অদৃশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা
পৌঁছে গেলাম মেঘমুলুক
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখছেন অজন্তা সিনহা।
আগস্টের মাঝামাঝি, অর্থাৎ পাহাড়ে ঘন বর্ষা। এই সময়টায় নাকি পাহাড়ে যেতে নেই। স্বাভাবিক। উপত্যকায় নদীগুলি ফুলে ফেঁপে বন্যা, আর পাহাড়ে এখানে ওখানে ধ্বস–বারণ তো থাকবেই। বেড়াতে গিয়ে কে আর ঝঞ্ঝাটে পড়তে চায় ! কিন্তু আমার মতো পাহাড়-পাগলকে কে আটকাবে ? নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে আসতেই মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া। ইতিমধ্যেই রিজার্ভ করা গাড়ির ড্রাইভার ফোনে জানিয়েছে, স্টেশনে পৌঁছতে দেরি হবে তার। রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ধ্বস নামার ভয়। সব মিলিয়ে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা।
ডেস্টিনেশন দাওয়াই পানি। নামটা শুনেই মনে হয়েছিল, যেতেই হবে। পরিকল্পনা মতো সারাদিন অফিস করে রাতের ট্রেনে উঠেছি। সেবার স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ১৫ আগস্টের ছুটিটা বেশ গুছিয়ে পড়েছিল। দাওয়াই পানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গল্প শুনে অবধি দেখার জন্য পাগল হয়ে আছি। এদিকে এই দুর্যোগ। কতক্ষণ স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে কে জানে ! অপেক্ষার কাল যখন শেষ হলো, ততক্ষণে আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। ড্রাইভার ছেলেটি কাচুমাচু মুখ করে গাড়িতে লাগেজ তুলছে। আমি তখন খিদে-তৃষ্ণা-ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত। গাড়িতে উঠতে উঠতেই প্রবল বকুনি দিচ্ছি তাকে। হঠাৎই সে বলে ওঠে, “রাগ করবেন না ম্যাডাম। যাওয়ার পথে আপনাকে মংপু ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো। ওই যে রবি ঠাকুরের বাড়ি !”
মুহূর্তে সব রাগ গলে জল। গাড়ি ততক্ষণে শহর ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা এগিয়েছে, বদলে গেছে দৃশ্যপট। সামনের কাচ ঝাপসা। দু’পাশে গাছেদের তুমুল আন্দোলন। আকাশ একেবারে নিরবচ্ছিন্ন ধারাপাতে উত্তাল। খিদে-ক্লান্তি উধাও ! রবি ঠাকুরের বাড়ি দেখতে যাওয়াটা প্ল্যানের বাইরে, তাই নিয়েই চনমনে হয়ে উঠেছি তখন। মংপুর রবীন্দ্রভবনে পৌঁছে দেখি গেটে তালা, স্বাধীনতা দিবসের ছুটি। গাড়ি থেকে নেমে গেট পর্যন্ত পৌঁছতেই একেবারে ভিজে যাই। দারোয়ান ড্রাইভার ভাইয়ের পরিচিত, গেট খোলার ব্যাবস্থা হয়ে যায় সেই সূত্রেই। ভিতরে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কি করবো ভাবছি। খোলা জানালা দিয়ে কথা বলে উঠলেন কেয়ারটেকার ভদ্রলোক। প্রথমে ওঁরও ‘না’–তারপর বোধহয় আমার অবস্থা দেখে মায়া হলো। ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছি। কলকাতা থেকে আসছি শুনেও কিছুটা সদয় হলেন হয়তো।
ভিতরে ঢুকেই রবীন্দ্রনাথের বিরাট এক ছবি। কি মায়াময় দুটি চোখ, যেন সামনে যে দাঁড়িয়ে, তাকেই দেখছেন। সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। পুরো বাড়ি ঘুরে দেখলাম। সর্বত্র আজও তাঁর উপস্থিতি। শোওয়ার খাট থেকে লেখাপড়ার টেবিল-চেয়ার, কলমদানি সবই রবি ঠাকুরের নিজের ডিজাইন করা। এমনকী উপাসনা ঘরটির স্থাপত্য পর্যন্ত রবি-ভাবনায় উদ্ভাসিত। সেটির ভঙ্গুর দশা দেখে মন কেমন করে উঠলো ! আদ্যন্ত সৌখিন মানুষটির শরীরে পাহাড়ের আবহাওয়া তেমন সহ্য হতো না। কিন্তু এখানকার উদার প্রকৃতির ওপর টান ছিল তীব্র। বর্ষাস্নাত মংপুর এই বাড়ির পরতে পরতে আজও যেন ছড়িয়ে আছে সেই প্রকৃতিপ্রেমী, সৃষ্টিশীল মানুষটির ছোঁয়া।
দাওয়াই পানি পৌঁছতে দুপুর গড়ালো। মেঘাচ্ছন্ন গ্রামটি মুহূর্তে আপন করে নিল আমায়। হোমস্টে-র ছোট্ট কাঠের বাড়িটি একেবারে ছবির মতো সুন্দর। পরিচালনায় একটি আঞ্চলিক নেপালি পরিবার। নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত। পৈত্রিক সামান্য জমি ও থাকার ছোট্ট ঘর। মূল বাড়ির একটি অংশকেই কিছুটা পরিবর্ধন ও জরুরি আসবাবপত্রে সাজিয়ে দুটি ঘরের হোমস্টে বানিয়েছেন ওঁরা। দুটি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম আছে। আর আছে একটি লোভনীয় বারান্দা। ড্রাইভার আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর প্রথমেই মনে হলো স্নান করতে হবে। ফ্রেশ হয়ে একেবারে ভাত খাব। তখন আর কিছু নয়, খেয়েই একটা গরম বিছানা চাই। খবর পেলাম রান্না হচ্ছে। একটু দেরি আছে লাঞ্চের। সবে খুলেছেন ওঁরা এই হোমস্টে। এখনও তত প্রস্তুত নন। যাই হোক, স্নান তো করি ! বাথরুমে গিজার নেই। কিন্তু পর্যাপ্ত গরম জলের ব্যাবস্থা ছিল। জমিয়ে স্নান করলাম। শীতপোশাকে আপাদমস্তক মুড়ে ঘরের সামনের কাঠের বারান্দায় এসে বসলাম। সামনে যতদূর চোখ যায় মেঘের আস্তরণ। নানা স্তরে বিন্যস্ত তারা। আক্ষরিক অর্থেই মেঘমুলুকে পৌঁছে গেছি মনে হলো।
একটু পরে লাজুক মুখে এসে দাঁড়ালেন হোমস্টে মালিকের স্ত্রী। হিন্দি আর নেপালি ভাষা মিলিয়ে যা তিনি বললেন, তার বাংলা তর্জমা এই, “বাঙালি রান্না রাঁধতে জানি না। আপনার খেতে বোধহয় কষ্ট হবে !” জবাবে আমি, “আরে দূর, আমার কিছুতেই অসুবিধা নেই। তুমি খাবার নিয়ে এসো।” খাবার এলো, ভাত-ডাল-আলু ভাজা-চিকেন। চিকেনটা একটু শক্ত, এছাড়া সব একদম ঠিক। আসলে কাঠের আঁচে রান্না। চিকেনটা কুকারে করতে হতো, সেসবও অত মাথায় ছিল না বেচারার ! কিন্তু এসব নিতান্তই গৌণ। খিদের মুখে গরম গরম খাবার, আর অপরিসীম আন্তরিকতা, পরিবেশন ভঙ্গিটিও বেশ ভালো। আর কি চাই !
খাওয়াদাওয়া প্রসঙ্গে আর দু’তিনটি কথা বলে দাঁড়ি টানবো। যে তিনদিন ওখানে ছিলাম, প্রচুর বাঙালি রান্নার টিপস দিতে হয়েছে আমায়। আমি অত্যন্ত খারাপ রাঁধুনি হওয়া সত্ত্বেও মহিলার উৎসাহে সাড়া না দিয়ে পারিনি। ওঁরাও অভিজ্ঞতার অভাব পুষিয়ে দেন আন্তরিক সদিচ্ছায়। খাবারের তালিকায় মোটামুটি যা ছিল–ভাত-রুটি, ডাল, সবজি, ভাজা, ডিম, চিকেন। এটা লাঞ্চ ও ডিনারে। সঙ্গে আচার,পাঁপড়, স্যালাড পাওয়া যেত চাইলেই। ব্রেকফাস্ট-এ রুটি-তরকারি বা পুরি-সবজি। সন্ধ্যায় স্ন্যাকস–মূলত পকোড়া, অনুরোধে মোমো। চা-কফি দিনে বার দু’তিনেক। শাকসবজি গ্রামেই ফলে, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। বিশেষত তুলনাহীন রাই শাক আর স্কোয়াশের তরকারি।
লাঞ্চ শেষ হতেই ঝেঁপে বৃষ্টি। চোখ বুজে আসছিল ক্লান্তিতে। ডাবল কম্বল জড়িয়ে পালালাম ঘুমের দেশে। ঘুম ভাঙতেই দেখি চরাচর অন্ধকার। বৃষ্টি থেমেছে। ঝিঁঝিদের কনসার্ট শুরু। গাছের পাতায় জমে থাকা জলের টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ। পরপর কফি-স্ন্যাকস ও ডিনার পর্ব সারার মাঝে গ্রাম নিয়ে কিছু গল্প। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী এলাকার অন্যান্য গ্রামের মতোই দাওয়াই পানির পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত। পানীয় জল স্বাস্থ্যগুণসম্পন্ন। এখানকার জল নিয়ে রয়েছে চমকপ্রদ এক গল্প। আর সেই গল্পের সূত্রেই গ্রামের নাম হয়েছে দাওয়াই পানি।
সেসময় এদেশে ব্রিটিশ শাসন। তাদের তত্ত্বাবধানেই উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলটিতে চা বাগান, সিঙ্কোনা চাষ হয়। ব্রিটিশ সাহেবরা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে ঘুরে কাজকর্ম দেখাশোনা করে। তাদেরই একজনের অভিজ্ঞতা। সেদিন সাহেবের ঘুরতে ঘুরতে বেশ বেলা হয়ে গেছে। রোদ্দুরের তেজ তীব্র হয়েছে ততক্ষণে। ক্লান্ত সাহেব গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছেন। তাঁর পায়ে কোনওভাবে একটি ক্ষত হয়েছে। যেখানে তিনি বসেছেন, তার সামনেই ছিল এক প্রাকৃতিক জলধারা। কথিত আছে, সাহেব ওই জলে পায়ের ক্ষত ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি তাঁর ক্ষত সেরে যায়। অর্থাৎ জলের মধ্যে ওষুধ, মানে পানিতে দাওয়াই মিশে আছে প্রাকৃতিকভাবে। সেই থেকেই গ্রামের নাম হয়ে গেল দাওয়াই পানি।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই পাখিদের কিচিরমিচির ! রীতিমতো ব্যস্ত তারা। শহরে আজকাল আর পাখির ডাক শোনা যায় কই ? এই অঞ্চলটি জঙ্গলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বার্ড ওয়াচারদের স্বর্গ জানতাম। তবে, আমার তো সবই আয়োজনবিহীন আর হঠাৎ পাওয়া। পাখিরা আপনা থেকে এসে বারান্দার রেলিংয়ে বসে। তিড়িংবিড়িং লাফায়। উড়ে যায় সামনের গাছে। আমি তাদের নাম না জানলেও আনন্দ উপভোগে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটে না। তারা স্বেচ্ছায় আমায় আনন্দিত করে যায়। ওদের কান্ড দেখতে দেখতেই গ্রামের দিকে চোখ ফেরাই। সেখানে তখন মানুষের দিনযাপন শুরু হয়ে গেছে। কেউ ঘরের কাজে ব্যস্ত। অনেকেই জঙ্গল থেকে কাঠকুটো ও ডালপাতা কেটে পিঠে চাপিয়ে বাজারে যাচ্ছে বিক্রি করতে। চড়াই-উৎরাই পার হয়ে প্রতিদিনের প্রবল কষ্টের জীবনধারণ। গ্রামের বাচ্চারা পর্যন্ত স্কুলে যায় এভাবেই, ২/৩ ঘন্টার রাস্তা পার করে। তবু, আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে কোনও অসন্তোষ নেই। সবাই সদা হাস্যময়।
পরের দিনও পাখিরাই ডেকে হেঁকে জাগিয়ে দেয় আমায়। আকাশ আজ সামান্য পরিষ্কার। বেশ মন ভালো করা এক সকাল। ঘুরতে বেরোই ব্রেকফাস্ট সেরে। ছোট ছোট ঘরবাড়ি, লাল-সবুজ রং করা কাঠ ও টিনের, সামনে ফুলের বাগান–বড়ই নান্দনিক। গতকাল বিকেলে গ্রামের মহিলাকুল আলাপ করতে এসেছিল আমার সঙ্গে। তাদেরই একজনকে কথা দিয়েছিলাম, আজ তাঁর দোকান দেখতে যাব। গ্রামের একমাত্র দোকান। পুরো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। পাহাড়ে অবশ্য এমনটাই হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল। লোকজনের সুবিধার্থে চাল-ডাল-তেল থেকে ফুলঝাড়ু, শাকসবজি-ডিম, গায়ে মাখার সাবান-মাথার তেল থেকে বালতি-মগ, তোয়ালে-গামছা, জরুরি ওষুধ সবই এক দোকানে মেলে। দোকানী মহিলা বেশ বয়স্ক, কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। চটপটে ও নিপুণ হাতে সামলাচ্ছেন সব। দোকানে বসে নানা গল্প, লজেন্স-বিস্কুটে আপ্যায়িত হয়ে, ছবি তুলে হোমস্টে-তে ফিরি।
ইতিমধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু। আকাশ একেবারে পুরু কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে। অথচ, মেঘ নয়, দেখা হওয়ার কথা ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে। শুনেছিলাম, দুর্দান্ত ভিউ মেলে হোমস্টে-র এই বারান্দা থেকেই। হবেই তো ! আশপাশেই রয়েছে ঘুম স্টেশন, সিটং, বাগোড়া এবং দার্জিলিং। কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের প্রকৃষ্ঠ এক-একটি পয়েন্ট। যদিও আমার ভাগ্যে হলো না তার দর্শন। তার বদলে মেঘেদের বাড়াবাড়ি দেখে পাগল হলাম। বিশ্বাস করুন, এতটুকু আক্ষেপ হয়নি কাঞ্চনজঙ্ঘা অদর্শনের। মেঘ-কুয়াশা-বৃষ্টির এক ভিন্ন পাহাড়ী গাথাকাব্য দেখেছিলাম দাওয়াই পানির ওই কাঠের বারান্দায় বসে।
ফেরার দিন এসে যায়। প্রতিবারই এই সময়টায় বড্ড মন খারাপ হয়ে যেত তখন। পাহাড়ের কোল ছেড়ে কাজের শহরে ফেরা। তখনও উত্তরবঙ্গে পাকাপাকি চলে আসার পরিক্রমা শুরু হয়নি। ভাবনা চলছে। সেই ভাবনা আর আবার তাড়াতাড়ি পাহাড়ে আসবো, এই ব্যাকুলতা সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠি। হালকা লাঞ্চ সেরে নিয়েছি। আকাশ জুড়ে কালো আর ধূসর রঙের ছটা। ক্যানভাসে আঁকা হচ্ছে অপূর্ব এক বহুমাত্রিক ছবি। পথে ড্রাইভার ভাইয়ের আনুকূল্যে ঘুম স্টেশন দেখে নিলাম এক পলক। মেঘ-কুয়াশার আস্তরণ তাকেও ঘিরে রেখেছে। খেলনা ট্রেনের লাইন ধরে ছাতা মাথায় কাজেকম্মে চলেছে মানুষ। গাড়ি রোহিনী হয়ে সমতলমুখী। দেখা হলো বালাসন নদীর সঙ্গে। কিছু পরে শুকনার জঙ্গল। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। বিদায় মেঘমুলুক। ভালো থেকো দাওয়াই পানি।
শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন বা বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট থেকে পেশক রোড ধরে তিস্তা বাজার, জোড়বাংলো হয়ে যেতে হয় দাওয়াই পানি। দার্জিলিং খুব কাছে, মাত্র ২০ কিমি। শুনেছিলাম, ম্যালে দাঁড়িয়ে দাওয়াই পানির ভিউ পাওয়া যায়। আবার দাওয়াই পানি থেকেও দার্জিলিংয়ের তুষারপাত দেখা যায়। আধঘন্টার দূরত্বে লামাহাটা। নির্জনতা দাওয়াই পানির শরীর জুড়ে। জঙ্গল কেটে গ্রাম। তাই চারপাশের পরিবেশে সবুজের অবাধ প্রাচুর্য ।
দাওয়াই পানির উচ্চতা ৬৫০০ ফুট। আবহাওয়া সব সময়ই ঠান্ডা। যাওয়ার জন্য উপযোগী সময় অক্টোবর থেকে মে মাস। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ঠাণ্ডা খুব বেশি। সেই সময় গেলে যথেষ্ট শীতপোশাক সঙ্গে রাখতে হবে। জরুরি ওষুধ, কিছু শুকনো খাবার, টি ব্যাগ, কফির প্যাকেট, জল গরম করার ইলেকট্রিক কেটলি সঙ্গে রাখলে সুবিধা। একটা টর্চ অবশ্যই চাই। শিলিগুড়ি থেকে রিজার্ভ গাড়িভাড়া ৩৫০০ টাকা। টিম করে গেলে সুবিধা। হোমস্টে-তে থাকা-খাওয়ার খরচ দিনপ্রতি জনপ্রতি ১২০০ টাকা। আমি অনেক বছর আগে গিয়েছি। তাই এই রেটগুলি সামান্য বাড়লেও বাড়তে পারে। তখন একটাই হোম স্টে। এখন বেশ কয়েকটি হোম স্টে হয়েছে শুনেছি। বুকিং ও অন্যান্য তথ্যের জন্য খোঁজ করতে পারেন ইন্টারনেটে।
★★ যখনই বেড়াতে যাবেন (নিয়মিত বিভাগ)
🌈 প্যাকিং ফান্ডা
🔺কি কি নিয়ে যাবেন তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলুন চটপট। এটা বেশ কয়েকদিন আগেই করুন। এতে জরুরি ও প্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
🔺ব্যক্তিগত জরুরি জিনিস, টাকাপয়সা, ট্রেন বা ফ্লাইটের টিকিট, হোটেলের বুকিং স্লিপ ইত্যাদি এমন জায়গায় রাখুন যা হাতের কাছে থাকবে অথচ বিশেষ যত্ন-খেয়ালও রাখা যাবে। ক্যামেরা, ল্যাপটপ ব্যাগের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
🔺 ফার্স্ট এড বক্স, সাধারণ জরুরি ওষুধ এবং আপনি নিয়মিত যে ওষুধ খান তা যথাযথ পরিমানে সঙ্গে রাখুন।
🔺 টর্চ-মোম-দেশলাই অবশ্যই রাখতে হবে।
🔺সানগ্লাস, ছাতা ও বর্ষাতি রাখতে পারলে ভালো।
🔺ভাঁজ নয় জামাকাপড় ফোল্ড করে প্যাক করলে কম জায়গায় বেশি পোশাক আঁটবে। আর জামাকাপড়ের ভাঁজও নষ্ট হবে না।
🔺জামাকাপড়-জুতো ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিন কোথায় যাচ্ছেন, সেই অনুসারে। যেমন, পাহাড়-জঙ্গল-সি বিচ যেখানে, সেখানে হিলতোলা জুতো নয়, স্পোর্টস শু জাতীয় হলে ভালো। আর পোশাকও প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। প্রসাধনী ও রূপচর্চার উপকরণও যেটা না হলে নয়, ততটুকুই। মনে রাখুন, বোঝা বাড়ালে পথে চলাফেরায় কষ্ট। শীতের জায়গায় যথেষ্ট শীতপোশাক রাখুন সঙ্গে।
🔺গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে সঙ্গে রাখুন কিছু শুকনো খাবার, টি ব্যাগ, কফি পাউডার, গরমজল করার ইলেকট্রিক কেটলি, কাগজের কাপ ও প্লেট, টিস্যু পেপার।
🌈 যাওয়ার আগে কি কি করবেন
◾যথাসম্ভব জায়গাটা সম্পর্কে আগাম খোঁজখবর নিয়ে নিন। স্পটে গিয়ে কি কি দেখবেন, কিভাবে সময় কাটাবেন, তার একটা ধারণা থাকলে সুবিধা হবে আপনার। বাজেট করা ও প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রেও এটা জরুরি।
◾জেনে নিন, কাছাকাছি এটিএম, প্রয়োজনে ডাক্তারের ব্যবস্থা আছে কিনা। না থাকলে সেই অনুসারে আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
◾চেষ্টা করবেন থাকা-খাওয়া-যাতায়াত-সাইট সিয়িং-শপিং ইত্যাদি খরচাপাতির জন্য একটা নির্দিষ্ট বাজেট করে নেওয়ার।
◾বেড়াতে গিয়ে যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন, তার জন্য আগে থাকতেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
🌈 আগাম বুকিং এবং
এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত দিক। যাঁরা হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়েন, দল বেঁধে বা একা এবং বুকিংয়ের তোয়াক্কা করেন না, তাঁদের জন্য এই বিভাগ নয়। যাঁরা কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাট বেড়ানো পছন্দ করেন, পরিবার পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাঁরা সচরাচর এডভান্স বুকিং না করে যান না। আমি নিজেও সেভাবেই সারা জীবন ঘুরেছি। এই বুকিংয়ের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই এজেন্ট, পাহাড়ের ক্ষেত্রে হোমস্টে মালিক এবং সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে পর্যটকদের নানা বিষয়ে অশান্তির কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে যে সাবধানতা গুলি অবলম্বন করা যেতে পারে—
■ এজেন্ট সম্পর্কে ভালো করে আগে খোঁজ নিন
■পাহাড়ের হোমস্টে মালিকরা এমনিতে সৎ। কিন্তু ততটা পেশাদার এখনও নয়। কথাবার্তা, আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও ওদের কিছুটা সমস্যা আছে। ওদের ক্ষেত্রে বার বার জিজ্ঞেস করে, ভাষার কোনও সমস্যা থাকলে, সেটা কাটিয়ে উঠে, নিজের চাহিদা পূরণের ব্যাপারটা আগে থেকে বুঝে নিন।
■ কোনও কারণে বেড়াতে যাওয়া ক্যান্সেল হলে এডভান্স বুকিংয়ের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না, এটাই নিয়ম। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনার টাকা গচ্ছিত থাকবে ওই এজেন্ট, হোমস্টে মালিকের কাছে এডভান্স হিসেবেই। সেই সময়ের মধ্যে আপনি যেতে পারবেন সেখানে। এই বিষয়টিও বুকিংয়ের সময় পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।
🌈 কি করবেন
◾মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। যেখানে গেছেন, সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে যত বেশি মানিয়ে চলবেন, তত মজা-খুশি-আনন্দ অনন্য প্রাপ্তি হয়ে ধরা দেবে আপনার অভিজ্ঞতায়।
◾যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঘুরুন। এতে জায়গাটির সত্যিকারের এসেন্সটা পাবেন।
◾জেনে নিন এলাকার মানুষের জীবন, তাদের শিল্প-সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ইতিহাস।
🌈 কি করবেন না
◾যত্রতত্র প্লাস্টিক, আবর্জনা ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
◾লক্ষ্য রাখুন আপনার আনন্দ-উল্লাস যেন অপরের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।