ইন্দু, দ্বিতীয় সিজনের অপেক্ষায় দর্শক
লিখেছেন চয়নিকা বসু
শুধুমাত্র শক্তিশালী অভিনয়ের জোরে বাংলা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের একটা পাকাপোক্ত জায়গা খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলেছেন ইশা সাহা। হৈচৈ-এর ওয়েবসিরিজ ‘ইন্দু’ দেখতে দেখতে বুঝলাম সত্যি কতটা প্রতিভার অধিকারী এই কন্যা ! এরই পাশাপাশি এটাও ভাবছিলাম, একটি ছবি বা সিরিজে যখন নাম ভূমিকায় কেউ অভিনয় করেন, তখন তাঁর দায়িত্ব অলক্ষ্যেই কোথাও যেন বেশ কিছুটা বেড়ে যায়। বলতে দ্বিধা করবো না, ইশা সেই দায়িত্ব নিপুণভাবে পালন করেছেন।
ইশা বা অন্যান্যদের অভিনয় প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পটভূমি সৃষ্টির কথা, যা চমৎকার বিন্যস্ত সাহানা দত্তের লেখনীতে। ‘ইন্দু’-র গল্প ও চিত্রনাট্য অর্থাৎ কাঠামোটি বেশ মজবুত। পাশাপাশি কাহিনিতে বর্ণিত রহস্যের মায়াজাল পরিচালক সায়ন্তন ঘোষাল বুনেছেন নিবিড় এক মগ্নতায়। অপরাধ ঘটুক বা কোনও অস্বাভাবিকতা, একটি পারিবারিক চালচিত্রে সেটা ঠিক যেমন গতিতে এগিয়ে যাওয়া উচিত,সেই বাস্তবতা সম্পূর্ণ বজায় রেখেছেন সায়ন্তন। কোনও তাড়াহুড়ো করেননি। একটি ভেঙে যাওয়া বিয়ের চালচিত্র। সেই শূন্যতা, হাহাকার, লোকলজ্জা–এইসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে নতুন জীবনে পা রাখতে চলেছে এক তরুণী। বেশ ব্যতিক্রমী এক প্রেক্ষিত ও তার পরবর্তী চলন।
সিরিজ শুরু হয় এক অদ্ভুত পটভূমিতে। আজ ইন্দুর বিয়ে। বিয়েবাড়ির নানা স্ত্রী-আচার ইত্যাদির মধ্যেই আমরা চলে যাই ফ্ল্যাশব্যাকে। সেও ছিল ইন্দুর বিয়ের দিন। কিন্তু সে বিয়ে হতে পারেনি। হতে দেয়নি ইন্দুর ছোট বোন মিলি। মিলি পালায় ইন্দুর ভাবী স্বামী অঞ্জনের সঙ্গে। বরাবরই দিদিকে হিংসে করে সে। যাই হোক, সেসব ইন্দুর জীবনে অতীত। সত্যিই কী তাই ? অতীত যে দুস্মৃতির হাত ধরে বারবার হানা দেয় ইন্দুর জীবনে। নানা অনুষঙ্গে মনে পড়ে যায় অভিশপ্ত দিনটিকে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী। তার মধ্যেও ইন্দুর বিষণ্নতা কাটে না। অন্যদিকে দুশ্চিন্তায় প্রহর গোনেন ইন্দুর মা-বাবা। এবারটা যেন সব ঠিকঠাক হয় !
ইন্দুর বিয়ের তত্ত্ব এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। তত্ত্বের মাছের ভিতর ধুতরো পাতা। ইন্দুর ঠাকুমা বলেন, এই পাতায় তো বিষ ! শুধু এই নয়। আচারবিচারের অন্যান্য পর্ব বা উৎসব পালনের শুরু থেকেই নানা বিভ্রাট, বেশকিছু সন্দেহজনক ঘটনা ঘটে। মনে হয়, কেউ যেন বিয়েটা বন্ধ করতে চাইছে। ইন্দুর মনের অন্ধকার কাটে না কিছুতেই। কে এসবের পিছনে? ইন্দুর বাপের বাড়ির লোকজনের পক্ষে বিষয়টা নিয়ে নাড়াচাড়া করার পরিস্থিতি নেই। তারা আগেই বিপর্যস্ত, ইন্দুর ছোট বোন মিলির কাণ্ডে। তাদের একটাই ভয়। আগের বার কোনও মতে মিলির কান্ড চাপা দেওয়া গেছে। ইন্দুই সেবার মায়ের শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে বলেছে, বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে সে। এবার মানে মানে সব মিটে যাক ! কিন্তু মিটবে কী ? মিলি তার স্বামী অঞ্জনকে নিয়ে ইন্দুর বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসে। কিন্তু ইন্দুর বাবা জানান, তিনি মোটেই নিমন্ত্রণ করেননি মিলিকে। মিলির পাওয়া সেই বিয়ের কার্ডের ওপর তাহলে কার হাতের লেখা ?
বিয়ের পর অচেনা পরিবেশ। স্বামী সৌগতর সঙ্গে একটু একটু করে সম্পর্কের রসায়ন তৈরি করার চেষ্টায় ইন্দু। কিন্তু, ইন্দুর অতীতের জন্য প্রস্তুত ছিল না সৌগত। ফুলশয্যার রাতে ইন্দুর আগের বিয়ে ও তার ভেঙে যাওয়ার খবর শুনে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় তার। বাড়িতে আরও যারা আছে–ইন্দুর দেওর সুজাত, সৌগতর বড় দিদি খুশি, ছোট বোন পুষি ও তার স্বামী। দু’বোনের বাচ্চারা। রয়েছে সৌগতর জেঠা-জেঠি। সবাইকে এখনও দেখেনি ইন্দু। বিয়েবাড়ির নানা কর্মকান্ডের মধ্যেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইন্দুর পরিচয় হতে থাকে। দেওর সুজাত খুব ভালো ব্যবহার করে ইন্দুর সঙ্গে। অন্যদিকে জানা যায়, খুশি মানসিক বিকারগ্রস্ত। তাকে তালাবন্ধ ঘরে আটকে রাখা হয়। মিলি সমানে সৌগতর সঙ্গে যোগাযোগ করে মিলি আর অঞ্জনের বিয়ের গল্প শোনায়, যা আদতে হয়ইনি।
ইন্দু একেবারে হতভম্ব হয়ে যায় একের পর এক অস্বাভাবিক ও রহস্যময় ঘটনায়। সুজাতর যে বিয়ে হয়েছে ইতিমধ্যেই সেটা সে জানতে পারে বাড়ির কাজের মেয়ে সুন্দরীর কাছে। কিন্তু কোথায় সে, সুজাতর স্ত্রী লাবনী ? সবাই সব চাপা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইন্দু দমবার পাত্রী নয়। রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। এরইমধ্যে খুন হয় লাবনী। আর সেই খুনের সমাধানের দায়িত্ব সুজাত দেয় ইন্দুকে। আপাতত এই পর্যন্ত দেখেছে দর্শক। ‘ইন্দু’-র প্রথম সিজন শেষ হয় অনেক না জানা প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়। লাবনীকে কে খুন করে, খুশিকেই বা কে এই অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে, ইন্দুর অতীত, সৌগত বা সুজাতও কী ঠিকঠাক ? মিলির ভূমিকা–এইসব জানার জন্য স্বাভাবিকভাবেই উদগ্রীব দর্শক। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় সিজন আসবে এইসব উত্তর নিয়েই।
ইশা সাহা ছাড়াও অভিনয় করেছেন চন্দ্রনিভ মুখোপাধ্যায়, সুহত্ৰ মুখোপাধ্যায়, পায়েল দে, মানালি দে, মানসী সিনহা প্রমুখ। প্রত্যেকেই যথাযথ। এরই মধ্যে আলাদা করে সৌগতর মায়ের চরিত্রে ছাপ রাখেন মানসী। পায়েল দে’র খুশিও চমৎকৃত করে। প্রথম সিজনে রয়েছে টানটান ৮টি পর্ব। গত অক্টোবরে ‘ইন্দু’-র প্রিমিয়ার হয়। সঙ্গে সঙ্গেই হিট। রেটিং বেশ ভালো। সার্বিকভাবে যত্নের একটা ছাপ মেলে এর নির্মাণে। বিনীতরঞ্জন মৈত্রের মিউজিক ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর পৃথকভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথম পর্বের শুরুতে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার অবস্থা ফুটিয়ে তোলার সহায়ক হয়। ‘ইন্দু’-র ক্যামেরার কাজ ও এডিটিং, হেয়ার ড্রেসিং ও মেকআপ, সেট ডিজাইন থেকে প্রতিটি পর্বের ডিটেলিং নিখুঁত। শেষে আবারও ইশার কথা। তাঁকে কেন্দ্র করেই পর্বগুলি আবর্তিত। অভিনয়ের ব্যঞ্জনায় প্রতি পর্বেই চোখ টেনে রাখেন তিনি।