এক অনির্বচনীয় দিনের স্মৃতি
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার সুবাদে কাছে যাবার সৌভাগ্য হয়েছে সংগীত জগতের বহু গুণী মানুষের। তাঁদের নিয়েই এই বিভাগ পড়ুন অজন্তা সিনহার কলমে। আজ কিংবদন্তী মান্না দে‘র কথা।
আপনি কেন আরও রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন না ?– প্রশ্নটা করা মাত্রই পরিবেশটা কেমন দ্রবীভূত হয়ে গেল। একটু আগের প্রবল দাপুটে, চরম ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষটি অভিমানী শিশুর মতো চোখ মুছে ধরাগলায় বললেন, “আমায় গাইতে দেওয়া হয়নি জানেন ?!” অকুস্থল কলকাতার হেদুয়ার কাছের একটি প্রাচীন বাড়ি। ঐতিহাসিকও বলা চলে। বাংলাগানের দু’দুজন প্রবাদপ্রতিম মানুষ এ বাড়ির ঐতিহ্যের ইতিকথা লিখেছেন–কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ও ভাইপো মান্না দে। সেটা রবীন্দ্রসংগীতের কপিরাইট নিয়ে বাড়াবাড়ির সময়। বাড়াবাড়ি এই জন্যই বললাম, বহু গুণী ও যোগ্য শিল্পীকেই এ বাবদ আশাহত হতে দেখেছি আমরা সেদিন। এমনকী বাদ যাননি রবীন্দ্রসংগীতের সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসও।
ফিরে আসি মান্না দে’র কথায়। মান্না দে’কে রবীন্দ্রসংগীত তাঁর আবেগ ও আগ্রহ মেনে গাইতে না দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে শ্রোতাদের। আজ কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর যথেচ্ছাচার আটকানোর কেউ নেই। শ্রোতারা কিন্তু আজও আছেন। তাঁরাই গ্রহণ ও বর্জন করছেন। বাড়ির সামনে ছোট্ট এক চিলতে বসবার ঘরে মান্না দে’র মুখোমুখি আমি। প্রবল শীতের এই প্রভাত আমার জীবনেও এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত রচনা করলো। যে কোনও সাংবাদিকের জীবনে এমন এক মুহূর্ত হয়তো একবারই আসে। আর তারপর সে তাকে তুলে রাখে সিন্দুকে। আজ সিন্দুক খুলে কিছু সম্পদ ভাগ করে নেব পাঠকের সঙ্গে।
কথা ছিল দশ মিনিট কথা বলবেন। সেটা কথায় কথায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিল, আজও মনে আছে। কত কথা ! আপনার বিরহের গানগুলি সবচেয়ে বেশি হিট–প্রশ্ন করতে না দিয়ে হোহো করে হেসে উঠে বললেন, “তার মানেই আমি প্রচুর প্রেমে দাগা খেয়েছি, তাই তো ?” অপ্রভিত আমাকে তারপরেই বললেন, “এ প্রশ্ন সব সাংবাদিকই করেন আমায়। মজা হলো, আমার জীবনে বিরহ/টিরহ নেই। আমি একজনকেই ভালোবেসেছি–সুলোচনা। তাকেই বিবাহ। আমাদের অত্যন্ত সুখী দাম্পত্য-জীবন। আর কৃতিত্বের পুরোটাই সুলোচনার প্রাপ্য।” স্ত্রী বিয়োগের পর কতটা একা ও অসহায় হয়ে যান তিনি, সে প্রসঙ্গ সকলেরই জানা।
গানের বাণী ও উচ্চারণ প্রসঙ্গে বরাবর ভীষণ মরমি তিনি। এই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই, “আমার কাছে গানের কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রুচিসম্মত এবং অর্থবহ না হলে, গাইতে রাজি হইনা আমি। গানটা অনুভব করে গাইতে হবে তো ? কথা যদি আমাকে স্পর্শ না করে, সেটা শ্রোতাকে স্পর্শ করবে কীভাবে ?” শাস্ত্রীয় সংগীতে মান্না দে’র দীর্ঘ চর্চার কথা সকলেরই জানা। কী অবলীলায় এক-একটি কঠিন সুরের গান গেয়েছেন তিনি। বাংলা, হিন্দি তো বটেই ভারতের অন্যান্য বেশ কয়েকটি ভাষাতেও গাইতে পারতেন তিনি।
মুম্বইতে খুবই সম্মানীয় একজন শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছেন তিনি বরাবর। সেই মুম্বইয়ের কথা উঠতেই উনি উচ্ছ্বসিত হলেন কিশোরকুমার প্রসঙ্গে–”কিশোরদা একজন অসাধারণ শিল্পী। ঈশ্বরের বরপুত্র যাকে বলে! কী কন্ঠ ! কী অনায়াস চলন ! ওঁর সঙ্গে ‘এক চতুর নার…’ গাইতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম কিশোরদের ক্ষমতা। আমাকে খেটে, চেষ্টা করে যেটা আয়ত্তে আনতে হয়, কিশোরদের কাছে সেটা সহজাত।” মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম এক শিল্পী সম্পর্কে অপরজনের শ্রদ্ধাপূর্ণ মন্তব্য। আজ দুজনের কেউই নেই। কিন্তু কথারা থেকে গেছে।
কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে’র প্রতি ওঁর অসীম শ্রদ্ধার কথা বারবার বলছিলেন–”কাকা না থাকলে আমি এই আজকের মান্না দে হতে পারতাম না। ওঁর কাছেই আমার সংগীতের হাতেখড়ি। কাকার জন্যই বাড়িতে সংগীত জগতের রথী-মহারথীরা আসতেন। সে এক অপূর্ব দিন !” পরবর্তীকালেও বাংলা ও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের গুণী শিল্পীদের সংস্পর্শে এসেছেন নানাভাবে। বেসিক গান থেকে সিনেমায় প্লে-ব্যাক–একাধিক গুণী গীতিকার ও সুরকারদের সঙ্গে ওঠাবসা। দিকপাল সেইসব ব্যক্তিত্বের সাহচর্যে তাঁর সংগীত জীবন গড়ে উঠেছে, জানান দ্বিধাহীন চিত্তে।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম তাঁর গল্প। ‘কথা অমৃত সমান’ কেন বলে উপলব্ধি করছিলাম। ‘আপনি’ সম্বোধনে শুরু করেছিলেন কথা ! কেন ? নাকি বয়সে যত ছোটই হোক মহিলাদের উনি ‘আপনি’ ছাড়া সম্বোধন করেন না। প্রনামও নাকি নেন না। সেই মানুষটি কথার শেষের দিকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেন, আমি তাঁর বড়মেয়ের বয়সী জেনে। প্রনামও নেন। মাথায় আশীর্বাদের যে হাতটা রাখেন সেদিন, সেই হাতে একজন অসীম স্নেহময় মানুষের ছোঁয়া ছিল। অথচ ওঁর কাছে যাবার আগে কী ভয়ই দেখিয়েছিল সবাই–ভীষণ দাম্ভিক আর মুডি। দেখো কথাই বলবেন না। তাদের যাবতীয় ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যে প্রমাণিত হলো। ফিরলাম এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা ঝুলিতে পুরে।