আগামী সপ্তাহেই মুক্ত ঋতুপর্ণা অভিনীত ‘দত্তা’
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। আগামী শুক্রবারই মুক্তি পাচ্ছে পরিচালক নির্মল চক্রবর্তীর ডেবিউ ছবি ‘দত্তা’। লিখেছেন চন্দন রায়।
সিনেমার পর্দায় আবার ‘দত্তা’র আবির্ভাব ঘটতে চলেছে, সংবাদ মাধ্যম সূত্রে এ খবর সকলেরই জানা। এও জানা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘বিজয়া’ রূপে দেখা যাবে এই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ও গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে! প্রসঙ্গত, এর আগে ১৯৫১ এবং ১৯৭৬-এ ‘দত্তা’ নিয়ে ছবি হয়েছে। বিশেষত, ১৯৭৬-এ অজয় কর নির্মিত ‘দত্তা’-তে সুচিত্রা সেনকে বিজয়া হিসেবে দেখাটা এখনও অনেক বাঙালি দর্শকের স্মৃতিতেই উজ্জ্বল হয়ে আছে! যদিও সেই সময় ছবিটিতে বিজয়ার চরিত্রে সুচিত্রা সেনের নির্বাচন প্রসঙ্গে সমালোচনা কম হয়নি !
প্রশ্ন হলো, প্রথমবার ছবি তৈরি করতে এসে পরিচালক নির্মল চক্রবর্তী ‘দত্তা’-কেই বেছে নিলেন কেন? একান্ত আলাপচারিতায় নির্মলের সাফ জবাব,”শরত-সাহিত্য নিয়ে ছবি করব এই ব্যাপারটায় নিশ্চিত ছিলাম। আর ‘দত্তা’ বাঙালির বহু পঠিত উপন্যাস। আমারও অন্যতম পছন্দের কাহিনি। আগের ছবিগুলির কথা মাথায় না রেখে, নিজের মতো করে ‘দত্তা’-কে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছি এবং আমি তৃপ্ত। ঠিক যেভাবে ভেবেছিলাম, সেভাবেই ছবিটা করতে পেরেছি। আশা করি, দর্শকদেরও ভালো লাগবে।“
এক্ষেত্রে অবধারিত ভাবেই সেই প্রশ্নও উঠে আসে, বিজয়ার চরিত্রে ঋতুপর্ণাই কেন, সাহিত্যের বর্ণনায় বিজয়া তো অষ্টাদশী। তুলনায় কম-বয়সী অন্য কোনও অভিনেত্রীকে কী ভাবা যেত না? না, কী, ঋতুপর্ণার সংস্থাই এই ছবির প্রযোজক আর নির্মল দীর্ঘদিন ঋতুপর্ণার প্রচার সচিব হিসেবে কাজ করে এসেছেন, সেই কারণেই ঋতুপর্ণাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নেওয়াটা অপরিহার্য ছিল? নির্মল স্মিত হেসে জানালেন, এই ধরণের সমালোচনা তিনি ইতিমধ্যেই শুনেছেন এবং এর জন্য তিনি প্রস্তুতও ছিলেন!
তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন এই বলে যে, যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁদের কাছে জানতে চাইব, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন একজন অভিনেত্রীর নাম বলুন, যিনি এই রকম একটি কঠিন এবং ভার্সেটাইল চরিত্রকে পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরতে পারবেন! যে কারণে অজয় করের মতো পরিচালককেও কিন্তু সুচিত্রা সেনকে নিতে হয়েছিল। সুচিত্রারও অভিনয় কেরিয়ারের শেষ দিকের ছবি ‘দত্তা’! তিনিও বেশি বয়সেই বিজয়া চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন–মনে করিয়ে দিলেন নির্মল!
প্রশ্ন উঠেছে ‘নরেন’ চরিত্রে জয় সেনগুপ্তকে নেওয়ার ব্যাপারেও! অজয় করের ছবিতে এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেতা ! নির্মল বললেন, শরৎচন্দ্রের বর্ণনায় কিন্তু নরেনকে মোটেই নায়কোচিত ভাবে তুলে ধরা হয়নি। তিনি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাই এমন কাউকে এই চরিত্রটার জন্য চাইছিলাম, যাঁকে দেখতে একটু সাধারণ হবে, কিন্তু অভিনয়ে দক্ষ হবেন। প্রথমদিকে অন্য দু-একজনের কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু তাঁরা বিভিন্ন চরিত্রে বহু ব্যবহৃত হয়ে কিঞ্চিৎ টাইপকাস্ট হয়ে গেছেন। তাই জয়ের মতো একজন অভিনেতাকে নরেন চরিত্রে পেয়ে আমার মনে হয়েছে, একদম ঠিকঠাক কাস্টিং হয়েছে।
ঋতুপর্ণা ও জয়–এই দুই সেনগুপ্ত ছাড়াও বিলাস চরিত্রে আছেন সাহেব চট্টোপাধ্যায়। নলিনীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবলীনা কুমার। রাসবিহারী ও দয়াল আচার্য চরিত্রে যথাক্রমে আছেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও প্রয়াত প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। এঁদের সকলের অভিনয়ই সমৃদ্ধ করেছে ‘দত্তা’-কে। পরিচালক তৃপ্ত শিল্পীদের অভিনয়ে। জানালেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এক শটে ‘ওকে’ হয়েছে। যে কারণে, কাজ হয়েছে দ্রুতগতিতে। মাত্র সতেরো দিনের শিডিউলে সম্পূর্ণ হয়েছে ছবির শুটিং!
ঋতুপর্ণা দেরিতে শুটিংয়ে আসেন, এইরকম একটা রটনা চালু আছে ইন্ডাস্ট্রিতে! এতে নির্মলের কোনও অসুবিধা হয়নি? জবাবে নির্মল জানালেন, “প্রথম কথা ঋতুপর্ণা যদি দেরি করে সেট-এ আসেন, তার মানে, তিনি নিশ্চয়ই অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজে আটকে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ঋতুপর্ণা যখন চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যান, তখন এতটাই দ্রুতগতিতে কাজ করেন এবং নিজের সেরাটা উজাড় করে দেন, যে, দিনে ছটা দৃশ্য শুট করে ফেলাটাও মোটেই অসম্ভব নয়।”
প্রথম ছবি পরিচালনা করতে এসে শরৎ-সাহিত্যই কেন বেছে নিলেন? কোনও নতুন গল্প বলা যেত না? এক্ষেত্রে নির্মলের বক্তব্য খুব প্রাঞ্জল। তাঁর কথায়, “আমি কোনও ফেস্টিভ্যাল-ধর্মী ছবি করতে চাইনি। বরং এমন একটি ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যেটি হবে মূলধারার, কিন্তু, সাহিত্যকেন্দ্রিক। সেই দিক থেকে শরত-সাহিত্য আমার প্রথম পছন্দ ছিল সবসময়ই। তাছাড়া, ইদানীং রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে বেশ কিছু ছবি হয়েছে। কিন্তু, মূলধারায় শরৎচন্দ্রের গল্প নিয়ে সেভাবে কাজ হয়নি। ‘দত্তা’ নিয়ে ছবি করার প্রস্তুতি আমি অনেকদিন ধরেই নিচ্ছিলাম।”
মাত্র সতেরো দিনের শুটিং-এ এইরকম একটি পিরিয়ড ড্রামাকে পর্দায় তুলে ধরতে নির্মল কিন্তু নির্ভর করেছেন অপেক্ষাকৃত নতুন টিমের ওপর। কেন? নির্মল বললেন, “দেখুন পরিচালক হিসেবে এটা আমার প্রথম কাজ। আমি চাইনি এমন নামে-ভারি কাউকে নিতে, যিনি আমার উপর কোনওভাবে খবরদারি করবেন বা আমার কথা অমান্য করবেন। তুলনায় এমন সব টেকনিক্যাল মানুষদের নিয়েছি, যাঁরা আমার ভাবনাটাকে রূপ দিতে, আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজটা করেছেন। ফলে, আমার কোনও রকম অসুবিধাই হয়নি।“
প্রসঙ্গত জানাই, ছবির ক্যামেরার দায়িত্ব সামলেছেন মৃন্ময় মণ্ডল, যাঁর কাজ ‘সহজপাঠের গপ্পো’ ছবিতে দেখে নির্মলের ভালো লেগেছিল। বিশেষত, আউটডোর শুটের জন্য এই পিরিয়ড পিস-এ মৃন্ময়কে নেওয়াটা যথার্থ মনে হয়েছে নির্মলের। ছবির পোশাক পরিকল্পনার কাজটি দারুণভাবে করেছেন সাবর্ণী দাস। সম্পাদনা দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন মলয় লাহা। শরত-সাহিত্যের প্রতি অনুগত থেকেই নির্মলের ভাবনা অনুযায়ী চিত্রনাট্য লিখেছেন সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
নতুন ‘দত্তা’-র সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন এই সময়ের অন্যতম প্রতিভাবান কম্পোজার জয় সরকার। আবহসঙ্গীতের দায়িত্বও সামলেছেন তিনিই। ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং একটি রজনীকান্ত সেনের গান। গানগুলি গেয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, অদিতি গুপ্ত এবং শ্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়। জয়ের সঙ্গীত পরিচালনা এবং গানগুলি নিয়ে উচ্ছ্বসিত পরিচালক। সঙ্গীত তার ছবিকে সম্পৃক্ত করেছে বলেই তিনি মনে করেন।
আগামী ১৬ই জুন ৩০টিরও বেশি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে ‘দত্তা’। নির্মল ভীষণভাবেই আশাবাদী, বাঙালি দর্শকের ভালো লাগবে তাঁর ‘দত্তা’, এই ব্যাপারে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশেও ছবিটি দেখানোর চেষ্টা করবেন পরিচালক। ইতিমধ্যেই ছবির ট্রেলার ইউটিউবে দেখে ফেলেছেন লক্ষাধিক দর্শক! ছবির পোস্টার পেয়েছে সেরার স্বীকৃতি! ঝকঝকে, প্রযুক্তিগতভাবে স্মার্ট, কিন্তু, কালজয়ী সাহিত্য-নির্ভর একটি ছবিতে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং অন্যান্য দক্ষ শিল্পীদের দারুণ অভিনয় দেখতে দর্শক হলে আসবেন বলেই মনে করছেন পরিচালক ও টিম ‘দত্তা’।