আভিজাত্যে, বাঙালিয়ানায় চির স্মরণীয়
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা, তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। বাংলার প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের জন্মদিন ছিল গত ১৩ জুলাই। আজ এই বিভাগে তাঁকে নিয়েই লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
যদি বলি, তাঁকে ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’ নির্মাণ সম্ভব ছিল না অথবা তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’–সুধীর মুখার্জির ‘দাদাঠাকুর’, বিকাশ রায়ের ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’ বা অজয় করের ‘অতল জলের আহ্বান’ ? বাঙালি দর্শক কোনওদিন কী ভুলবেন ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘বিপাশা’, ‘মানিক’, ‘সপ্তপদী’, ‘সবার উপরে’, ‘মায়ামৃগ’, ‘শশীবাবুর সংসার’, ‘লৌহকপাট’ বা ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ? আছে এমন অজস্র উদাহরণ। ভালো নাম ছিল শচীন্দ্রনাথ। কিন্তু মায়ের দেওয়া ডাক নামেই বিখ্যাত হন ছবি বিশ্বাস। শোনা যায় রূপবান পুত্রের চেহারার জন্যই মায়ের ওই নামকরণ। তা সুপুরুষ তো ছিলেনই তিনি। তারই সঙ্গে এক অনন্য প্রতিভা, মেধা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সিনেমার অভিজাত, দাম্ভিক, একরোখা একজন ‘বাবা’, কিছুটা টাইপকাস্ট, কিন্তু কী বিশ্বাসযোগ্য এবং অপ্রতিরোধ্য এক একটি চরিত্র !
আর সেইজন্যই আম দর্শক থেকে সমালোচক–ছবি বিশ্বাসের অনুরাগী সকলেই। পরাধীন দেশ, দেশের আর সব রাজ্যের মতোই ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সেই প্রভাব। সেই সময় যে পরিবারগুলি ইংরেজি শিক্ষার যথার্থ প্রয়োগের পাশাপাশি আপন বাঙালি ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তেমনই এক পরিবারে ছবি বিশ্বাসের বেড়ে ওঠা। তাঁর অভিনীত সমস্ত চরিত্রগুলির মধ্যে এভাবেই সচেতন, শিক্ষিত, অভিজাত এবং অবশ্যই এক শহুরে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব লক্ষ্য করি আমরা। তবে, দরকার মতো এই ইমেজও ভেঙেছেন তিনি। ‘দাদাঠাকুর’ এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

১৯৩১ থেকে ১৯৬২–এই ছিল তাঁর কাজের সময়কাল। হিসেব মতো ৩০/৪০টা ছবিই সই ! কিন্তু না। ছবি বিশ্বাস অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। এক এক বছরে ৩/৪ টি ছবি মুক্তি পেয়েছে তাঁর, এমন রেকর্ডও আছে। সংখ্যার কথা থাক ! ছবি বিশ্বাস অভিনীত ভালো ছবির শতাংশের হিসেবে আসি। অজস্র ছবির অধিকাংশতেই নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছেন তিনি। পর্দায় এতটাই প্রভাব বিস্তার করতেন এই শক্তিশালী অভিনেতা, যে, মনে হতো চরিত্রগুলি তাঁর জন্যই লেখা। একথা আমার নয়। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলেছেন, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, দেবী–সবগুলি ছবির কাহিনিই ছবি বিশ্বাসকে ভেবে লেখা। একটা দীর্ঘ সময় বাংলা ছবির পর্দায় যে অভিজাত চরিত্রগুলিকে আমরা দেখতাম, সেখানে মোটামুটি রাজত্ব করে গেছেন ছবি বিশ্বাস।
জন্ম ১৯০০ সালের ১৩ জুলাই। মৃত্যু ১১ জুন, ১৯৬২। এই যে আড়ম্বরহীন যাপন, তারকাসুলভ বৃত্তের বাইরে পা রাখা, মানুষের কাছাকাছি থাকা–এই সবই তিনি পান পৈতৃক সূত্রে। ছবি বিশ্বাসের বাবা ভূপতিনাথ বিশ্বাস খ্যাত ছিলেন তাঁর সমাজসেবামূলক কাজের জন্য। জন্মগ্রহণ উত্তর কলকাতার ধনী, শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক ও সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে। অথচ এমনিতে তাঁর জীবনযাপন ছিল একেবারেই অনাড়ম্বর। পরবর্তীকালে দক্ষিণ কলকাতার বাঁশদ্রোনি অঞ্চলে চলে আসেন তিনি। সখ ছিল বাগানের। বাড়ির সামনের পথ ধরে যেতে যেতে অনেকেই তাঁকে বাগানে কাজ করতে দেখেছে। শোনা যায়, ছবি বিশ্বাসের বাড়ির দরজা অবারিত ছিল সকলের জন্য, দুর্ঘটনায় তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।


হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর ছবি বিশ্বাস ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরে বিদ্যাসাগর কলেজে যান তিনি। এটা সেই সময়, যখন তাঁর অপেশাদার থিয়েটারে যোগদান এবং সেই সূত্রেই শিশির ভাদুড়ির সংস্পর্শে আসা। বাংলা থিয়েটারের এই কালপুরুষের সান্নিধ্যে আসাটা যে ছবি বিশ্বাসের জীবনে মাইলস্টোন, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিশির ভাদুড়ি হিরে চিনতে ভুল করেননি। এরপর মঞ্চে আরও কাজ এবং ‘নদের নিমাই’ নাটকে শ্রীগৌরাঙ্গের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ। এই কাজটার পরেই থিয়েটারপ্রেমী মানুষজনের হৃদয়ে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিলেন ছবি বিশ্বাস।
এরপর কিছুদিন অভিনয়ে বিরতি। যোগ দিলেন এক বিমা কোম্পানিতে। ব্যবসাতেও এলেন, পাটজাত পণ্য নিয়ে। কিন্তু সে আর কতদিন ? মঞ্চ যে ডাকছে ! ছবি বিশ্বাস ফিরে এলেন থিয়েটারে। শুরু হলো পেশাদার থিয়েটারে অভিনয়। প্রসঙ্গত, সিনেমায় সাফল্য পাওয়ার পরও মঞ্চ, যাত্রায় অভিনয় করে গেছেন ছবি বিশ্বাস। ১৯৩৬ সালে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবির মধ্য দিয়ে ছবি বিশ্বাসের সেলুলয়েড যাত্রার শুরু। সে সময় মঞ্চের অভিনয় ধারায় যে অতি অভিনয়ের চল ছিল, সেই প্রভাব সিনেমায় অভিনয় করতে আসা অভিনেতাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রকট ছিল। আর সেটাই স্বাভাবিক। থিয়েটার তখন বাংলা বিনোদন ও সংস্কৃতি থেকে বাঙালি সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। ছবি বিশ্বাসও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই নিজের অভিনয়ধারায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন তিনি এবং তুলনায় স্বাভাবিক বা যাকে আমরা সিনেমাটিক অভিনয় বলি, তার প্রকাশে নিজেকে বাংলা ছবির জগতে অপরিহার্য করে তোলেন।

নিউ থিয়েটার্সের নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন ছবি বিশ্বাস। তিনের দশকের শেষ থেকে সম্পূর্ণ চারের দশক টানা তাঁর জয়যাত্রা অব্যাহত রইলো। নায়ক ও চরিত্রাভিনেতা দুই হিসেবেই প্রথম সারিতে ছিল ছবি বিশ্বাসের নাম। মূলত দেবকী বসুর ‘নর্তকী’ ছবি থেকেই এক অতুলনীয় চরিত্রাভিনেতাকে পেল বাংলার দর্শক। সেই সময় পরপর যে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলিতে তিনি অভিনয় করেন–চোখের বালি, নিমাই সন্ন্যাস, প্রতিশ্রুতি, নর্তকী, অশোক, পরিণীতা, মাটির ঘর, দুই পুরুষ, বিরাজ বউ ইত্যাদি। এরপর বাংলা সিনেমায় এলো এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণ। স্বাধীনতার পর স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পথে বাংলা সিনেমা। সেই ঐতিহাসিক সময়েই সত্যজিৎ রায় তাঁকে নিয়ে ‘জলসাঘর’ নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন। সেটা ১৯৫৮ সাল। ১৯৬০-এ ‘দেবী’। ১৯৬২-তে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। এরই পাশাপাশি অন্যান্য পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেও এক একটি কালজয়ী ছবি নির্মাণের অংশীদার হয়ে রইলেন তিনি, যার কথা শুরুতেই বলেছি। ১৯৬০ সালে ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমী’ পুরস্কারে ভূষিত হন ছবি বিশ্বাস। ১৯৬২ সালে মোটর দুর্ঘটনায় মাত্র ৬১ বছর বয়সে মারা যান তিনি। রেখে যান অগণিত ছবিতে তাঁর চির স্মরণীয় অভিনয়ের স্বাক্ষর।
তথ্যসূত্র ইন্টারনেট
ছবি প্রাপ্তি : গুগল