আগামী শুক্রবার মহিষাসুরমর্দ্দিনী
একটি রাত যেন এ দেশের নারীদের প্রতি ঘটে চলা চিরন্তন নিপীড়িত, অত্যাচারিত চলমান ক্ষণের প্রতীক। বাংলার দর্শক অধীর অপেক্ষায় রঞ্জন ঘোষের এই ছবির জন্য। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
গার্হস্থ্য হিংসা থেকে ধর্মবৈষম্য–অনাদি অতীত থেকে বর্তমান–সমাজে নারীশক্তির অবস্থান ও ক্ষমতায়নের চিত্রপট ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। সমাজে আমরা নারীকে দেবীরূপে পুজো করি। তারপরও প্রতিনিয়ত নারীরা লাঞ্ছনা, নিপীড়ন ও ধর্ষনের শিকার হয়। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক অবনমন তথা নৈতিক অবক্ষয়ের এই চিত্র আজও সমানভাবে বহমান। পট পরিবর্তনের কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। বরং সমাজের বুকে প্রতিনিয়ত এই ধরণের অভিযুক্তরা পেয়ে চলেছে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রশ্রয়। এরই সঙ্গে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় মেরুকরণের ছোঁয়া। সেই কারণেই নারী আজও সুরক্ষিত নয় সমাজের অসুরকূলের হাত থেকে।
মূলত এই বিষয়কে অবলম্বন করেই পরিচালক রঞ্জন ঘোষ নির্মাণ করেছেন ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। ছবির ট্যাগলাইন ‘আ নাইট টু রিমেমবার’। আদতে এই ছবি হলো একটি রাতের গল্প। সমাজে নারী কেবল গার্হস্থ্য হিংসার শিকারই নয়, প্রতিনিয়ত তাদের প্রতি সমাজে ঘটে চলা যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধেই লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় নারীকে। আর নারী শুধু পুরুষের অত্যাচারের শিকার নয়। অনেক সময় নারীও থাকে তাদের দুরাবস্থার পিছনে। অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে সমাজেরই দায় নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া এই অপরাধগুলির ! দর্শক তাই ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’-কে নিছক নারীবাদী নয়, মানবতাবাদী ছবি হিসেবেই দেখবেন বলে, বিশ্বাস করেন পরিচালক রঞ্জন ঘোষ।
সকলেই জানেন, ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ দেবী দুর্গার অপর নাম। এখানে অবশ্য ছবির নাম এরকম রাখার উদ্দেশ্য, পরিচালক এটিকে ব্যবহার করেছেন নারীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি হিসেবে। নারীর প্রতি সমাজে প্রতিনিয়ত হয়ে চলা ভুলগুলির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে এক মানবতাবাদী বার্তা দিতে চেয়েছেন পরিচালক এই ছবির হাত ধরে। দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপট অর্থাৎ দেবীপক্ষের আবহে রাজনীতি, গার্হস্থ্য হিংসা, ধর্মবৈষম্য, নারীশক্তির চিত্র–এই সবকিছুর উপরেই আলোকপাত করবে রঞ্জন ঘোষের এই ছবি। এটি পরিচালকের চতুর্থ ছবি। ইতিপূর্বে ‘হৃদমাঝারে’, ‘রং বেরঙের কড়ি’, ‘আহা রে’-র মতো ভিন্নস্বাদের ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন তিনি।
ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ঋতুপর্ণা অভিনীত চরিত্রটির নাম স্তুতি। সে পেশায় একজন পাইলট। স্তুতি অত্যন্ত ব্যাক্তিত্বময়ী ও অন্তর্মুখী স্বভাবের। সে বিবাহিত, কিন্তু ছবিতে তাঁর স্বামীকে দেখা যায় না। একটা সময় আসে যখন স্তুতিকেও জীবনের কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। স্তুতি যেন সমাজে যে সমস্ত নারী প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতিনিধি। ছবিতে একজন রাজনৈতিক নেতার চরিত্রে দেখা যাবে শাশ্বতকে। অপরদিকে একজন ভোটকুশলীর ভূমিকায় রয়েছেন পরমব্রত।
কাহিনি আবর্তিত হয়েছে কলকাতায় দু্র্গাপুজো শুরু হওয়ার ঠিক আগের রাতে অর্থাৎ পঞ্চমীর দিন। দশ বছরের একটি মূক ও বধির মেয়েকে গণধর্ষণের পর খুন করা হয়। এরপর গল্প মোড় নেয় একজন বাড়িওয়ালি এবং তাঁর বাড়িতে বসবাসকারী চারজন কলেজপড়ুয়া ভাড়াটের দিকে, যাঁরা শেষ মুহূর্তের উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। প্রসঙ্গত, সেই বাড়িওয়ালি আর কেউ নয়, সে হল স্তুতি, যার বাড়ির দুর্গাদালানে পুজোর প্রস্তুতি চলছে। এমতাবস্থায় সেই রাতেই তাদের বাড়ির সামনে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যার ফলস্বরূপ স্তুতির বাড়িতে কিছু অতিথির আগমন ঘটে। এদের আসাটা কিছু পরিকল্পিত এবং কিছু অপরিকল্পিত। তারপর কি হয়, দেখবেন ছবির পর্দায়।
ছবিতে অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন সাহেব ভট্টাচার্য, কৌশিক কর, জয় বদলানী, পৌলমী দাস, শ্রীতমা দে, শুভ্রশঙ্খ দাস, অভ্যুদয় দে, অরুণিমা হালদার, আরিয়ুন ঘোষ প্রমুখ। ছবির কাহিনি লিখেছেন পরিচালক স্বয়ং। সংগীত পরিচালনা করেছেন অভিজিৎ কুন্ডু। রয়েছে দুটি গান। টাইটেল ট্র্যাক ‘আমি মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ গেয়েছেন মাধুরী দে। এছাড়াও অপর একটি গান, ‘শোনো শোনাই আজ এক কবিতা’ শোনা যাবে অর্পিতা সরকারের কণ্ঠে। গীতরচনা করেছেন শুভদীপ কান্তাল। ছবির সিনেমাটোগ্রাফার শুভদীপ দে। সম্পাদনায় অমিত পাল। এভিএ ফিল্ম প্রোডাকশনসের ব্যানারে নির্মিত এই ছবির প্রযোজনার দায়িত্ব সামলেছেন পবন কানোডিয়া। সহ প্রযোজনায় বিনায়ক পিকচার্সের বিনোদ লাহোটি।
ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে ছবির টিজার, ট্রেলার-সহ অফিশিয়াল পোস্টার। গোটা ছবির টিজার-ট্রেলার জুড়েই রয়েছে ডার্ক টোনের ছোঁয়া। ছবির কালার প্যালেটটিও সেইভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে। আলো ঝলমলে দুর্গাদালান তাই যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন। চরিত্রদের চোখ-মুখ জুড়ে বিষন্নতা। কোথাও বা ভয়ের আবহ। সমাজের বুকে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ঘৃণ্য ঘটনার প্রতি আঙুল তোলা এই ছবির চরিত্ররা এখানে স্বাধীনভাবে নিজেদের মনোভাবকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যক্ত করে। ছবির সংলাপ যেন প্রতিবাদের সেই স্রোতকেই ধমনীর মধ্যে দিয়ে বইয়ে দেয়। শ্বাশত চট্টোপাধ্যায়ের বলা সংলাপ, ‘দেবী! তুমি মহিষাসুরের শরীরটা বধ করেছিলে শুধু, মনটা বধ করতে পারোনি…’ কিংবা পরমব্রতর বলা ‘এবার মহিষাসুরমর্দ্দিনীর মানেটাও পাল্টে ফেলতে হবে…’। আবার ‘এ শুয়োর ছোঁয় না, ও গরু ছোঁয় না কিন্তু একটা মেয়ে পেলে…’ ! একজন যুবসমাজের প্রতিনিধির মুখ থেকে আমরা শুনি ‘ক্রিমিন্যালগুলোকে ফাঁসিতে চড়াতে পারলে আসল সমাজসেবা হতো’-র মতো সংলাপ। এর মধ্য দিয়েও সেই প্রতিবাদের ভাষাই ধ্বনিত হয়। এক রাতের গল্পের এই পুরো ছবির শুটিং হয়েছে চুঁচূড়ার এক লোকেশনে।
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই ১৩তম বেঙ্গালুরু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান সিনেমা কম্পিটিশন বিভাগে দেখানো হয়েছে এই ছবি। পাশাপাশি নিউইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও প্রর্দশিত ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। সর্বত্র প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছে ছবিটি। এখানেই শেষ নয়। একমাত্র বাংলা ছবি হিসেবে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ জায়গা করে নিয়েছে নাট্যোৎসবেও। হ্যাবিট্যাট ওয়ার্ল্ড আয়োজিত দিল্লিতে ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে অনুষ্ঠিত আইএইচসি থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে প্রর্দশিত হয়েছে এই ছবি।
ছবি প্রসঙ্গে রঞ্জনের মন্তব্য, “১০ বছরের পরিশ্রমের ফল এই ছবি। সারা দেশ ঘুরে এলেও আমার নিজের শহরের দর্শক অবশেষে এই ছবি দেখতে পারবে, সেটা ভেবেই খুব ভালো লাগছে। দর্শকই তো ভগবান।” ছবিতে একঝাঁক নতুন অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করা প্রসঙ্গে রঞ্জনের অভিমত, “নতুনদের সঙ্গে কাজ করাটাই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। পুরোনো এবং নতুন এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। আমি আমার প্রথম ছবি থেকে সেটাই করে এসেছি। এই ছবিতে সেটা আরও ব্যাপ্তি পেয়েছে।”
“অনেকদিন পরে মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুব গভীর প্রভাব রেখে যাবে এই ছবিটা। এই ছবিতে প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে নিজেদের কথা বলতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়েছে। এই ছবি মুক্তি পাওয়া খুবই দরকার। সমাজে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটে যায়, যা দেখলে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। হয়তো কিছু করতে পারব না। তবে এই ছবির মাধ্যমেই নারীদের গর্জে ওঠার বার্তা দিতে পারব”–জানিয়েছেন ঋতুপর্ণা। এই ছবির হাত ধরে প্রথমবার রঞ্জনের সঙ্গে কাজ করলেন শাশ্বত। অভিনেতার মতে,”কিছুই বলব না। শুধু বলব ছবিটা গিয়ে দেখে আসুন। ঋতু তো অনবদ্য। আর একটা ছবি তো দাঁড়িয়ে থাকে লেখার উপর। রঞ্জনের লেখা অসাধারণ।” আগামী ২৫ নভেম্বর মুক্তি পাচ্ছে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’।