আপনাকে ভুলবো না শুভ্রাবৌদি
দীর্ঘদিন নিজের সঙ্গীতচর্চা এবং সাংবাদিকতার সুবাদে কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে সংগীত জগতের বহু গুণী মানুষের। তাঁদের নিয়েই এই প্রতিবেদন। পড়ুন অজন্তা সিনহার কলমে।
তাঁর সংস্পর্শে খুব ভালো করে একবারই যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। কিন্তু সেই একটিবারের স্মৃতিই আজও অমলিন। কলকাতা, দিল্লি তথা বিশ্বের বহু প্রান্তের বাঙালি এবং বাংলাদেশের সঙ্গীত ও সংস্কৃতি জগতের মানুষের কাছে শুভ্রাবৌদি তিনি। দেশবাসীর কাছে তিনি প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। উনিও আজ আর নেই। প্রণববাবুর আগেই প্রয়াত হয়েছেন। একটা সময় দেশের তামাম রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল শুভ্রাবৌদির। তবে, সবচেয়ে বেশি যাঁর কাছের মানুষ ছিলেন শুভ্রাবৌদি, তিনি প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরাজিকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়, সেই খাদ্যবস্তুর তালিকায় নিপাট বাঙালি মাছের ঝোল বিশেষ প্রাধান্য পেত–এসব গল্পও অনেকেই জানেন।
এবার নিজের অভিজ্ঞতার কথা। সংবাদপত্রের চাকরির প্রথম দিক সেটা। গানবাজনা অতি কষ্টে টিকিয়ে রেখেছি। সামগ্রিকভাবেই একটা প্রবল জীবনযুদ্ধ চলছে। প্রতিদিন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই আরও তীব্র। এরইমধ্যে এক সহকর্মীর সৌজন্যে পরিচিত হলাম নৃত্যশিল্পী রেখা মৈত্রের সঙ্গে। রেখাদি আলাপের শুরুতেই আন্তরিক আবেগে কাছে টেনে নিলেন। সময় পেলেই ওঁর বালিগঞ্জ ফাঁড়ির ফ্ল্যাটে যেতাম। গানবাজনা, আড্ডা হতো। এমনই এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে গেছি রেখাদির ফ্ল্যাটে। দেখি, প্রচুর ছেলেমেয়ে। বিষয়টা জানলাম একটু পরেই। দিল্লির শুভ্রা মুখোপাধ্যায়, ওঁর ট্রুপ ‘গীতাঞ্জলি’-র ব্যানারে হিন্দি ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চন্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হবে দিল্লির এক অডিটোরিয়ামে। কলকাতা থেকে যাবে রেখাদি নিজে ও তাঁর পুরো নাচের ট্রুপ, সঙ্গে কয়েকজন গানের শিল্পী, যাঁদের মধ্যে তিনি আমাকেও রেখেছেন। তবে, গানগুলি হিন্দিতে অনূদিত। এটা অবশ্য কোরাসের জন্য। মুখ্য গানের শিল্পীরা দিল্লির। শুভ্রাবৌদির সঙ্গে রেখাদির দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এই অনুষ্ঠানের যোগসূত্র সেটাই।
অফিস থেকে অনুমতি, ছুটির ব্যবস্থা ইত্যাদি করে একদিন রাতে ট্রেনে চেপে বসলাম। যাঁদের সঙ্গে যাচ্ছি, তাঁদের অনেককেই চিনি না। অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েই বেশি। নিজেকে একটু গুটিয়েই রাখলাম তাই। দিল্লি পৌঁছে আমাদের ঠিকানা হলো ইয়ুথ হোস্টেল। সম্ভবত, দিন চারেক ছিলাম সেখানে। প্রায় তিনযুগ আগের কথা। যতটুকু স্মৃতিতে আছে ততটুকুই বলছি। ইয়ুথ হোস্টেলের খুব কাছেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। আমরা সকাল থেকে রাত ওই বাড়িতেই কাটাতাম। রাতে ঘুমানোটা শুধু ইয়ুথ হোস্টেলে। শুভ্রাবৌদির সঙ্গে আলাপ হলো। আক্ষরিক অর্থেই মাটির মানুষ। আগেই শুনেছিলাম তিনি হলেন প্রণববাবুর সকল কাজের কাজী। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানের পিছনে বৌদির অবদান সর্বজনবিদিত। কিন্তু ওঁকে দেখে সেসব বোঝার উপায় নেই। একেবারেই ঘরোয়া স্নেহময়ী এক মানুষ যেন !
আমাদের রিহার্সাল হচ্ছিল জমিয়ে। হিন্দি উচ্চারণের ছোটখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি ঠিক করে নিচ্ছিলাম। গানের বাইরে বাকিটা নিজেকে যতদূর সম্ভব আড়ালে রাখারই চেষ্টা করতাম। ব্যাক্তিগত সংকট চেপে বসতে চাইতো মনে-মাথায়। তারই মধ্যে গান গাওয়াও চলতো। এখানে একটা ছোট্ট কথা, জীবনের হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও গান আমায় কখনও ছেড়ে যায়নি। রেখাদি সহ আমাদের কলকাতার দলটির সকলেই এই গান গাওয়ার ব্যাপারে আমাকে কিছুটা বাড়তি নেকনজরে রাখতো। এই দলে শুভ্রাবৌদিও নাম লেখালেন। প্রতি সন্ধ্যায় রিহার্সাল হয়ে যাওয়ার পর উনি হারমোনিয়াম হাতে বসিয়ে দিতেন আমায়। তখন বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গান। এক একবার কতগুলি করে গাইতাম, আজ আর হিসেব মনে নেই। সে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। শুধুই একজন গানের শিল্পী হিসেবে জীবনকে চালিত করা আমার ভাগ্যে ঘটেনি। দিবারাত্র গানের সঙ্গে থাকতে পারিনি। কিন্তু সেটা বাইরের। এই জায়গাটা শুভ্রাবৌদি বুঝেছিলেন। উজার করা ভালোবাসা পেয়েছি তাঁর। একদিন রিহার্সালের পর প্রণববাবু এলেন, বৌদি আলাপ করিয়ে দিলেন। দেখলাম, তিনিও একজন মাটির মানুষ। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ডানহাত তিনি। অথচ, কোথাও তার প্রকাশ নেই। কী সহজ আর বিনম্র !
দিল্লি থেকে ফেরার আগে শুভ্রাবৌদি উপহার দিয়েছিলেন ওঁর লেখা ‘চোখের আলোয়’। এই বইটি ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে শুভ্রাবৌদির নিজের অনুভবের কথা। উৎসর্গও করেছিলেন ইন্দিরাজিকেই। সেই মূল্যবান স্নেহ-উপহার আজও আমায় মনে করিয়ে দেয় সেদিনের সোনালি দিনগুলির কথা। কলকাতায় ফিরে দ্বিগুণ গতিতে লড়াই শুরু। সংবাদপত্রের কোনও অভিজ্ঞতা নেই। পরিবারে কোনও ধারা নেই। ডিগ্রী বা প্রশিক্ষণের জোর নেই। আছে শুধু জেদ। তাই নিয়েই লড়ে যাওয়া।
গান গাওয়াও চলছে একটু আধটু। বন্দনা সিংহের কাছে গান শিখছি নতুন করে। পাঁচ বছর পর আবার প্রথাগতভাবে গানের জগতে। শুভ্রাবৌদি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কলকাতায় এলে দেখা করতেই হতো। কী যে আন্তরিক ছিল আমার প্রতি তাঁর ব্যবহার! অথচ, এর কোনও কারণ ছিল না। নিতান্তই অযাচিত প্রাপ্তি। একটা সময়ের পর স্বাভাবিক কারণেই আমার কাজের চাপ বাড়লো। লড়াই কিন্তু কমলো না। সংবাদপত্রের রাজনীতি থেকে সামাজিক জটিলতা–একটার পর একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতে কবে কখন শুভ্রাবৌদির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম, আজ আর মনে পড়ে না। এটা মনে অছে আমাদের কমন পরিচিত যাঁরা, তাঁদের কাছে আমার খবর নিতেন উনি। স্নেহময়ী সেই মানুষটার সঙ্গে জীবনে আর কোনোদিন দেখা হবে না। তবে, মনের মনিকোঠায় চিরদিন থাকবেন তিনি।