Monday, May 12, 2025
তাহাদের কথাদর্পণে জীবন

উত্তরের রীতা আর দক্ষিণের মায়া

ঘুম ভাঙলেই ওঁদের সঙ্গে দেখা। আমাদের রোজকার জীবনে নানারূপে আছেন ওঁরা। কখনও মিষ্টি মুখে, কখনও ঝুটঝামেলায় দিনগুলি কাটে ওঁদের সঙ্গে। সেই অম্লমধুর কথকতা এই কলমে। পড়ুন চয়নিকা বসুর কলমে।

“কেমন কইরা আসুম দিদি ? মাইয়াটার বাচ্চা হইসে। ওর শরীলটাও ভালো না। ঘরে আর কেউ নাই। ছোট মাইয়াটা চায়ের ঠেলা সামলাইতাসে। ওইটা বন্ধ রাখলে খাওন জুটবো না। আপনে কদিন কষ্ট কইরা চালাইয়া নেন”–একদমে কথাগুলো বলে, আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দেয় রীতা। বলা বাহুল্য, ইনি আমার গৃহস্থালীর সাহায্যকারী। আমাদের সকলের ঘরেই আছেন এমন এক একজন রীতা, যাঁদের ছাড়া প্রায় অচল আমরা।

আপাতত আমায় আক্ষরিক অর্থেই এই অচল অবস্থায় ফেলে নাতনির সেবায় মেতে যায় রীতা। আমি অথৈ জলে হাবুডুবু খাই। এই যে নির্ভরশীলতা, এর পিছনে অনেক কারণ। সেইসব বিস্তারে না গিয়ে, একটি নিয়েই আলোচনা করবো আজ। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমার এক পুরোনো পরিচারিকা মায়ার কথাও। সে গল্পে পরে যাচ্ছি। উত্তরবঙ্গে আসার পর শুরুর দিনগুলো আমি সাহায্যকারী ছাড়াই চালাই বেশ কয়েকটি দিন। বাইরের কাজ ছিল না বললেই চলে। ঘরেও যদি বসে থাকি, হাত-পা অচল হয়ে যাবে। তাই একাই সামলে নিতাম।

তারপর ধীরে ধীরে নানা শারীরিক সমস্যা উদয় হলো। বিশেষত, অতিমারী কালে কিছুটা হতাশার থেকেই বোধহয়। হাঁটুর ব্যাথা বাড়লো। আরও নানা উপসর্গ। তারপর রীতার খোঁজ পেলাম। সে বহাল হওয়া ইস্তক আমাকে তার ওপর নির্ভরশীল করে ফেললো। রীতা ছোটখাটো চেহারার এক গৃহবধূ। তার স্বামী তাকে ছেড়ে অন্য মহিলার সঙ্গে ঘর বেঁধেছে। ছেলে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে আর মাকে মানে না। বড় মেয়ে স্বামীসহ তার ঘাড়ে। এখন তো তাদের বাচ্চাও হয়েছে। ছোট মেয়েটি সদ্য কৈশোর পার করেছে। এখনও অবিবাহিত। রীতার একটি চায়ের দোকান আছে। দোকান বলতে ঠেলা। সেটা সে, তার জামাই, ছোট মেয়ে–পালা করে চালায়। তার মাঝে আমার জন্যও একটু সময় বের করে নেয় সে। আর্থিক টানাটানিতে অভ্যস্ত রীতা। নানা সামাজিক বঞ্চনার পরও অসম্ভব সৎ সে। চোখ বন্ধ করে তাকে বিশ্বাস করা যায়। রীতা বা ওদের মতো মানুষদের প্রতি নির্ভরতার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই।

এবার মায়ার কথা। এটা কলকাতায় থাকাকালীন গপ্পো। মায়া খুব জ্বালাতো আমায়। কিছুটা তার স্বভাব। কিছুটা পরিস্থিতি। আমি গড়িয়া অঞ্চলে থাকতাম। সেখান থেকে নিয়মিত মধ্য কলকাতার অফিসে আসা। সকালে খুব তাড়া। মায়া প্রায়ই এত দেরি করতো যে বেশিরভাগ দিনই আমার রুটিন থেকে ব্রেকফাস্ট বাদ চলে যেত। ঘরের কাজটাও মনমতো হতো না। মায়ার সঙ্গে নিত্য অশান্তি লেগেই থাকতো। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার যে অঞ্চল থেকে মায়া আসতো কলকাতায়, তার দূরত্বের ভৌগোলিক মাপ আমি জানি না। কিন্তু ঘন্টা দু-আড়াই ট্রেন সফর বাধা ছিল তার। সেই ট্রেন পরিষেবার ওপরই নির্ভর করতো মায়ার গন্তব্যে পৌঁছনোর রুটিন। পাঁচ/ছ’টি বাড়িতে কাজ করতো সে। হাজার বলেও, একটি কাজও ছাড়াতে পারিনি তার, যাতে আমার বাড়ি সে একটু সঠিক সময়ে আসতে পারে। তার যুক্তি, “যতদিন শরীরে খেমতা আছে, টাকা রোজগার করে নিতে হবে। আমাদের তো আর তোমাদের মতো পেনশন নেই গো।”

মায়ার স্বামী বেকার। ছোট ছেলেটা বাউন্ডুলে।  বড়গুলো বিয়ে-থা করে পৃথক হাঁড়ি। মায়া অমানুষিক পরিশ্রম করে সংসার চালাতো। সঙ্গে স্বামীর চিকিৎসা। তার স্বামী অসুস্থ, কিন্তু মানুষ খারাপ ছিল না। মায়াকে যত বকতাম, তত বিবেক যন্ত্রনায় ভুগতাম। মায়াকে নিয়েও আমার একই উপলব্ধি। এত জ্বালা-যন্ত্রনা সয়েও কী করে এত সৎ থাকে মায়ার মতো মানুষরা। উত্তরবঙ্গের রীতার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের মায়া মিলেমিশে এক হয়ে যায়–সততার অতুলনীয় দৃষ্টান্তে।

◆ ছবি : প্রতীকী