Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

অবশেষে দার্জিলিং

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। বাঙালির চিরচেনা দার্জিলিং নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা

উত্তরবঙ্গে আমার আসাযাওয়া প্রায় দু দশক ধরে। পাকাপাকি থাকা শুরু বছর দুয়েক। পাহাড়ের টান, বিশেষত উত্তরবঙ্গ, সেটাও এতটাই যে জন্মকর্মের শহর ছেড়ে, একেবারে শিকড় উপরে পাকাপাকি এখানেই চলে আসা ! এরপরও যদি কেউ বলে এখনও দার্জিলিং যাইনি, তাহলে সেটা হজম না হওয়ারই কথা। বন্ধু ও চেনাজানা লোকজনের এহেন অবাক প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমার ক্ষেত্রে প্রায় রুটিনে দাঁড়িয়েছিল একটা সময়। অথচ দার্জিলিং যাব না, তেমন কোনও কঠিন প্রতিজ্ঞা যে আমার ছিল সেটাও নয়। একটা ভয় অবশ্য ছিল–দার্জিলিং, দিঘা আর পুরী বাঙালির কমন ইন্টারেস্ট। যার মানে প্রচুর জনসমাগম। মিথ্যে বলবো না, এই ভিড় ব্যাপারটা নিয়েই যা কিছু দ্বিধা, সংশয়।

Img 20220921 Wa0038
অবশেষে দার্জিলিং 20

দার্জিলিং এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা। টাইগার হিল থেকে সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন, সূর্যের উদয় ও অস্তকালে, সেও তো এক মহিমময় অভিজ্ঞতা ! লোকজন এটাও কতবার যে গুনগুন করেছে কানে ! এর আগে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। তবে দার্জিলিং থেকে তার দর্শন নিঃসন্দেহে অভিনব। সেই দর্শন-খিদেটাও দিন দিন প্রবল হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম। পাঠক ভাবছেন দার্জিলিং যাওয়া নিয়ে এত ভূমিকা ? আসলে এটা না হলে যাওয়ার পরের অনুভূতিটা বোঝানো অসম্ভব। একজন বাঙালি, যে কিনা প্রবল পাহাড়প্রেমী, ষাট বছর বয়সে পৌছেও দার্জিলিং গিয়ে উঠতে পারেনি। তার জীবনে, চোখের সামনে যে অভিভূত হওয়ার এমন এক আয়োজন ঈশ্বর সাজিয়ে রেখেছেন, সেটা বুঝিয়ে বলার জন্য কিছুটা প্রাককথন বোধহয় জরুরি। 

নভেম্বরের এক হিমসকালে ফুরফুরে মেজাজে যাত্রা শুরু হলো। চারজনের এক মহিলা টিম, আমি ছাড়া বাকি সবাই কলকাতা থেকে আগত। মিটিং পয়েন্টে গাড়িতে উঠলাম। আমি ছাড়া বাকিদের দার্জিলিং আগে এবং একাধিকবার যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। তবে, তাঁদের আরও একবার যাওয়ায় কোনও আপত্তি নেই। গাড়ি সুখনা জঙ্গলে পৌঁছতেই বদলে গেল চারপাশটা। ঘন জঙ্গল, আকাশ ছোঁয়া গাছপালার ফাঁকফোকড় দিয়ে রোদ্দুর উঁকি মারছে। পাখির কিচিরমিচির, ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে জঙ্গল পার হলাম। একটু পরেই আমাদের গাড়ি পাঙ্খাবাড়ির পথ ধরলো এবং শুরু চড়াই-উৎরাই। মূলত চড়াই।

এই যাত্রায় অসংখ্য হেয়ার পিন বেন্ড। একপাশে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের প্রাচীর, অন্যদিকে গভীর খাদ। ড্রাইভার আদিত্য শিলিগুড়ির ছেলে, বহুবার দার্জিলিং গেছে। ফলে, আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত। পথের পাশে ছোট ছোট গ্রাম। একটি-দুটি দোকান। নির্জন পথ ধরে কখনও একা পথচারী, কোথাও দল বেঁধে কাজে যাচ্ছে হাসিমুখের মহিলা। এদিক-ওদিক খেলছে কুচোকাঁচার দল, একটু বড়রা স্কুলের পথে। পাহাড়ী জনজীবনের নিপুণ এইসব ছবি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই কার্শিয়ং, আর সঙ্গে সঙ্গেই ছন্দপতন। ঘিঞ্জি রাস্তা, গাড়ির হর্ন, দোকানবাজারে ঠাসা এক শহর। সেইসব পার হয়ে আবার নির্জন পথে চলতে শুরু করে আমাদের গাড়ি। নানা বাঁক ঘুরে এগিয়ে চলে। সূর্যের উত্তাপ সামান্য টের পাওয়া যায়। সঙ্গে উত্তুরে হাওয়ার কাঁপন। মনটা ‘চা চা’ করছে সকলেরই। গাড়ি থামে পথের ধারের ছোট্ট দোকানের সামনে। দুই নেপালি মহিলার একজন ব্যস্ত মোমো তৈরিতে। আর একজন চা বানালেন। চায়ের কাপ মুখে তুলেছি, হঠাৎই চোখ আটকে গেল পথের বাঁ দিকে। রবিন ব্লু আকাশে শুচিশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেন রীতিমতো ঘোষণা, ‘আমায় দেখো’! অনেকটা দূর ছড়ানো সেই রেঞ্জ দেখে মন পাগলপারা। ফটাফট ছবি, সেলফি তুলে গাড়িতে উঠি। 

শিলিগুড়ি থেকে ছাড়ে দার্জিলিংয়ের মুখ্য আকর্ষণ, পৃথিবী বিখ্যাত টয় ট্রেন। পোশাকি নাম দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা ও সরু লাইন, যার শেষ দার্জিলিংয়ে। কার্শিয়ং থেকেই এই রেললাইন অধিক দৃশ্যমান। ট্রেনও দেখতে পেলাম, তাতে হাসিখুশি মুখের ট্যুরিস্ট, সপরিবারে। মাঝে ছোট ছোট কয়েকটি স্টেশন। শুধু জয় রাইড নয়, কাজেকম্মেও স্থানীয় মানুষ যাতায়াত করছে দেখলাম। এ যাত্রায় আমার অবশ্য টয় ট্রেন চড়া হয়নি। আগাম টিকেট বুকিং না করে আজকাল টয় ট্রেনে জায়গা পাওয়া যায় না। শুনলাম ব্ল্যাকে চড়া দামে টিকেট মেলে, যাতে আমাদের তেমন উৎসাহ নেই। এবারের মতো তাই স্টেশন দেখেই সাধ মেটে।

আমাদের গাড়ি ঘুম স্টেশনের কাছে পৌঁছয়। ঘুম এখন বেশ ঝাঁ চকচকে। তবে হেরিটেজ লুকটা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যেটা বাতাসিয়া লুপের ক্ষেত্রে কিছুটা বিলুপ্ত। সৌন্দর্যায়নের সৌজন্যে এই অতি প্রাচীন স্টেশনের চরিত্র কোথায় যেন উধাও। আমি যদিও এই প্রথম দেখলাম। তবে, ছবি দেখে একটা কল্পনা তো থাকে ! আমার টিমের বাকিরা আগে দেখেছেন। ফলে তাঁরা বেশ হতাশ। এখানে একটা তথ্য খুব জরুরি, বাতাসিয়া লুপ ঘিরে রয়েছে ওয়ার মেমোরিয়াল, এই সৌধটি দেখা দারুণ এক অভিজ্ঞতা। টয় ট্রেন ছাড়া বরাবর সঙ্গে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বার বার দেখেও মেটে না আশ। তখনও জানি না, আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে সামনের দিনগুলিতে।

Img 20200202 Wa0006
অবশেষে দার্জিলিং 21

আমাদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট হোটেলটি রাজভবনের পিছনে। রাজভবনের সামনের জায়গাটা অনেকটা ছড়ানো মালভূমির মতো, যা থাকে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। অতএব গাড়ি ছেড়ে কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হলো আমাদের। রাজভবনের সীমানা পার হয়ে বাঁদিকে হোটেল। সামনে দিয়ে পথ চলে গেছে ম্যালে। হোটেলে নির্দিষ্ট ঘরটিতে ঢুকেই দারুণ চমক। দেওয়াল জোড়া বিশাল কাঁচের জানালা। পর্দা সরাতেই আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বলা বাহুল্য, পরের তিনটে দিন যখনই আমরা ঘরে, যতক্ষণ দিনের আলো, ততক্ষণ দৃশ্যমান তিনি। কি যে অপূর্ব রূপ তার, কি অমোঘ আকর্ষণ ! কেন সবাই পাগলের মতো বার বার ছুটে আসে দার্জিলিং, সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। 

লাঞ্চ করে চললাম ম্যালের দিকে। সারি সারি শীতপোশাকের দোকান। বেশির ভাগ দোকানীই মহিলা। পরিপাটি সেজে দক্ষ হাতে ব্যবসা সামলাচ্ছেন তাঁরা। ট্যুরিস্ট সিজন। ব্যস্ততা তুঙ্গে তাই। কিছুক্ষণ বসে ম্যালে বিচরণরত মানুষজন দেখলাম। সূর্য ততক্ষণে অস্তরাগের লাজুক আলো ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের কোনে কোনে। ঠান্ডা হাওয়া বাঁধ মানে না। সেই আলো আর হাওয়ায় মাখামাখি কথারা যেন কোন পুরাতন কালের হারিয়ে যাওয়া গাথাকাব্য হয়ে ওঠে। দার্জিলিং তার শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস, অগম্য রহস্যের মেজাজ নিয়ে জেগে আছে, জেগে থাকে। সেই সুর আর আবেশ মনসিন্দুকে ভরে, ফিরি হোটেলে। 

গির্জা আর গুম্ফা, পুরোনো বাড়িঘর, পুরো শহরটার পাশ দিয়ে কু ঝিক ঝিক টয় ট্রেন–সব মিলিয়ে প্রাচীন ইতিহাসের অপরূপ সুগন্ধ দার্জিলিংয়ের শরীর জুড়ে। যাঁরা আগে গেছেন, অনেকদিন ধরে যাচ্ছেন, তাঁরা যতই বলুন ‘সেই দার্জিলিং আর নেই’, তাতে এই শৈল শহরের মহিমা এতটুকু কমে না। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা আজও একই স্রোতে বহমান। কঠিন জীবন সংগ্রাম এদের সুন্দর মনটাকে এতটুকু নষ্ট করতে পারেনি। যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা, যার দিকে তাকালেই মনে হয় ঈশ্বর দর্শন করছি। সেই ঈশ্বরের বাড়িঘরেই এই সরল মানুষগুলো বসবাস করে। রাজনীতির কুটিল পাকচক্রে উথালপাথাল তাদের জীবনযাপন। তবু তারা অমল আন্তরিকতায় দু হাত বাড়িয়ে রেখেছে আগত অতিথিদের জন্য। 

পরদিন সকালেই টাইগার হিল। গাড়ি চলেছে টাইগার হিলের পথে। শহরের পথে টিমটিমে আলো। এছাড়া বাকি সব অন্ধকার। একটু পরই জঙ্গলের পথ ধরলো গাড়ি। অন্ধকার এখন নিশ্ছিদ্র। রাস্তা ক্রমশ উপরে উঠছে, ঠান্ডাও বাড়ছে। পৌঁছে, সবাই পজিশন নিলাম, যেখান থেকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবো। এখানে স্পষ্টতই দর্শককুল দ্বিধাবিভক্ত। একদল সূর্য ওঠা দেখবে, আর অন্যরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমি দ্বিতীয় দলে। যদিও, ভিড় ঠেলে, চড়াইগামী কঠিন পথে উঠে, দীর্ঘ অপেক্ষা করেও চূড়ান্ত মুডি কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন এদিন সূর্যোদয়ের মহা মুহূর্তে ঘটেনি আমাদের ভাগ্যে। সে যাই হোক, আমি তো প্রথমবার, অনেকে একাধিকবার এসেও বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেছেন শুনলাম।

আমার এই প্রভাতের প্রাপ্তি অন্যত্র। এক পবিত্র প্রভাত, যার কাছে নতজানু হয়ে আবার নতুন করে পথ চলা যায়। অগণিত মানুষ সাক্ষী হতে চাইছে সেই অমল অনুভবের। সবাই ঠান্ডায় কাঁপছে। অনেকেই বয়সের ভারে ক্লান্ত। তবু দাঁড়িয়ে টাইগার হিলে সূর্য ওঠা দেখবে বলে। আর হোটেল থেকে বেরিয়ে টাইগার হিল যাওয়ার অভিজ্ঞতাও যে ভোলা যাবে না। ফেরার সময় শহরের ট্রাফিক এড়াতে জলাপাহাড়ের রাস্তা ধরলেন ড্রাইভারজি। ইনি দার্জিলিংয়ের অধিবাসী। আদিত্যই ঠিক করে দিয়েছে এঁকে। বয়স্ক মানুষ, নাম গুরুজি। বাকি কদিন দার্জিলিং শহর ও আশপাশে আমরা ওঁর গাড়িতেই ঘুরেছি। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সময় বহুবার খবরে উঠে এসেছে জলাপাহাড়ের নাম। গুরুজি জানান, “আমরা সেই স্মৃতি ভুলতে চাই। একটা পুরো সিজন সেসময় নষ্ট হয়েছে। স্থিরতা আসতে কত দিন লেগে গেল তারপর। ট্যুরিস্ট আসা বন্ধ। ওঁরা না এলে আমরা খাব কি ?”

পরের দিনটা দার্জিলিং শহরেই ঘোরাঘুরি। এখানে কয়েকটি নাম উল্লেখ করবো। পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক, পিস প্যাগোডা, তেনজিং নোরগে রক, জাপানিজ বুদ্ধিস্ট টেম্পল, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট এন্ড এভারেস্ট মিউজিয়াম, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট, ঘুম মনাস্ট্রি, চুন্নু সামার ফলস এন্ড রক গার্ডেন, সানচেল লেক, সিংরিলা ন্যাশনাল পার্ক, অবসারভেটরি হিলস, দার্জিলিং-রঙ্গীত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার রোপওয়ে। নামগুলো কমবেশি সকলেরই জানা। যেটা বলার, খুব ভালো করে এই কেন্দ্রগুলি দেখার জন্য কমপক্ষে সাত দিন জরুরি। আর একটি কথা, যথেষ্ট ফিটনেসও দরকার। কারণ, সবই চড়াই-উৎরাই পথে পৌঁছতে হয়। আমাদের পক্ষেও তাই সবগুলি দেখা সম্ভব হয়নি। তারই মধ্যে লেবঙ টি এস্টেট দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিশাল উপত্যকা জুড়ে চা বাগান, সবুজের প্রাণময় উৎসব যেখানে। আর ঠিক উপরেই দিগন্তবিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। অসাধারণ ঘুম মনাস্ট্রি আর পিস প্যাগোডা। 

দার্জিলিং শহর গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ধাপে ধাপে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এ শহর স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অনেকটাই ছড়িয়েছে আয়তনে। আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলি অপরিসর রাস্তাকে ক্রমশ যেন অধিকার করছে। রাস্তার ধারে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, যা এখনও খুব আধুনিক নয়। এ শহরের পর্যটন গুরুত্ব অসীম। সারা বিশ্বের পর্যটক আসে এখানে। সেই কথাটা মাথায় রেখে এই শহরকে আরও একটু পরিচ্ছন্ন রাখা যায় নাকি ? উল্টো ভাবে এটাও বলার, পর্যটকদের নিজেরও কিছু দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার বদ অভ্যাস আমাদেরও ছাড়তে হবে।

আন্দোলন চলাকালীন বহু কলকাতাবাসীকে বলতে শুনেছি, ‘দার্জিলিং আমাদের, ছাড়বো কেন ‘? তাঁরা ক’জন দার্জিলিং এসে এই সংক্রান্ত আদর ও যত্নের কথা মনে রাখেন, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। পাহাড়ী মানুষরা জন্মগত অভ্যাসেই পরিচ্ছন্ন, পরিশ্রমী ও সৌন্দর্যপ্রিয়। প্রত্যেকের ঘরের সামনে ফুলের বাগান বাধ্যতামূলক। ঘুম থেকে উঠেই বাড়িঘর পরিষ্কারে নেমে পড়ে ওরা। সুতরাং শহরটাও অপরিচ্ছন্ন করার কাজটা ওরা করে না, এটা ধরে নেওয়াই যায়। যাঁরা এখানে হোটেল ব্যবসায় আছেন এবং সরকারি স্তরে এর দায়িত্বে যে সংস্থা, যৌথভাবে দার্জিলিংকে সুন্দর রাখবেন এটাই প্রত্যাশিত। 

Img 20220921 Wa0059
অবশেষে দার্জিলিং 24

পরের দিন মিরিক যাত্রা। আর এই পথ এতটাই অপরূপ যে শুধু এই যাত্রাপথ নিয়েই একটা পুরো উপন্যাস লিখে ফেলা যায়। পাইনের ছায়া এক অদ্ভুৎ মায়ায় মুড়ে দিয়েছে পুরো পথ। শুধু পাইন নয়, অন্যান্য গাছও রয়েছে। অনেকেই প্রপিতামহ, আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে যুগযুগান্ত। চোখ জুড়নো সবুজ, আর তাও নানা শেডের। সেই সবুজের অঞ্জন চোখে মেখে পৌঁছলাম সুখিয়া পোখরি। এখান থেকে অনেকটা উপরে, জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছতে হয় জোড় পোখরি। পাশাপাশি দুটি কৃত্রিম লেক। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ এখানে অবিশ্বাস্য সুন্দর। বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতো ঘুরে গেলে চলে না এমন সুন্দর পুরো এলাকা। ‘পরে কখনও আসবোই’, নিজেকে একথা বলে রওনা দিলাম মিরিকের পথে।

পথে যেতে যেতে পড়লো লেপচাজগৎ, ছোট্ট সুন্দর এই স্পট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ দুরন্ত। মন বলে যাবো না, চোখ ভরে শুধু দেখে যাই। বেশ কটি হোমস্টে হয়েছে দেখলাম। অর্থাৎ একবার আসতেই হবে। এরপর সীমানা, এটা নেপালের সীমান্ত। খুব কাছে পশুপতি মার্কেট। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা সবাই স্তব্ধ। এমন সৌন্দর্যের কাছে নতজানু হতেই হয়। দাঁড়িয়ে আছি নেপালের অংশে। সেখান থেকে ডান দিকে তাকালে যতদূর চোখ যায় শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঝকঝকে নীল আকাশে তার অমোঘ অস্তিত্ব জানান দিয়ে সে যেন বলছে, ‘আমার কাছে এসো। আমার কাছে আসতেই হবে’। মিরিক থেকে ফেরার পথে অন্য রূপ তার। গোধূলীর রঙে লালাভ আকাশ, আর সোনালি আভায় অভিষিক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা। মিরিকের পথে এ ছাড়াও দেখলাম গোপালধারা টি এস্টেট। স্বপ্নের জালবোনা এক সবুজ গালিচা পাতা রয়েছে উপত্যকা জুড়ে। দেখে আশ মেটে না। 

Img 20220921 Wa0060
অবশেষে দার্জিলিং 25

মিরিকে গিয়ে লাঞ্চ আর লেক দর্শন। লেকের অবস্থা যেন গরিব ঘরের মেয়ের রুগ্ন শরীরে বেনারসী। লেক ছোট হতে হতে অর্ধেকেরও কম। এই পুরো ঘোরাটা ছিল গুরুজির গাড়িতে। কি উৎসাহ নিয়েই না উনি আমাদের দেখাচ্ছিলেন সব। বললেন, “আমরা এখন শুধু শান্তি চাই। লোকজন আরও বেশি বেশি আসুক। দেখুক আমাদের দার্জিলিং।” দার্জিলিং ফিরতে সন্ধ্যা। এরপর ব্যাগপত্র গোছানোর পালা। পরদিন সকালে দ্রুত তৈরি হচ্ছি, গাড়ি নিয়ে আদিত্য চলে আসবে। তারই মধ্যে জানালার বাইরে চোখ চলে যায়। আজ কি একটু বিষন্ন সে। মনে মনে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোটেল ছাড়ি। তারপর পুরো রাস্তা ধরেই বার বার দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে। চলার পথের যাবতীয় অনুষঙ্গে মিশে সে যেন যথার্থই বলে, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো !!