একাকী গায়কের নহে তো গান…
জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে ওঁরা আজ বহু আলোকবর্ষ দূরের এক জগতে। তবু আছেন ওঁরা আমাদের মাঝে। থাকবেন চিরদিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা জগতের সেইসব মানুষ, যাঁদের অবদান ছাড়া অসম্পূর্ণ আমরা। তাঁদের নিয়েই এই বিশেষ কলম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মদিবস ছিল গত ৯মে। এই উপলক্ষে আজ থেকে শুরু হলো ‘তবু অনন্ত জাগে’-র বিশেষ পর্ব। বিষয় ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত : অনুধাবন ও পরিবেশন’। এই বিষয়ে এই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পীদের ভাবনাসমৃদ্ধ প্রতিবেদন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে। আজ অপালা বসু সেন। অনুলিখন অজন্তা সিনহা।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু নয়, সব ধরণের গানের ক্ষেত্রেই অনুধাবন অত্যন্ত জরুরি। অনুধাবন বিনা পরিবেশন অসম্পূর্ণ। আর অনুধাবনের জন্য চাই যথাযথ প্রশিক্ষণ। অনেকগুলি দৃষ্টিকোণ থেকেই এ বিষয়ে বলা যায়। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গুণগত ও পরিমাণগত দিক নিয়ে কথা বলা। আমাদের প্রজন্ম বা তারও আগের প্রজন্ম থেকে যে বর্তমানে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার প্রচার ও প্রসার বহুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হতে পারে, রেকর্ড, ক্যাসেট বা বর্তমানে সিডিও প্রায় অবলুপ্তির পথে। তবুও, গানের সংখ্যার বিরাম নেই। ইউটিউবেই এখন রোজ শত সহস্র গান শুনতে পাই।
গান তো গাওয়া হচ্ছে। কিন্তু শ্রোতা ? একজন শিল্পীর মতোই শ্রোতাও এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেই শ্রোতার কান, বোধেরও বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে শ্রবণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দর্শন। ‘নির্জন এককের’ গান রবীন্দ্রসংগীত। শুধু কর্ণগোচর ক’রে আনন্দে ভেসে থাকার মতো শ্রোতা এখন দুঃখজনকভাবে প্রায় নেই বললেই চলে। সবই মিউজিক ভিডিও। রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে নিজের জীবনকে অর্থনৈতিক ভাবে চালিয়ে নিয়ে গেছেন অতীতেও অনেকেই। গান, সাহিত্য, রেকর্ড কোম্পানী, রবীন্দ্র গবেষণামূলক বই, সংগীত পরিবেশন, শিক্ষণ–কত পেশা জড়িয়ে এই একটি অসীম সমুদ্রকে কেন্দ্র করে–যাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু এখন যেন কোয়ালিটির দিকটি কিছু কিছু জায়গায় অগ্ৰাহ্য করে পুরোপুরি একটি ব্যবসায় পর্যবসিত করা হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতকে।
এর জন্য অনেক কিছুই হয়তো দায়ী। তবুও আমি বলব, শ্রোতার কান তৈরি হওয়া দরকার। ‘একাকী গায়কের নহে তো গান, গাহিতে হবে দুইজনে…’, এই আর একজন যিনি ‘গাবে মনে’, তাকেও তো সজাগ হতেই হবে। মেধা, মনন, ও ন্যূনতম ভাবনা থাকতে হবে। সবরকম মোহমুক্ত হয়ে এই গানের নিরাবরণ, নিরাভরণ অথচ অতল গভীরে ডুব দেওয়ার মানসিকতাও তো থাকা দরকার। অসংখ্য শিল্পী, বহুমাত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা (যার মধ্যে খুব কম সংখ্যকই সফল), ব্যবসায়িক মনোভাব, জনমনোরঞ্জন, অকারণ ফিউশন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনী প্রচার–এ সব কিছুই রবীন্দ্রসংগীতের এসেন্সটুকুর পরিপন্থী।
আমি শুধু বিশুদ্ধতার কথা বলব না, কারণ বিশুদ্ধতা বলতে অনেকে শুধু স্বরলিপির কচকচানি বোঝেন। আমি তা বলি না। স্বরলিপি কখনও গানের প্রাণসঞ্চার করে না। কিন্তু, প্রাণসঞ্চারের জন্য তাকে এড়িয়ে গিয়ে, তার ওপর রঙ চড়ানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করি না আমি। আসল কথা হলো, সবরকম বাংলা গানেরই তো একটা নিজস্ব মহিমা আছে। রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রে তা বড়ই একান্ত, বড়ই নিভৃত। যে রসবোধ এই গানকে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ বলে চিহ্নিত করে, সেই রসবোধেরই যেন অভাব ঘটছে। তাই খুব ভয় হয়, রবীন্দ্রনাথের গানের সম্প্রচার যতই বাড়ছে, বাড়বে, এর মূল নির্যাসটুকু হারিয়ে যাবে না তো ?
যদিও এটাও বিশ্বাস করি, যা শাশ্বত, তা কোনও দিনই একেবারে হারাবে না। হয়তো মুষ্টিমেয় শ্রোতার কাছে তার প্রকৃত মূল্যায়ণ হবে। তাঁর গান যে সর্বত্রগামী হয়নি বা হবে না, একথা রবীন্দ্রনাথও জানতেন। বলে গেছেন, ‘ভালো জিনিস কম বলিয়াই তাহা ভালো’। এখনও কোনও প্রতিযোগিতায় গিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গলায় অপূর্ব গান শুনি, মুগ্ধ হই। এখনও তো তাদের মনে প্রচার সর্বস্বতার প্রলেপ লাগেনি। তাই এত পবিত্র, এত খাঁটি। তাই এ গানের ভবিষ্যৎকে ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিতেই হবে। যাঁরা প্রকৃত জহুরী তাঁরা জহর চিনতে ভুল করবেন না। পরিপূর্ণ শিল্পকে কোনও বিকৃতিই যে স্পর্শ করে না!
** মতামত লেখকের নিজস্ব