আবৃত্তিকে ভালোবেসে একটা জীবন
লিখেছেন অজন্তা সিনহা
আবৃত্তিকে ভালোবেসে পুরো একটা জীবন–এই মানুষটাই হলেন উৎপল কুণ্ডু। বাংলা সংস্কৃতি জগতের অতি সজ্জন, চূড়ান্ত গুণী, সুভাষী ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই মানুষটির সংস্পর্শে খুব বেশি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সামনাসামনি দু-একবার। দূর থেকেই বেশি দেখা ও শোনা। প্রচারসর্বস্ব যুগের পক্ষে বিরল এক মানুষ তিনি। সম্প্রতি আমার অত্যন্ত স্নেহধন্য ও গুণী ভাই সুমন্ত্র সেনগুপ্তের ফেসবুক পেজে তাঁকে কেন্দ্র করে একটি খবর দেখে ভীষন আনন্দিত হই। সেই খবরের নির্যাস কিছুটা সুমন্ত্রর নিজের বয়ানেই জেনে নেওয়া যাক–”কয়েকমাস আগের এক বিকেলে চন্দনের ফোন। ও আর পলাশ উৎপলদার বাড়ি যাচ্ছে, উৎপলদার ওপর একটা তথ্যচিত্র করার ইচ্ছে নিয়ে। সন্দেহ উৎপলদা রাজি হবেন কিনা। ওদের ইচ্ছে আমি যদি একটু উৎপলদাকে ফোন করি। কেন জানিনা এই মানুষটার স্নেহ ও শাসন পেয়েছি সমানভাবে। তাই এমন অনেক কথা আমি উৎপলদাকে বলতে পারি, যা ওরা পারবে না এই ওদের বিশ্বাস। তারপর ফোন করা, উৎপলদাকে ‘না’ বলার সুযোগ না দেওয়া, কাজ শুরু হওয়া ও আমার নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া।”
এই আনন্দ সংবাদের আর একটু বিস্তারে যাওয়ার আগে চন্দনের কথা। চন্দনও আমার বহুদিনের পরিচিত স্নেহের ভাই, আদ্যন্ত শিল্পীমনা আর একজন অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক। তাঁর দুর্নিবার উৎসাহের জোয়ারে সকলেই ভেসে পড়তে বাধ্য হন। পলাশকে ব্যাক্তিগতভাবে চিনি না অথবা বিস্মৃত হয়েছি। হতেই পারে। এই জগৎটার সঙ্গে আমি বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পলাশের পরিচয়, যা সুমন্ত্রর লেখা তথ্যে পেয়েছি, সেটাই একটু জানিয়ে দিই এই অবকাশে। ব্রততী পরম্পরা ও শঙ্খমালার প্রযোজনায় পলাশের পরিচালনায় ‘এমন তরণী বাওয়া’ শিরোনামের তথ্যচিত্র উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলনে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্রের সম্মান লাভ করেছে। উৎপল কুন্ডুকে নিয়ে তাঁদের তথ্যচিত্র ‘অতএব উৎপল’ নির্মাণের প্রাথমিক ভাবনা যে সুফল ফলাবে, তাতে সন্দেহ নেই।
এবার যাঁকে নিয়ে এই প্রতিবেদনের উদ্যোগ, তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়। উৎপল কুন্ডুর জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর। মঞ্চে প্রথম আবৃত্তি ১৯৬৬ সালে। সহযোগী চিন্ময় নন্দীর সঙ্গে যুগ্ম প্রচেষ্টায় বাংলার প্রথম আবৃত্তি সংস্থা ‘ছন্দনীড়’ স্থাপন ১৯৭০ সালে। ‘ছন্দনীড়’ পরিচালনা করেন ১৯৭০-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। আবৃত্তি বিষয়ক প্রথম পত্রিকা ‘ছন্দনীড়’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৭২-১৯৮৮ সাল। ‘ছন্দনীড়’-এর ব্যানারেই প্রকাশিত আবৃত্তির ক্যাসেট ‘শুধু জাগবার ছন্দ’ ও ‘জীবন শিল্পী রবীন্দ্রনাথ : হে মহাজীবন’-এর পরিচালনা ও তাতে অংশগ্রহণ। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আবৃত্তি বিষয়ে গবেষণা করে চলেছেন ১৯৭০ সাল থেকে এযাবৎ। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছে আবৃত্তির ব্যাকরণ বই ‘আবৃত্তিচর্চা’। ওঁর প্রথম একক ক্যাসেট প্রেমের কবিতার আবৃত্তি ‘তোমাকে ভালোবেসে’ প্রকাশ পায় ১৯৯৬ সালে। আবৃত্তি বিষয়ক আলোচনাগ্রন্থ ‘আবৃত্তি করার আগে’ প্রকাশ ১৯৯৬-এ। উৎপল কুন্ডুর দ্বিতীয় একক ক্যাসেটে স্থান পেয়েছে জীবনানন্দের কবিতার আবৃত্তি ‘ধূসর ভুবন’, প্রকাশ ১৯৯৬ সালে। ২০০০ সালে প্রকাশ পায় তাঁর আবৃত্তি বিষয়ক আলাপচারিতার যুগ্ম ক্যাসেট ‘আবৃত্তি চর্চার আনন্দ’। আবৃত্তিচর্চা ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। সৃজনশীল আবৃত্তির ক্যাসেট ‘সৃষ্টির সৌরভ’ প্রকাশ পায় ২০০২-এ। ২০০৫-এ ধ্রুপদী কবিতার আবৃত্তির ক্যাসেট ‘চিরন্তনী’। আবৃত্তি শিক্ষার সিডি ‘আবৃত্তির নির্মাণ’ ২০০৮ সালে। ‘আশ্চর্য সম্পদ’ শিরোনামে আবৃত্তির ভিসিডি ২০১২ সালে। আবৃত্তিবিষয়ক প্রবন্ধের বই ‘আবৃত্তি নিষিদ্ধ হোক’ প্রকাশ পায় ওই একই বছরে। আবৃত্তির সিডি ‘বিচিত্রের নর্মবাঁশি’ ২০১৩ সালে। আবৃত্তি বিষয়ে প্রবন্ধ সংকলন ‘আবৃত্তির কথা’ ২০১৫-য়। ‘অখণ্ড আবৃত্তিচর্চা’ ২০১৭ সালে। এছাড়াও প্রকাশিত আবৃত্তি শিল্প না কি আবৃত্তির শিল্পতত্ব–সম্পর্কিত বই।
পেয়েছেন সমতট পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় শিরোমণি সম্মাননা ( টেরেকোটা), মঞ্জুলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিসম্মান, কাজী সব্যসাচী স্মৃতিসম্মান ২০১৯। আগ্রহীরা জেনে রাখুন, উৎপল কুণ্ডুর আবৃত্তি এবং আবৃত্তি বিষয়ক পাঠ পাওয়া যাবে ৪টি ইউটিউব চ্যানেলে–
১) উৎপল কুণ্ডু
২) কথা ও কবিতা, শিলিগুড়ি
৩) উচ্চারণ, কলকাতা
৪) পেখম রেডিও
এই মানুষটিকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা যে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই বিষয়ে সুমন্ত্রর অনুভবে আমরাও অনুভবী–”যতজন গুনী মানুষের সঙ্গে মিশেছি, উৎপলদা সবার থেকে আলাদা। শিল্পচর্চার মধ্যে যে আত্মক্ষয়ের গভীর আনন্দ থাকে, সেটা এই মানুষটাকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরাই জানবেন একমাত্র। কান ধরে সেটাই শিখিয়ে যেতে চাইছেন তিনি। কিন্তু কজন শিখলাম ? তাঁর এই আত্মক্ষয়ের আনন্দকে ধরতে চেয়েছি আমরা। আজ রোটারি সদনে ছবিটি প্রদর্শিত হবে। প্রদর্শনের দায়িত্ব নিয়েছেন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় রত্নাদি (মিত্র) ও তার দল বাক।” চন্দন মজুমদার, পলাশ দাস, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, পার্থ প্রতিম পান ও সুমন্ত্র সেনগুপ্ত–এই পাঁচ বন্ধু মিলে প্রযোজনা করেছেন ‘অতএব উৎপল’। এই কাজটার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নিতে পেরে এক গভীরতম আনন্দে ডুবে আছেন ওঁরা এই মুহূর্তে। এই মহানন্দের শরিক হতে শহরের বা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের আবৃত্তিপ্রেমীরা আজ যে রোটারি সদনে অবশ্যই যাবেন, একথা আগাম বলে দেওয়া যায়।