Monday, February 3, 2025
টলিউডলাইম-Light

আমার কাছে তিনি ঈশ্বর : ‘পালান’-এর মাধ্যমে সেই ঈশ্বরকে প্রণাম 

নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। মুক্তির অপেক্ষায় পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পালান’। বিশেষ সাক্ষাৎকারে তাঁর মুখোমুখি নির্মল ধর। 

‘পালান’-এর বীজ এবং অঙ্কুরোদ্গম কীভাবে হলো যদি বলেন।

◾পরিচালক মৃণাল সেনের অধিকাংশ ছবির আমি ভক্ত। তার মধ্যেও বিরাশি সালে, আমার কিশোর বয়সে ‘খারিজ’ দেখে সব যে বুঝতে পেরেছিলাম, তেমন নয়। কিন্তু কলকাতা শহরের একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি সংসারের যে বাস্তব জীবনটা তিনি দেখিয়েছিলেন, সেটা আমাকে ভয়ানক টেনেছিল। পরে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি ‘খারিজ’ কতো বড় মাপ ও জীবনের ছবি। আর একটু বড় হয়ে সিনেমা বানাতে বানাতে, মাঝে-মাঝেই মনে হতো, ওই ছবির অঞ্জন দত্ত, মমতাশংকর এখন কোথায় আছে, কেমন আছে ? ছবিতে ওরা বসার ঘরটা শুধু-শুধু বন্ধ রেখে কাজের ছেলে কিশোর পালানকে কেন সিঁড়ির তলায় অমন একটা আলোবাতাসহীন, অস্বাস্থ্যকর ঘরে শুতে দিত ? খুব ভাবতাম, অঞ্জন-মমতার চরিত্রগুলোর মধ্যে এখনও কী অপরাধবোধ কাজ করে ? কী করে তখন তারা ? এইসব ভাবনা থেকেই এই নতুন ‘পালান’-এর বীজ এবং অঙ্কুরোদ্গম। 

Img 20230911 Wa00382
আমার কাছে তিনি ঈশ্বর : 'পালান'-এর মাধ্যমে সেই ঈশ্বরকে প্রণাম  9

এই ‘পালান’ মৃণাল সেনের প্রতি কতটা শ্রদ্ধার্ঘ, কতটাই বা শতবর্ষে তাঁকে স্মরণ?

◾দুটোই বলতে পারেন! তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এদিক-ওদিকে ছোটখাটো অনুষ্ঠান, সেমিনার, ছবি দেখান হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছি। আমার কাছে মৃণাল’দার প্রায় প্রতিটি ছবিই আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের এক উদযাপন। তাঁর ছবিতে কখনও ওয়ালপেপার থাকে না। বিশাল খাট-পালঙ্ক দেখিনি। অতি সাধারণ ঘরদোর, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন দেখেছি। দেখেছি তাঁর চলচিত্র ভাবনার ও প্রকরণের মুন্সিয়ানা! তাই তাঁকে স্মরণে রেখেই এই ছবি। আমি তো আর সেমিনার, আলোচনা আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারি না! আমার নিজের মতো করেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বলুন, শতবর্ষ স্মরণ–যাইই বলুন, সেটাই করছি।

বাংলা সিনেমার এখনকার চালচিত্র স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেয়, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র ভাবনা থেকে বিষয়টা শত যোজন দূরে! এই অবস্থায় আপনি কোন প্রেক্ষিতে ভাবলেন তাঁকে স্মরণ করার কথা?

◾ আমি নিজে তাঁর চলচ্চিত্র শুধু নয়, জীবন-ভাবনা থেকেও কখনই যোজন দূরে নই, ছিলামও না! ওঁর জীবনদর্শন মনে রেখেই আমি ‘শব্দ’ তৈরি করেছি। ‘নগরকীর্তন’ বানাবার সময় সমাজের প্রান্তিক মানুষের কথা ভেবেই বানিয়েছি। আমার জীবনদর্শন ও চিন্তা-ভাবনা কখনই আমার নিজের চেনাজানা চৌহদ্দির বাইরে যায়নি! এখনও মাটিতেই রয়েছে আমার পা!

অনীক দত্তর ‘অপরাজিত’ কি কোনওভাবে আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে, এই ছবি বানানোর ক্ষেত্রে?

◾না। একেবারেই নয়। আমি তো জীবনী ছবি বানাইনি! সত্যজিতের মতো দেখতে অভিনেতা চাই।  তাঁর পরিচিতজনদের মতো শিল্পী নির্বাচন করতে হবে–এমন ভাবনা আমার ছিলই না! আমি তো ‘অপুর পাঁচালি’ করেছি অনেক আগেই! সেটাই আমার ট্রিবিউট তাঁকে! মৃণাল সেনের জীবনী বানাতে তো আমি চাইনি। তাঁর সমাজ ভাবনাকে এখনকার প্রেক্ষাপটে ধরতে চেয়েছি। আমরা কি সেই অতীতের পরিস্থিতি থেকে এগিয়েছি, নাকি পিছিয়েছি, নাকি একই জায়গায় পড়ে আছি–সেটাই দেখতে চাইছি।

Photo 2023 09 04 19 35 52
আমার কাছে তিনি ঈশ্বর : 'পালান'-এর মাধ্যমে সেই ঈশ্বরকে প্রণাম  10

মৃণাল সেন ‘খারিজ’-এ পালানের যে পরিণতি দেখিয়েছিলেন, আজকের পরিস্থিতিতে পালানদের সেই একইরকম পরিণতি হবে বলে মনে করেন? এক্ষেত্রে আপনার ভাবনা কী?

◾ আমার বিশ্বাস পালানদের পরিণতির তেমন কোনও হেরফের হবে না! হ্যাঁ এখন মোবাইল এসে গেছে হাতে হাতে। সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা এখন! কিন্তু, দুর্ঘটনার পর সেই লোকজন আসবে, ফিসফাস হবে। পুলিশ আসবে, তারপর মৃতের সৎকার হবে। শোকটাও একই থাকবে। পাল্টে যাবে শুধু সিনেমার সেট পাল্টানোর মতো। মানবিকতার ক্ষেত্র বদল হয়েছে, তেমন তো কোনও আভাস ইঙ্গিত দেখি না। বরং উল্টোটাই হচ্ছে। আমরা আরও বেশি স্বার্থপর হয়েছি। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি।

Img 20230911 Wa0040
আমার কাছে তিনি ঈশ্বর : 'পালান'-এর মাধ্যমে সেই ঈশ্বরকে প্রণাম  11

‘পালান’ ছবির কোন কোন চরিত্র এবং কোন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে আপনি অঞ্জন-মমতাদের দেখতে চাইছেন?

◾ অঞ্জন, মমতশংকর, শ্রীলা, হরি–মৃণাল’দার ছবির চারটি চরিত্র নিয়েই ‘পালান’-এ তাঁর প্রতি আমার শতবর্ষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন! সেই সময়ের মতোই এখনও পালানের বাবা মনিবের অবহেলায় তাঁর ছেলের মৃত্যুর বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ বা আন্দোলন করতে পারবে না। সেটা হয় না! ‘খারিজ’-এ পালানের বাবা যেমন বলেছিল “দরকার হলে বলবেন, আমার ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দেবো।” এখন কী সেই অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটেছে ? ঘটেনি। আমি আমার বাড়ির জানালা থেকে যত বাড়ি দেখতে পাই, জানি সেখানেও প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে অঞ্জন-মমতা-পালান-হরিরা আছে! বরং সমস্যা আরও কঠিন ও গভীর হয়েছে! বদলায়নি কিছুই!

আপনার কাছে মৃণাল সেনের কোন ছবি মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের বাস্তব ছবি তুলে এনেছে?

◾ আগেই তো বলেছি আমার কাছে ওঁর সেরা ছবি ‘খারিজ’। মৃণাল’দার ছবির টাইটেল কার্ডে কাহিনি-চিত্রনাট্য-পরিচালনা না লিখে, লেখা উচিত ছিল ঘটনা-চিত্রনাট্য-পরিচালনা ! তাঁর অধিকাংশ ছবিতে আদৌ কিছু গল্প বা কাহিনি থাকে কী ? না, তিনি কিছু ঘটনা দেখিয়ে যান শুধু ! হ্যাঁ, ‘খারিজ’ রমাপদ চৌধুরীর লেখা কাহিনি বটে ! অসাধারণ কাহিনি। কিন্তু ছবিতে শুধু ওয়ান লাইন স্টোরি! উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, উত্তেজনা আর কিছু বাস্তব অস্বস্তিকর মুহূর্ত…ব্যস!

‘পালান’-কে কী কোনওভাবে ‘খারিজ’-এর সিক্যুয়েল বলা যায়? আপনি কী মনে করেন?

◾ ওই পুরনো বাড়ির মতোই এখানে অঞ্জন-মমতার চরিত্ররা আছে। পালানও আছে! ইচ্ছে করলে এই ছবিকে ‘তারপর খারিজ’ও বলা যায় বা ‘খারিজ’ পরবর্তী ছবি। ওই চরিত্রগুলি ও ঘটনাপ্রবাহের ছায়া তো এখানে আছেই। দর্শক সেটা বুঝতেও পারবেন। সুতরাং সিক্যুয়েল বলতে পারেন বৈকি।

আপনি ব্যাক্তিগতভাবে তো বটেই, বাংলা সিনেমার লোকজনদেরও মৃণাল সেনকে তাঁর জন্মশতবর্ষে কীভাবে স্মরণ করা উচিত বলে মনে করেন?

◾ সত্যি কথা বলতে, মৃণাল সেনের কোনও ছবিই বক্স অফিস ওয়ান্ডার ছিল না। তাঁর ছবি দেখতে হুড়মুড়িয়ে শহরেও ভিড় হতো না। গ্রামের মানুষ গরুর গাড়ি করে তাঁর সিনেমা দেখতে আসতো না। আমার কাছে তিনি ছিলেন আমাদের সিনেমা জগতের সবচাইতে বেশি আধুনিকমনস্ক মানুষ। বিশ্বাসে কমিউনিস্ট, অথচ, অসম্ভব খোলা মনের ! সিনেমা তৈরির ব্যাকরণ নিয়ে ভয়ঙ্কর সাহসী। আমার কাছে তিনি ঈশ্বর। জীবনদর্শন দিয়ে তার প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি ছবিতে। এই ছবি দিয়ে ঈশ্বরকে আমি প্রণাম জানালাম। মন্দিরে গিয়ে আমরা ঈশ্বরকে প্রণাম জানাই, সেটাই তাঁর উদ্দেশে জানাচ্ছি আমি ‘পালান’ দিয়ে। অন্যরা কে কী করছেন বা করবেন, আমি জানি না! তবে ওঁকে নিয়ে আরও বড়মাপের কিছু করা উচিত বলে আমি মনে করি। শুধু উনি কেন, তপন সিনহার শতবর্ষও আসছে ! ওঁকে নিয়েও ভাবা জরুরি। আমার এই ছবি আশা করি দর্শকেরও ভালো লাগবে। তাঁর জীবন নয়, জীবনদর্শনকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি আমাদের ছবির মধ্যে–সেটাই হবে প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন!