Monday, February 3, 2025
টলিউডলাইম-Light

আজও প্রাসঙ্গিক ‘প্রজাপতি’

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। এই ছবিকে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ না বলে সুব্রত সেনের ‘প্রজাপতি’ বললে অত্যুক্তি হবে না ! লিখেছেন চারুবাক

সমরেশ বসু ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন ছয়ের দশকে! অশ্লীলতার দায়ে মামলাও হয়েছিল। দীর্ঘ সময় লেখাটি নিষিদ্ধও ছিল। শেষপর্যন্ত, কলকাতা হাইকোর্টের বিচারে ‘প্রজাপতি’ অশ্লীলতার অভিযোগ থেকে রেহাই পায়। লেখক এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র সুখেনের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের সমাজ, পারিপার্শিক ক্ষীয়মান জীবনধারা, রাজনীতির নামে দুষ্কৃতি-দৌরাত্ম্য, শহরতলির এক দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার জন্য দুষ্কৃতী হতে বাধ্য হওয়ার কাহিনিকে যাকে বলা যায় নিখুঁতভাবে বাস্তবের চেহারায় তুলে এনেছিলেন। বাস্তবতার কারণেই সংলাপ ও চরিত্র-ঘটনার বর্ণনায় সমরেশ বসু কোনওরকম আপোস করেননি! তাঁর আপোষহীনতাকে অশ্লীলতার দায়ে পড়তে হয়েছিল, সেটা আমাদের ভাবনার সীমাবদ্ধতা। ভন্ডামিও বলা যায়।

Images 12 2
আজও প্রাসঙ্গিক 'প্রজাপতি' 7

বলতে বাধা নেই, এত বছর বাদে, বাংলা সিনেমায় অনেক রেকর্ডের অধিকারী সুব্রত সেন সেই বিতর্কিত উপন্যাস নিয়ে ছবি করলেন লেখকের মতোই, কোথাও কোনওভাবে আপোস না করে! প্রসঙ্গত, এত বছর পরেও সামাজিক অবস্থার কোনও বদল ঘটেনি। বরং, দুষ্কৃতির কাজটা এবং দুর্নীতি কিছু রাজনৈতিক দল ও নেতার সৌজন্যে প্রায় সামাজিক স্বীকৃতিই পেয়ে গেছে। সুতরাং, এই ছবিকে সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ না বলে সুব্রত সেনের ‘প্রজাপতি’ বললে অত্যুক্তি হবে না !

ফিল্ম বানানোর সময় মাধ্যমগত দাবিতেই পরিচালক মূল কাহিনির যেমন পরিবর্তন করেছেন, তেমনই বাদ দিয়েছেন অনেক ঘটনা, কিছু চরিত্র। কিন্তু ছবিটি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি নান্দনিক ও শিল্পশোভন। অশ্লীলতার কোনও ছিটেফোঁটা নেই! মাস্তান সুখেনের সঙ্গে মাচার নাচিয়ে শিখার প্রেম ও ঘনিষ্ঠতাকে তিনি যেমন কাঁচা ভাষায় মুড়ে দিয়েছেন, তেমনই ওই এলাকারই এক উঠতি মাস্তানকেও উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে ছবিতে রাখা হয়েছে। এই যে পরবর্তী প্রজন্ম, যাঁরা এখন দুর্নীতি ও রাজনীতির হাল-বৈঠা ধরে আছে–মাস্তানি ও নেতাদের ‘খেলা’ প্রবলভাবে কারখানার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে চলেছে–সুব্রত সেন সেটা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সিনেমার পর্দায়। ভাবলে ভালো লাগে এই সুব্রতই সমরেশ বসুর আরও একটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত কাহিনি ‘বিবর’-কেও পর্দায় এনেছিলেন!

Images 22
আজও প্রাসঙ্গিক 'প্রজাপতি' 8

তাঁর সিনেমার কাঠামো অনেক বেশি আধুনিক! পুরুলিয়ার ছৌ-নাচের মুখোশ পরা কয়েকজন মানুষের একটি জঙ্গলের মধ্যে নেচে চলা দিয়ে আজকের সমাজের প্রতীকী উপস্থিতি জানিয়ে দেয়, এই ছবি ব্যবসার কথা ভাবেনি। এমনকী শিখার (মমতাজ সরকার) মাচা নাচের দৃশ্যকেও সত্যিকারের গ্রামীণ অসভ্যতায় তুলে আনেননি! কলকাতা শহর ছেড়ে দিয়ে অনামী মফস্বলের এক আধা শহরকে ছবির প্রেক্ষাপট করায়, বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে। পুরো ছবিটাই তিনি লিনিয়ার স্ট্রাকচারে ধরেছেন। দুটি জায়গায় সুব্রত ঝটিতি ভাবে অতীতে ফিরেছেন, কিন্তু, গতিকে ব্যহত করে নয়! এটাই তাঁর মুন্সিয়ানা! এমনকী ‘ডিম পাঁউরুটি’ গানটিও সুব্রত শুট করেছেন যথেষ্ট সংযমের সঙ্গেই! আজকের পানশালার নাচ ও মাস্তানরা অনেক অনেক বেশি অশ্লীল ও বেপরোয়া, নেতাদের উস্কানি ও প্রশ্রয়ে!

না, ছবির শেষে সুব্রত কোনও সমাধান বা আশার আলো দেখাননি। তবে, বুঝিয়ে দিয়েছেন সুখেন (সুব্রত দত্ত) মারা গেলেও (?) মাস্তানরা রিলে রেসের জন্য তৈরি হচ্ছে! পরিবর্তনের কোনও লক্ষণ সুদূর পরাহত! এই ছবি দেখে এখনকার পথভ্রষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের মদতপুষ্ট তরুণদের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে কিনা জানি না। কিন্তু, পরিচালক হিসেবে সুব্রত নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক দায় পালন করলেন ! যেখানে এখনকার টালিগঞ্জে প্রায় সব্বাই নিজের গা বাঁচিয়ে, বর্তমান সময় থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রেম কাহানি আর গোয়েন্দা গপ্পে মজে আছেন, সেখানে সুব্রত নিশ্চয়ই একটি জরুরি কাজ করলেন!

Images 42
আজও প্রাসঙ্গিক 'প্রজাপতি' 9

সুব্রত সেনের এই ছবি অবশ্যই কারিগরী বিভাগেও (চিত্রগ্রহন, সম্পাদনা, আবহ সৃজন ইত্যাদি) রীতিমত ওজনদার। পাশাপাশি শিল্পীদের সামগ্রিক অভিনয়েও অতি উজ্জ্বল। প্রথম নাম নিশ্চয়ই সুখেনের ভূমিকায় সুব্রত দত্ত এবং উঠতি মাস্তানের চরিত্রে ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়–দুজনেই পাল্লা দিয়ে দুটি চরিত্রকে শুধু জীবন্ত করেননি, রক্তমাংসের মাস্তান করে তুলেছেন। শিখার ভূমিকায় মমতাজ নিশ্চয়ই এক আবিষ্কার! তিনি চরিত্রের অন্তর ছুঁতে পেরেছেন বলতে পারি। শ্রীতমা দে ছোট চরিত্র পেলেও স্বাভাবিক অভিনয়ে চোখে পড়েন। সুরত সেনের এই ‘প্রজাপতি’ নিশ্চিতভাবে আজকের বাংলা সিনেমায় এক ব্যতিক্রম !!