অনির্বচনীয় এক যুগলবন্দি
লিখেছেন চয়নিকা বসু
যন্ত্রনায় চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করে সে। চিৎকার পরিণত হয় বোবাকান্নায়। খুশি হলে তার কণ্ঠের আনন্দধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। কিন্তু সেই ধ্বনি পৌঁছয় না আশপাশের মানুষের প্রাণে। না যন্ত্রণা, না আনন্দ–কিছুই বোঝে না তারা। শুধু তার মা…বার বার প্রশ্ন ক’রে, বোঝার চেষ্টা করেন ছেলের খুশি অথবা ব্যাথা। কখনও কখনও তাঁর পক্ষেও কষ্টদায়ক হয় ছেলেকে বোঝা। তবু অন্তহীন চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। ক্লান্তিহীন এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতেই হয় তাঁকে।
চিকিৎসাসূত্রে এক ফিজিওথেরাপি সেন্টারে আসাযাওয়া করেছিলাম কিছুদিন। সেখানেই দেখা ওই মা ও ছেলের সঙ্গে। সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত বছর তেরোর এই কিশোরের চেহারা তার অসুস্থতার কারণেই একেবারে ছোট্ট এক শিশুর মতো। কিন্তু, তা সত্ত্বেও তাকে নাড়াচাড়া করাটা একেবারেই সহজ নয়। নিছক ঘাড় ফেরানোর বাইরে একটি অঙ্গও তুলতে পারে না সে। অর্থাৎ তাকে নাড়াচাড়া করার জন্য সবসময় একজন সাহায্যকারী চাই। দেখেছি, সেন্টারের কর্মীরা কাছে না থাকলে, সেই কঠিন কাজটি তার মা-ই করেন। ছেলেকে পাশ ফেরানো, তার কী চাই, সেটা বোঝা, সেই অনুযায়ী সাহায্য করা–এসব চলতেই থাকে। এর মধ্যে জল খাওয়া, টয়লেট ইত্যাদি পর্বও আছে।
ছেলেটির থেরাপি চলে সেন্টারের নির্দিষ্ট বেডে। থেরাপি চলাকালীন তার মা প্রায়ই সেন্টারের কর্মীদের সঙ্গে হাত লাগান। দেখেছি, ছেলের সৌজন্যেই থেরাপির জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিব্যি চালাতে শিখে গেছেন এই তরুণী। শিখতে হয় আসলে। যেমন করে ছেলের জন্ম থেকেই কঠিনতাকে সঙ্গী করে তাকে বড় করতে শিখে গেছেন। এই বড় করা বা পালন করার ব্যাপারটা সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় কতখানি আলাদা, তা পাঠককে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না। প্রসঙ্গত, স্পেশাল চাইল্ড বলে যতই গালভারি আখ্যা দিই না কেন আমরা। আসলে তো মূল স্রোতের বাইরেই থেকে যায় ওরা। ওরা এবং ওদের মায়েরা। কদাচিৎ বাবারা।
যেহেতু চিরন্তন রীতি অনুসারে ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব মায়েরই। আর সে যদি তথাকথিত স্বাভাবিক না হয়, তবে দায়িত্বের ভার আরও বেশি। এছাড়া এই জাতীয় শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারের অন্যদের ছোটবড় অসুবিধাজনিত অভিযোগের তিরটাও তাঁর প্রতিই তাক করা থাকে। কারণ তিনি জন্মদাত্রী।
আমি যখনই এই মাকে দেখি, মনে মনে বারবার কুর্নিশ জানাই তাঁকে। ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে আলাপ। সেই সূত্রেই জানতে পারি, বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখানোর একটি স্কুল চালান তিনি বাড়িতে। বাকি সময়ের পুরোটাই গৃহকর্ম। আর যাবতীয় রুটিনের সমান্তরাল আবর্তন তাঁর ছেলেকে ঘিরে। ছেলের হুইল চেয়ারের সুর ও ছন্দে চলমান এই মায়ের জীবন। উদয়াস্ত সে এক অমানুষিক পরিশ্রম। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর চেহারাতেও সেই ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু, মুখের হাসিটুকু অম্লান। জীবনের সঙ্গে সমঝোতা করে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু বিরক্তি বা আক্ষেপ নিয়ে নয়। এই যে, ছেলের সঙ্গে তাঁর জীবনও এক খাঁচায় বন্দি পাখির মতো। তবু, দুঃখ-হতাশা কখনও যেন গ্রাস করে না তাঁকে।
অনুভবে বুঝি, ছেলের বেঁচে থাকার যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকেই নিজের বাঁচার অবলম্বন করে নিয়েছেন এই মা। ছেলের সঙ্গেই তাঁর গল্প, খেলা, খুশি ও আনন্দের যাপন। সেন্টারের বরাদ্দ এক-দেড় ঘন্টা সময়ের মধ্যে আমিও সুযোগ পেলেই মা-ছেলের এই অপরূপ আনন্দ-বেদনার যুগলবন্দি দেখি ও শুনি। আমরা যারা তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনছন্দে চলি, তাদের কত অভাব, আক্ষেপ, অভিযোগ ! ছেলেমেয়েদের জীবনও একটা সময়ের পর স্বাধীন ও ভিন্ন অভিমুখে চলমান। দূরত্ব সেখানে এক অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এই ছেলের সে উপায় নেই। এই মায়েরও দায়িত্বমুক্ত হওয়ার অবকাশ নেই। সেই জন্যই ওরা একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেখানে সব না বলা কথা শোনা হয়ে যায়। নিবিড় নীরবতা গভীর কথকতা হয়ে ওঠে এখানে। আমি শেষবেলায় যাবার সময় এই সবই লুটেপুটে নিই। ভরে নিই জীবনের সিন্দুকে।
ছবি : প্রতীকী