রীরাও হোটেলে ফেরে। এবার চায়ের পালা।
ডিনারের পর আরও একবার টেরেসে বসি। সামনে অন্ধকার সমুদ্র। চারপাশে যত শব্দরা কমে আসে, তত ঢেউয়ের মর্মর ধ্বনি জোরালো হয়। ঢেউয়ের দল যে সমুদ্রসৈকতের সঙ্গে কথা বলে, খেলা করে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে স্পষ্ট ধরা দিতে থাকে সেই কলকাকলি। মন ভালো করা সেই অনুভব নিয়ে পাড়ি দিই ঘুমের দেশে। পরদিন ঘুম ভাঙতেই এক ছুটে টেরেসে। তখনও সূর্যের উদয় হয়নি। সামনের আকাশ লাল হয়ে তার আগমনের সংবাদ জানান দিচ্ছে। বিচে অল্প কয়েকজন হাঁটাচলা করছেন। হঠাৎই দেখি আর্মির পোশাক পরা একদল তরুণ। তাঁরা দৌড়চ্ছেন, দাঁড়িয়ে কসরৎ করছেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এঁরা আর্মি এয়ার ডিফেন্স কলেজের (AADC) ছাত্র। এই আর্মি এয়ার ডিফেন্স কর্পস অফ ইন্ডিয়ান আর্মির ট্রেনিং একাডেমি গোপালপুর মিলিটারি স্টেশনে অবস্থিত। সূর্য পুরোপুরি উঠে রোদ্দুর ছড়ানোর আগে পর্যন্ত একাডেমির ছাত্রদের দেখি। এবার ঘরে গিয়ে তৈরি হবো, আজ ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়া। গন্তব্য তপ্তপানি ও আরও দু’একটি জায়গা।
তপ্তপানির খ্যাতি এখানকার উষ্ণ প্রস্রবণ অর্থাৎ প্রাকৃতিক ঝর্নার জন্য। এই ঝর্নার জলে সালফার মিশ্রিত থাকার ফলে একে ওষধি গুণসম্পন্ন বলা হয়। সারা দেশের মানুষ দূর দূরান্ত থেকে এখানে আসেন। ঝর্না থেকে জল পড়ে একটি জলাশয়ে জমা হয়। সেই জল সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে নানা রোগব্যাধি নিরাময়ে। তপ্তপানিকে ঘিরে একটি মন্দিরও গড়ে উঠেছে। দেখলেই বোঝা যায় অতি প্রাচীন এই মন্দির। মন্দির ঘিরে বিশাল বিশাল প্রবীণ গাছের দল দাঁড়িয়ে। পরিবেশ শান্ত ও সমাহিত। গোপালপুর থেকে তপ্তপানি যেতে মোটামুটি দু’ঘণ্টা সময় লাগে। রাস্তা পিচের, কোথাও কোনও খানাখন্দ নেই। আমি বহুবছর আগের কথা বলছি। এরপরও একবার পুরী থেকে কোনারক গিয়েছিলাম অটো রিকশায়। চমৎকার রাস্তা। ওড়িশা সরকার পর্যটনকে কী পরিমাণ গুরুত্ব দেয়, অনুধাবন করেছিলাম।
পাশেই এক অভয়ারণ্য এবং তার লাগোয়া গেস্ট হাউস। ওড়িশা ট্যুরিজমের না ফরেস্ট বিভাগের, আজ আর মনে নেই। তবে, ওড়িশা সরকার অধীনস্থ, সেটা মনে আছে। যাই হোক, আগে থেকেই ঠিক ছিল, গেস্ট হাউসের রেস্তোরাঁতেই লাঞ্চ করবো আমরা। খুব পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর ব্যবস্থা। আজও মনে আছে এখানকার দুর্দান্ত রান্না রীতিমতো চেটেপুটে খেয়েছিলাম আমরা। জঙ্গলটি খুব বেশি ঘুরে দেখার সুযোগ ছিল না। বিকেলের মধ্যে গোপালপুর ফিরতে হবে। তার মধ্যেই এক পাল নানা বয়েসী হরিণের সঙ্গে দেখা। জালে ঘেরা প্রাঙ্গনের ভিতরে বিচরণশীল তারা। এদিক ওদিক ইতিউতি চেয়ে নিজেদের মতো লাফিয়ে, চড়ে বেরিয়ে, বেশ খুশি হরিণের দল। আর দেখলাম দারুন এক গাছবাড়ি। মন ভালো করা এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ঢলে পড়া দুপুরের রোদে চারপাশের দৃশ্যপট কেমন অলস, আবেশময়। দূরে উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি। সারি সারি দাঁড়িয়ে গাছেরাও। গাছের গায়ে পাহাড়ের ছায়া, বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তরে পাহাড়, গাছ–সব কিছুরই ছায়া পড়েছে। এসবই দিবাশেষের ইঙ্গিত। ড্রাইভার পথ খালি পেয়ে গাড়ির গতি দ্রুত করে। আমরা গোপালপুর ফিরি।
সকলেই বেশ ক্লান্ত ছিল। ফ্রেশ হয়ে আমি টেরেসে। বাকিরা গেল সি বিচে। আমি এই অবকাশে চা পান করতে করতে সময়াভাবে আরও যেটা দেখা হলো না তপ্তপানির কাছেই, তার কথা বলি। একটি ট্যুরিস্ট দলের কাছে জেনেছিলাম, ওড়িশা সরকার ওখানে একটি মডেল ভিলেজ তৈরি করেছে, যেখানে বসবাস করেন এক আদিবাসী সম্প্রদায়। এঁরা এখনও নিজেদের পুরোনো যাবতীয় রীতি-রেওয়াজ মেনে চলেন। তাঁদের জীবনচর্চায় তাঁরা বাইরের ছোঁয়া লাগতে দেননি। স্বাভাবিকভাবেই এই মানুষগুলোর যাপনকলা দেখাটাই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যা ঘটনাচক্রে সেবার আর হলো না আমাদের।
পরদিন সকালে উঠেই প্রথমে সি বিচে। সামনে আসার পর মুগ্ধতা বেড়ে গেল বহুগুণ। নির্জনতা গায়ে মেখে শুয়ে আছে বেলাভূমি। আর ঢেউয়ের রাশি হালকা চালে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। সমুদ্রের জলের এমন রঙ বঙ্গোপসাগরের আর কোনও সৈকতে দেখতে পাইনি সে তো আগেই বলেছি। এখন সামনে দাঁড়িয়ে যেন বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটু একটু করে পূব আকাশে দেখা দিচ্ছেন সূর্যদেব। লোকজন বাড়ছে এক-দু’জন করে। আর্মির ছাত্রদলও এসে পড়ে তাঁদের রুটিন মাফিক। আমি পায়ে পায়ে হোটেলে ফিরি। এদিন লাঞ্চের পর আমরা গেলাম তারা তারিণী টেম্পল দেখতে। গোপালপুর থেকে ঘন্টাখানেক পথ। এলাকার নাম কেন্দ্রপারা। পাহাড়ের ওপরে মন্দির। পাহাড়ের নাম কুমারী পাহাড়। একেবারে দোরগোড়ায় গাড়ি চলে যায়। তাই কষ্ট নেই। অনেকটা ওপর থেকে দেখা যায় বহতা রশিকুল্যা নদীকে।
দেশের বিখ্যাত ৫১ পীঠের অন্যতম এই শক্তিপীঠ দর্শনে স্বাভাবিক ভাবেই আমার মা ছিলেন সবচেয়ে খুশি। প্রসঙ্গত, আমি আর আমার ভাইপো বাবু একদিকে। আমাদের পুজোআচ্চায় তেমন আগ্রহ নেই। মা এবং কন্যা পৌঁছেই পুজোর আয়োজনে লেগে পড়লো। আমি আর ভাইপো নিজেদের মতো ঘোরাঘুরি করলাম। দেখলাম মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্যকলা। ওড়িশা হলো মন্দির অধ্যুষিত একটি রাজ্য। আর প্রতিটি মন্দিরের স্থাপত্যে যে কারুকাজ চোখে পড়ে, তা বলে দেয়, অঞ্চলের প্রাচীন মন্দির-শিল্পীদের অনিন্দ্য শিল্পগুণ সম্পর্কে। এখানটায় সঙ্গত কারণেই জনতার ভিড় খুব বেশি। তবে, পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত সুশৃঙ্খলিত। মানুষের মেলায় বাঁদরের বাড়বাড়ন্তও দেখলাম। একেবারে খুদে থেকে ধেঁড়ে, সকলেই দিব্যি খেয়েদেয়ে, ঘুরেফিরে আছেন।
ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়ালো। ক্লান্ত সকলেই। ফ্রেশ হয়ে চা, সঙ্গে পকোড়া। এঁদের ডাইনিং রুমটি বেশ খোলামেলা। বড় বড় জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের অন্ধকার আর সমুদ্রের মৃদু ঢেউয়ের গান একসঙ্গে মরমে প্রবেশ করে। বিদায়কাল সমাগত। কালই কলকাতা ফেরা। সন্ধ্যাটা খুচরো আড্ডায় কাটে। ডিনার করে ঘরে ফিরি। কিছুক্ষণ টেরেসে বসি। তারপর বিছানায়। ঘুমোতে যাওয়ার আগে, কিছু তথ্য–ট্রেনে গোপালপুর যাওয়ার জন্য বেরহামপুর স্টেশনে নামতে হবে, শুরুতেই বলেছি। দক্ষিণপূর্ব রেলওয়ের হাওড়া-চেন্নাই গামী বেশ কয়েকটি ট্রেনই এই স্টেশনের ওপর দিয়ে যায়। এগুলোর কোনও একটিতে আপনি যেতে পারেন বেরহামপুর। তবে, ভোরের দিকের ট্রেন ধরলে ভালো। তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলে, বাকি পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়।
কাছাকাছি এয়ারপোর্ট ভুবনেশ্বর। গোপালপুর যেতে ঘন্টা চারেক লাগে। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতেও যাওয়া যায়। তবে, ট্রেন জার্নি তুলনায় আরামদায়ক। ওড়িশা ট্যুরিজমের পান্থনিবাস ছাড়াও প্রচুর বড় ও মাঝারি হোটেল আছে এখানে। আগাম বুকিং করে গেলে নিশ্চিন্ত। পরিষেবার ক্ষেত্রে আমি অন্তত কোনও ত্রুটি পাইনি। একটা কথা বারবার উল্লেখ জরুরি, পর্যটনশিল্প ওড়িশার অর্থনীতিকে কতটা চাঙ্গা করেছে, সকলেরই জানা। এর কারণ আগেও অনুভব করেছি। এখানকার পথঘাট থেকে পর্যটন ব্যবসায়ীদের পরিষেবার মানসিকতা–সবক্ষেত্রেই সেই বিষয়টি প্রতিভাত। গোপালপুর গিয়ে আবারও উপলব্ধি করি। সবচেয়ে বড় কথা, পৌঁছনো এত সহজ, যে, আপনি বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটিকে নিয়েও নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারেন। আর যাঁরা নির্জন সৈকত খুঁজছেন, তাঁদের জন্যও গোপালপুরের বিকল্প হবে না।