আজও প্রাসঙ্গিক ১৯৬৫’র ‘টু’
লিখেছেন অজন্তা সিনহা
সিনেমা নির্মাণের সমস্ত দিক, সাহিত্যচর্চা, প্রকাশনা, অঙ্কন ইত্যাদি নানাদিকে বহুধা বিস্তৃত ছিল তাঁর কর্মযজ্ঞ। এসব প্রায় সব বাঙালিই জানেন। সেই বাঙালির অন্তর্ভুক্ত আমিও। তবু, এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিটি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না–নাকি বিস্মৃত হয়েছি ! যাই হোক, এ নিতান্তই আমার ব্যাক্তিগত লজ্জা ! ভারতীয় সিনেমার কালপুরুষ সত্যজিৎ রায় নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘টু’ দেখার সুযোগ ঘটে সম্প্রতি। ছবির বিষয় দুটি শিশুর আর্থ সামাজিক বিভেদের মাঝে পারস্পরিক ভাবনার লেনদেন। শিশু জানে না সামাজিক জটিলতা। আর্থিক অবস্থানগত পার্থক্যেও কিছু আসে-যায় না তার। কিন্তু অজান্তেই ঘটে যায় বিভেদ। পরিবেশের প্রভাব পড়ে শিশুমনের ওপর।
ছবিটি সম্পর্কে বিস্তারে বলার আগে কিছু জরুরি কথা ! প্রিয় ভাই নির্মল চক্রবর্তী হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এই অনির্বচনীয় বস্তুটি শেয়ার না করলে আমি জানতেই পারতাম না ভারতীয় তথা বিশ্ব সিনেমার কিংবদন্তি মানুষটির এমন এক সৃষ্টি বিদ্যমান। ‘টু’ ছবি সম্পর্কে জনৈক সিনেমাপ্রেমীর বিশ্লেষণ ও একটি ইউটিউব লিঙ্ক, এই ছিল শুরুর প্রাপ্তি। তারপর তো ছবিটি দেখলাম। দেখলাম এবং বিস্ময়ে আবিষ্ট হলাম। এই সূত্রেই নির্মলকে আমার অন্তরের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
নির্মলকে বহু বছর চিনি। সিনেমার জনসংযোগ বিষয়ে তার কাজ। কিন্তু সেই কাজে নিছক গতানুগতিক ভাবে নিজেকে আবদ্ধ রাখেনি সে। প্রাচীন ও সমকালীন বাংলা সিনেমা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে তার শ্রদ্ধা, জিজ্ঞাসা বরাবর আলাদা করে ভাবিয়েছে আমায়। তার সেই বোধ ও চেতনা থেকেই সত্যজিৎ নির্মিত এই ছবি সে আমায় শেয়ার করে। সোস্যাল মিডিয়ার রমরমা ও সর্বক্ষণ তথ্য আদানপ্রদানে ইদানীং অর্থহীন, সস্তা উপাদান বিনিময়ের যে প্রবণতা দেখি, সেখানে নির্মলের মতো মানুষ বিরল ও ব্যতিক্রমী, একথা পৃথকভাবে উল্লেখ প্রয়োজন।
নিজের লেখা চিত্রনাট্যে সত্যজিৎ এ ছবি নির্মাণ করেন ১৯৬৪ সালে। Esso World Theater-এর ব্যানারে ছবিটি তৈরি হয় আমেরিকার PBS, পাবলিক ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের অনুরোধে। আদতে ‘টু’ হলো সত্যজিৎ নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির এক ট্রিলজির অন্তর্গত একটি–যেখানে বাকি দুটির একটি ছিল কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে, দ্বিতীয়টি মুম্বইয়ের এক ব্যালে ট্রুপকে নিয়ে, নাম ‘বম্বে’। ভারতীয় পটভূমিতে ইংরেজি ভাষায় যেন তৈরি হয় ছবিগুলি, এই ছিল নির্মাতাদের অনুরোধ। কিন্তু সত্যজিৎ নিজে নির্বাক চলচ্চিত্রের একজন অনুরাগী ছিলেন। ‘টু’-কে সংলাপবিহীন রূপে তৈরি করেন তিনি।
গল্প এমন, ধনী পরিবারের এক সন্তান (অভিনয়ে রবি কিরণ) তার খেলনা নিয়ে খেলছে, হাতে সফট ড্রিংকয়ের বোতল। হঠাৎ বাইরে থেকে আসা একটি শব্দ শুনে সে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং জানালা দিয়ে দেখে, এক পথশিশু ( সত্যিকারের এক দরিদ্র শিশু, কোনও অভিনেতা নয়) বাঁশি বাজাচ্ছে। এরপর ওই ধনী সন্তান বাঁশির সুর চাপা দেবার ঔদ্ধত্যে জোরে জোরে নিজের খেলনা ট্রাম্পেট বাজাতে শুরু করে। অসহায় পথের শিশুটি তার বস্তির ঘরে ফিরে যায় এবং ফিরে আসে একটি ছোট ড্রাম নিয়ে। সে ড্রাম বাজাতে শুরু করতেই ধনী সন্তান তার দামী ব্যাটারি চালিত মাংকি ড্রামার নিয়ে আসে এবং আরও জোরে বাজাতে থাকে। কিছুক্ষন এই অসম প্রতিযোগিতা চলার পর রণে ভঙ্গ দেয় দরিদ্র শিশুটি এবং দুঃখিত মনে ঘরে ফিরে যায়।
খুশি হয় ধনী শিশু। বলা বাহুল্য, তার এই মনোভাব নিতান্তই অসুস্থ আনন্দের প্রতীক ! একদিন ধনী শিশু খেলতে খেলতে দেখে আকাশে একটি ঘুড়ি উড়ছে। ঘুড়ি ওড়াচ্ছে সেই দরিদ্র শিশুটি। ধনী শিশু যেনতেন প্রকারেন ঘুড়িটি নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং সফলও হয়। দরিদ্র শিশু ঘরে ফেরে ছেঁড়া ঘুড়ি আর চোখে জল নিয়ে। ধনী শিশুর দিকে সে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু হলো না। তার যাবতীয় অসহায়তার মাঝে মুক্তির প্রতীক ঘুড়িটিকেও ধ্বংস করে দেয় ধনী সন্তান।
এরপর থেকে ধনী শিশু আপন দম্ভ, ঔদ্ধত্য ও অহংকার নিয়ে একাই খেলে যায়। তার অনেক খেলনা। জোরালো শব্দে চারপাশ সচকিত করে নিজের জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে চায় সে। কিন্তু কোথা থেকে যেন ভেসে আসে সেই মরমী বাঁশির সুর। হাজারো শব্দেও সে চাপা দিতে পারে না সেই সুর। ঠিক তখনই তার খেলনা রোবট আঘাত করে শিশুটির টয় টাওয়ারে। টাওয়ার ভূপতিত হয়। সিনেমা বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই সময় ভিয়েতনামের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ চলছিল। ধনী ও দরিদ্র শিশুর আর্থ সামাজিক বিভেদ দেখানোর মাধ্যমে দুটি দেশের অবস্থানগত পার্থক্য ও দরিদ্রের প্রতি ধনীর অত্যাচার, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–এইসবই প্রকাশ করেছেন সত্যজিৎ।
ছবির সিনেমাটোগ্রাফার সৌমেন্দু রায়, সত্যজিতের দীর্ঘ কর্মসঙ্গী। সম্পাদনা দুলাল দত্ত। ২২ মিনিট সময়সীমার এই ছবির মিউজিক নির্মাণ করেন সত্যজিৎ স্বয়ং। ১৯৬৪’ র এই ছবি আজও কত প্রাসঙ্গিক পাঠককে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতেই প্রাসঙ্গিক। আর্থ সামাজিক নিরিখে বৈষম্য, বিভেদ, দুর্বলের প্রতি সবলের উদ্ধত অত্যাচার, অসহায় মানুষের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা আজও চলেছে সমান তালে। উৎসাহীরা ‘টু’ দেখতে হলে ইউটিউবে সার্চ করুন।