Monday, February 3, 2025
তবু অনন্ত জাগে

আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর

জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। পড়ছেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কিশোরকুমারকে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক রচনা। লিখছেন অজন্তা সিনহা। আজ চতুর্থ পর্ব।

মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া থেকে দাদা অশোককুমারের সিনেমায় অভিনয়ের সূত্রে আভাসকুমার মুম্বই আসেন। এসে নিজেই নিজের নাম বদলে কিশোরকুমার রাখেন। দাদার সৌজন্যেই বম্বে টকিজ-এ যোগদান একজন কোরাস গায়ক রূপে। তিনিও অভিনয়কেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন, এমনটাই শুরুতে পরিকল্পনায় ছিল। তারপর বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ। ১৯৪৮-এ ‘জিদ্দি’ ছবিতে সংগীত পরিচালক খেমচাঁদ প্রকাশ সুযোগ দিলেন কিশোরকে ‘মরনে কি দুয়ায়েঁ কিঁউ মাঙ্গু’ গানটি গাইবার। এরপর বেশ কিছু ছবির অফার আসে তাঁর কাছে। কিন্তু, অভিনয়ের বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেননি তিনি তখন। পরে অভিনয় করেছেন, মূলত কমেডিয়ান রূপে, সেও অসাধারণ। তবু, নায়ক নয়, গায়ক হিসেবেই দুনিয়া জোড়া খ্যাতি পাবেন তিনি, যুগকে অতিক্রম করবে তাঁর গান, এটাই ছিল নিয়তি।

এরই মধ্যে গায়ক কিশোরের আর একটি প্রতিভা (প্রতিভা না কৌতুক ভাবনা, কী বলবো, জানি না) প্রকাশ পেল। ‘হাফ টিকেট’ ছবির গানের রেকর্ডিং চলছে। সলিল চৌধুরী সংগীত পরিচালক। গানটি লতা-কিশোর ডুয়েট। কোনও কারণে লতাজি শহরে ছিলেন না। এদিকে সলিলবাবুরও খুব তাড়া। কিশোর বললেন, কুছ পরোয়া নেহি। আমি পুরুষ-মহিলা দুই কণ্ঠেই গেয়ে দিচ্ছি। সেভাবেই রেকর্ডেড হলো গানটি। প্রাণ ও কিশোর অভিনীত একটি দৃশ্যের জন্য তৈরি গানটির রেকর্ডিং সমস্যা তো মিটলোই, ‘আকে সিধি লাগি দিল পে’ নামের সেই গান হলো সুপার ডুপার হিট। এর কিছুদিন পরই নিয়তি দেখালো তার খেলা। স্বয়ং শচীন দেববর্মণ খুঁজে নিলেন এক যুগান্তকারী প্রতিভাকে। আগে তার মুখবন্ধ।

১৯৫০ সালের কথা। ‘মশাল’ ছবির কাজকর্ম চলছে। এমনই একদিন শচীন দেববর্মণ গিয়েছেন অশোককুমারের বাড়ি। সেখানে তিনি শুনলেন কিশোরের গান। হিরে চিনতে দেরি হলো না জহুরীর। তখনও কিশোর প্রবলভাবে সায়গল প্রভাবিত। শচীন দেববর্মণ সেদিনই বলেছিলেন, কিশোরকে তাঁর নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে হবে। কে বলে কিশোর সঙ্গীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। কেরিয়ারের শুরুতেই যে সমস্ত সংগীত পরিচালকদের অধীনে তিনি গান গেয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই তো এক একজন দিকপাল। শচীন দেববর্মণ যে তাঁদের অন্যতম প্রধান, সে কী আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ? বলা বাহুল্য, শচীন দেববর্মণের পরামর্শ সেদিন থেকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন কিশোর। বাকিটা ইতিহাস, সেটা সকলেরই জানা। নিজস্বতা, স্বাতন্ত্র্যের নামই তো কিশোরকুমার। তাই তো আজও ওঁর বিকল্প মেলেনি। মিলবেও না।

Images 10 1 2
আমাদের কিশোর আমাদের কৈশোর 17

এখানে আর একটা কথা, শচীন দেববর্মণ নিজের মতো করে কিশোরকে কিছু প্রশিক্ষণ দিলেন শুধু নয়, দেব আনন্দের লিপে বেশ কয়েকটি ছবিতে গান গাইবার সুযোগও দিলেন। প্রসঙ্গত, শচীনকর্তার সুরে শুধু দেব আনন্দ নয়, আরও অনেক নায়কের লিপেই গাইলেন পরে কিশোর। কিন্তু পৃথকভাবে নিশ্চয়ই বলতে হবে দেব আনন্দের সঙ্গে কিশোরের যে ম্যাজিক তৈরি হলো, তার কথা। চিরন্তন রোমান্টিক গানে তাঁর যে এক সহজাত দক্ষতা ছিল, সেটা এই সময় থেকেই শ্রোতারা অনুভব করলেন। উল্লেখ্য, মুম্বই ও কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি চিরকাল শাসন করেছে যে বিষয়গুলি, তার মুখ্য ছিল/আছে প্রেম-বিরহ, মিলন-বিচ্ছেদের টানাপোড়েন। মূলত, শচীন দেববর্মণ-দেবানন্দ-কিশোর ত্রয়ীর বন্ডিংয়ে আমরা সেই অনুষঙ্গেই পেলাম ‘গাতা রহে মেরা দিল’, ‘ইয়ে দিল না হোতা বেচারা’, ‘শোকিয়োঁ মেঁ ঘোলা যায়ে’, ‘ফুলোঁ কে রং সে’, ‘জীবন কি বাগিয়া মেহেকেগি’ ইত্যাদি। এইসব গানেই কিশোর-লতা মঙ্গেশকর ডুয়েটের যুগও শুরু বলা যায়। অন্যান্য মহিলা শিল্পীদের সঙ্গেও ডুয়েট গেয়েছেন কিশোর। তবে, লতাজির সঙ্গে তাঁর জুটির গান অমর হয়ে আছে।

মোদ্দা কথা, মুনিমজি, ট্যাক্সি ড্রাইভার, ফান্টুশ, পেয়িং গেস্ট, চলতি কা নাম গাড়ি, গাইড, প্রেমপুজারী, জুয়েল থিফ, তেরে মেরে সপনে, তিন দেবিয়া ইত্যাদি ছবির মধ্য দিয়ে কিশোরের হাত ধরে শচীনকর্তার তত্ত্বাবধানে এক নতুন যুগের সূচনা হলো। এর মধ্যে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছিল কিশোরের হোম প্রোডাকশন। পাঁচের দশক থেকে সাতের দশকের শুরু পর্যন্ত, শচীন দেববর্মণ-কিশোরকুমার জুটি হিন্দি ছবির দুনিয়ায় সোনার ফসল উৎপন্ন করে গেছে, যা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। নায়ক বদলেছে, গায়ক এক ও অদ্বিতীয় কিশোরকুমার। রাজেশ খান্নার সুপার হিট ছবি ‘আরাধনা’ বা অমিতাভ বচ্চনের কেরিয়ারের অন্যতম সেরা দুটি ছবি ‘অভিমান’ ও ‘মিলি’ কিশোরের গান বাদ দিয়ে ভাবুন একবার পাঠক ! একই শিল্পী গাইছেন ‘রূপ তেরা মস্তানা’, ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’, ‘মিত না মিলা রে মন কা’ এবং ‘বড়ি সুনি সুনি হ্যায়’–এমন আর একটা নাম এ দেশের প্লেব্যাক সিঙ্গিং থেকে বেসিক গানের জগতে খুঁজে বের করা যাবে কী ?

(চলবে)

ছবি সৌজন্যে : গুগল