আদ্যন্ত এক নান্দনিক মানুষ
লিখেছেন চয়নিকা বসু
একটি রিয়ালিটি শোয়ে অতিথি হয়ে এসেছেন তিনি। বরাবরের মতো শান্ত-সৌম্য মূর্তি। চোখদুটি যেন কোন স্বর্গলোকের দ্যুতিতে আলোকময়। এই সন্ধ্যায় ওঁর পাশে বাকি সব ম্লান। এমনকী বলিউডের ফরএভার ধকধক গার্ল মাধুরীও। শো চলাকালীন বসে বসেই কিছু কিছু মুদ্রা দেখাচ্ছেন প্রতিযোগী ও দর্শকদের। ছোট ছোট সেসব ‘ভাও’ মুহূর্তে মুহূর্তে তুমুল করতালিতে অভিনন্দিত হচ্ছে।
তারপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ–মাধুরীর অনুরোধে নাচের মঞ্চে এলেন তিনি। তারপর–সে যে কী অপরূপ স্বর্গীয় এক নৃত্য প্রদর্শন। কে বলবে, বয়স আশির ঘরে। কী সাবলীল ! কী নান্দনিক ! কত্থক নৃত্যশৈলী যেন তাঁকে দেখেই সৃজিত। মাধুরী নত হয়ে আশীর্বাদ নিলেন সর্বকালের সেরা ভারতীয় এই কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পীর। রিয়ালিটি শোয়ের সস্তা নাটক মুখ লুকিয়ে পালালো। যে ক’জন সাক্ষী থাকলেন এই অনির্বচনীয় কয়েক মুহূর্তের, তাঁরা কোন মহার্ঘ প্রাপ্তির আনন্দে ভেসে গেলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ, এই ১৭ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে প্রয়াত পন্ডিত বিরজু মহারাজকে শ্রদ্ধা জানাবার অবকাশে কিছু লিখতে গিয়ে আবার ফিরে এলো, সেই সন্ধ্যার না ভোলা স্মৃতি । কী অমায়িক তাঁর মুখের প্রতিটি শব্দ। সারা বিশ্বে যিনি বন্দিত, কী নম্রতা আর বিনয়ের সঙ্গে সমস্ত প্রশংসা গ্রহণ করছেন তিনি। ছোটদের উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গিটিও কী প্রাণবন্ত। ১৯৩৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন ব্রিজমোহন নাথ মিশ্র, পরে যিনি বিরজু মহারাজ নামে খ্যাত হন সারা বিশ্বে।
পারিবারিক সূত্রেই লখনৌ ঘরানার উচ্চমার্গের এক কত্থকশিল্পী পরিবারে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও প্রশিক্ষণ। বাবা জগন্নাথ মহারাজ, দুই কাকা লাচ্চু মহারাজ ও শম্ভু মহারাজের কাছে হাতেখড়ি ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ তাঁর। মাত্র ৭ বছর বয়সে বিরজু মহারাজের প্রথম মঞ্চ অনুষ্ঠান। তারপর দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করতে খুব বেশি সময় লাগেনি এই অত্যন্ত প্রতিভাধর মানুষটির। সেখান থেকে সারা বিশ্ব। সর্বত্র ছড়িয়ে তাঁর অনুরাগী ও শিষ্যের দল। নৃত্যের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় সংগীতেও প্রশিক্ষণ-প্রাপ্ত তিনি।। পন্ডিত বিরজু মহারাজ সংগীত নাটক একাডেমির অন্তর্গত কত্থক কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন দীর্ঘদিন।
বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিরজু মহারাজ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংগীত নাটক একাডেমি, পদ্ম বিভূষণ, নৃত্য চূড়ামনি পুরস্কার, কালিদাস সম্মান, লতা মঙ্গেশকর পুরস্কার, অনারারি ডক্টরেট ইন্দিরা কলা সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও অগণিত পুরস্কারে ভরে ছিল পন্ডিতজির ঝুলি। সত্যজিৎ রায় তাঁর শতরঞ্জ কি খিলারি ছবিতে বিরজু মহারাজের দুটি নাচের দৃশ্য রাখেন–যার মিউজিক কম্পোজিশন ও কোরিওগ্রাফি পন্ডিতজির অবদান। দর্শক ভোলেনি সেই উপহার। সঞ্জয় লীলা বনশালীর দেবদাস ছবিতে ‘কাহে ছেড় মোহে’, তারপর ‘বাজিরাও মস্তানি’ ছবির ‘মোহে রং দো লাল’–দ্বিতীয়টি তাঁকে ২০১৬-র ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড এনে দেয়। তার আগে ২০১২-তে পান সেরা কোরিওগ্রাফার হিসেবে ন্যাশনাল ফিল্ম এওয়ার্ড, ‘বিশ্বরূপম’ ছবির ‘উন্নাই কানাঠু’ গানের জন্য। দেশবিদেশের প্রথমসারির মঞ্চ, বিখ্যাত কনফারেন্স, সভা-সেমিনার আলো করেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা, যা তিনি দু’হাত ভরে পেয়েছেন। শ্রদ্ধা ও সম্মানে তাঁকে বরণ করে নিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা। তাঁর নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে যাবে ঠিকই। থেকে যাবে পন্ডিত বিরজু মহারাজের অবদান–স্মৃতিতে, নান্দনিকতায়–চিরদিন।