এক গৃহী সাধকের কাহিনি ‘রামপ্রসাদ’
আকারে ছোট হলেও বিনোদন ক্ষেত্রে টেলিভিশনের গুরুত্ব আজ অসীম। মেগা থেকে রিয়ালিটি, গেম শো থেকে ম্যাগাজিন–টিভি শোয়ের চাহিদা ছিল, আছে, থাকবে। এই বিভাগে তারই খবর প্রতি সপ্তাহে। স্টার জলসায় শুরু হয়েছে ‘রামপ্রসাদ’। তারই সাংবাদিক সম্মেলনের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন সোমনাথ লাহা।
পরিবারে থাকা একজন মানুষ, যাঁর আকুতি শুধুমাত্র মা কালীকে খোঁজা। আর সেই খোঁজের মধ্য দিয়েই মুক্তিপথের সন্ধান করা। প্রায় তিনশো বছর আগে অষ্টাদশ শতকের এমনই এক হিন্দু শাক্ত কবি ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। মা কালীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা, মা-কে নিয়ে গান বাঁধা, সুর করা, কবিতা লেখা। সবমিলিয়ে অন্তর থেকে শ্যামামায়ের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা-আকুতির এই কাহিনি এবার উঠে এসেছে স্টার জলসার পর্দায়। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন মেগা ধারাবাহিক ‘রামপ্রসাদ’। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সব্যসাচী চৌধুরী, যিনি ইতিপূর্বেই জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’-এ সাধক বামাক্ষ্যাপার চরিত্রে অভিনয় করে রীতিমত প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়েছেন দর্শকমহলে।
বাঙালি বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করা রামপ্রসাদকে ঘিরে রয়েছে বহু প্রচলিত কাহিনি। একইসঙ্গে নানা উত্থান-পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সমাজে ক্ষমতার পরিবর্তনের সময়ের সাক্ষী তিনি। তাঁর প্রাণময় গানের সুরমূর্চ্ছনা একসময়ের অশান্ত বাংলায় নিয়ে এসেছিল অপার শান্তি। তাঁর লেখা কবিতা ও গান ‘রামপ্রসাদী’ নামে সুপরিচিত। আজও তাঁর গানের কথা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সুর সমান আবেদনময়। লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে গানগুলি। পেয়েছে অকুণ্ঠ প্রশংসা। ধারাবাহিকের প্রযোজনার দায়িত্বে রয়েছে সুরিন্দর ফিল্মস। পরিচালনা করেছেন অমিত সেনগুপ্ত। চিত্রনাট্য লিখেছেন ঋতম ঘোষাল। ধারাবাহিকটির যাবতীয় গবেষণাধর্মী কাজ তথা রিসার্চের দায়িত্বটি সামলেছেন শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রসঙ্গত, ইতিমধ্যেই বড়পর্দায় পাঁচের দশকে রামপ্রসাদের জীবনী নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘সাধক রামপ্রসাদ’ নামে একটি ছবি। বংশী আশ পরিচালিত জনপ্রিয় সেই ছবিতে রামপ্রসাদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিতে রামপ্রসাদের যাবতীয় গানগুলি গেয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। এবার রামপ্রসাদের জীবনী নিয়ে তৈরি ধারাবাহিকে তাঁর সাধনকর্মের পাশাপাশি তুলে ধরা হবে সেই মানুষটির কাহিনি, যিনি মা কালীর প্রবল ভক্ত হলেও একজন স্বামী ও পিতা হিসেবেও সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এক অর্থে পিরিয়ড পিস এই মেগার মধ্যে রয়েছে ভক্তিরস ও মাইথোলজির ছোঁয়া। রামপ্রসাদ একজন পরিবার নিবেদিত প্রাণ মানুষ। তাঁর সংসার বলতে স্ত্রী সর্বাণী এবং সন্তানরা। রামপ্রসাদের ভক্তির যাত্রাপথে তাঁর যোগ্য সহধর্মিনী হিসেবে পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তা করেন সর্বাণী।
মেগায় সর্বাণীর ভূমিকায় দেখা যাবে সুস্মিলি আচার্যকে। দশম শ্রেণীর ছাত্রী সুম্মিলি ছোট বয়স থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। ইতিমধ্যেই তাকে দেখা গিয়েছে ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’, ‘সৌদামিনীর সংসার’, ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি উত্তরপর্ব’-তে। ধারাবাহিকে মা কালীর ভূমিকায় রয়েছেন পায়েল দে। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন অনিন্দ্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়ক চক্রবর্তী, চন্দ্রনীভ মুখোপাধ্যায়, জয়িতা গোস্বামী প্রমুখ। মেগায় সংগীত পরিচালনা করেছেন দেবজিৎ রায়। ধারাবাহিকটিতে টাইটেল সং হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ডুব দে রে মন কালী বলে’ গানটি। সেটি গেয়েছেন শান্তনু মুখোপাধ্যায় ওরফে শান। কলকাতায় স্টুডিওর পাশাপাশি মেগার শুটিং হয়েছে পুরুলিয়াতে।
সম্প্রতি উত্তর কলকাতার লাহাবাড়িতে আয়োজিত সাংবাদিক সন্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মেগার পরিচালক সহ মুখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী ও যাবতীয় কলাকুশলীরা। ধারাবাহিকটিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে সব্যসাচী বলেন, “আমি মনে করি এই ধরণের চরিত্র একজন অভিনেতা তার জীবনে একবারই পায়। এরজন্য আমি কৃতজ্ঞ স্টার জলসা ও সুরিন্দর ফিল্মসের কাছে। কারণ, তারা আমাকে এই ধরণের সুযোগ বারবার দিয়েছেন। এই ধারাবাহিকটি অনেক দিনের পরিকল্পনা, একনিষ্ঠ রিসার্চ ওয়ার্কের ফল। হঠাৎ করেই পুরো বিষয়টা শুরু হয়ে যায়নি। বহু বিশিষ্ট মানুষজন এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন। সবাই নিজের ১০০ শতাংশ দিয়ে, খেটে কাজটা করেছেন। আশা করি দর্শকদের এই ধারাবাহিক ভাল লাগবে।”
“আজ থেকে আনুমানিক তিনশো বছর আগে রামপ্রসাদ প্রমাণ করতে পেরেছিলেন সংসারে থেকেও মা কালীকে পাওয়া যায়। তাঁর রচিত গানগুলো শুনলেই বোঝা যায়, রামপ্রসাদের মনের অবস্থা ঠিক কী ছিল। তিনি যে সবসময় মা-কে দেখতে পেতেন তা নয়, তিনি মা-কে অনুভব করতে পারতেন। সবসময় তিনি মনে করতেন মা তাঁর সঙ্গে রয়েছেন, বিভিন্ন বিপদ থেকে তাঁকে রক্ষা করছেন। এমনই ছিল মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক”–বিশ্লেষণে প্রাঞ্জল সব্যসাচী।
সুস্মিলির কথায়, “খুব ভালো লাগছে কাজটা করে। এটা আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। অনেক নতুন নতুন জিনিস জানতে পারছি, শিখতে পারছি। এই ধরণের চরিত্র ফুটিয়ে তোলাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে, মজা করেই কাজটা করছি। ইতিহাসে যে ধরনের বিষয়গুলো পড়েছি,তার সঙ্গে রিলেট করতে পারছি। রামপ্রসাদ আর সর্বাণীর দাম্পত্য জীবনটা আর পাঁচটা স্বাভাবিক দাম্পত্যের মতো ছিল না। রামপ্রসাদ মা কালীর ভক্ত ছিলেন। সর্বাণী তাঁর সেই ভাবটা বুঝতে পেরেছিলেন। সর্বাণী আর রামপ্রসাদের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা ছিল। সর্বাণী নিজেও মা কালীকে বিশ্বাস করতেন। তাঁর চোখে মা কালী একজন সাধারণ মানুষ, দেবী নন। কারণ মা তাকেও সাহায্য করেছেন, তবে, দেবীরূপে নয়, সাধারণ মানবী হয়ে।”
মেগার গবেষক শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “রামপ্রসাদ কোনও অবতার নন। তাঁর কোনও অলৌকিক ক্ষমতা ছিল না। মূল বিষয়টি হলো একটা অনুসন্ধান, পাওয়ার আকুতি। একটি মানুষ মা কালীকে খোঁজার মধ্যে দিয়ে মুক্তির পথের সন্ধান করছে। সেটা খুঁজতে গিয়ে যে ঘটনার মধ্যে পড়ে তাঁর জীবন এগোয় সেটাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।” এই ধারাবাহিকে যে রামপ্রসাদী গানের ব্যবহার বহুলভাবে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। মেগার সংগীত পরিচালক দেবজিৎ জানান, “রামপ্রসাদী গানের কথা আজও প্রাসঙ্গিক। সুরের আবেদন চিরকালীন। গানগুলির সঙ্গে খোল, পাখোয়াজের মতো বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করে ওই সময়টাকে ধরতে চেয়েছি।” স্টার জলসায় ‘রামপ্রসাদ’ দেখান হচ্ছে সোম থেকে রবি, প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায়।