এক সকালে সবরমতি আশ্রমে
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। প্রাচীন ভারতের হারিয়ে যাওয়া অসাম্প্রদায়িক, মানবিক বন্ধনের রূপটি আহমেদাবাদে আবিষ্কার করে আপ্লুত হয়েছিলাম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা। তিনপর্বের ভ্রমণ রচনার দ্বিতীয় পর্ব আজ।
গত সপ্তাহে শেষ করেছিলাম নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম প্রসঙ্গে। প্রাচীন আর নবীন যেন হাত ধরাধরি করে চলে এই শহরে। আধুনিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন স্টেডিয়ামের পাশাপাশি সমান গুরুত্বে রক্ষিত গৌরব ও ঐতিহ্যের ইতিহাস। আদতে, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এ শহর। তেমনই এক ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এখানে আসা অবধি অপেক্ষায় ছিলাম, কবে সেই ইতিহাসের মুখোমুখি হবো। অবশেষে এলো সেই ক্ষণ। এক ঝকঝকে নির্মল সকাল। ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য গান্ধী আশ্রম বা সবরমতি আশ্রম। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধী কোচরাব থেকে এখানে স্থানান্তরিত করেন তাঁর আশ্রম।
সবরমতি সাবার্ব, আশ্রম রোডের কাছে সবরমতি আশ্রম। নদীর নামেই নামকরণ। সবরমতির তীরেই অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর স্বাধীনতা আন্দোলন, তাঁর জীবন ও আদর্শের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত এই পুণ্যভূমি। তথ্য বলছে, এখান থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন গান্ধীজী। প্রাচীন ইতিহাস আশ্রমের সর্বত্র। সুখের কথা, সৌন্দর্যায়নের অজুহাতে আশ্রমের পুরোনো চেহারায় হাত দেয়নি গুজরাত সরকার। প্রবেশ করার পর যে অনুভূতিটা হয়, ইতিহাসও যেন থমকে দাঁড়িয়ে প্রণত এখানে। ঢোকার মুখেই চোখ টেনে নেয় দেওয়ালে খোদিত সেই ছবি, যা এককথায় ভারতাত্মার প্রতীক। হাতে লাঠি, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, একটু ঝুঁকে চলা। এই স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়েই বিশ্ব মানচিত্রে নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
বিরাট এলাকা জুড়ে গাছপালায় ঘেরা প্রাঙ্গণ। ঝকঝকে, পরিচ্ছন্ন। প্রচুর পাখি আর কাঠবিড়ালি, তারা বড়ই নিশ্চিন্তে বিচরণরত। পাখিরা তবু কিছুটা ওপরে, তাদের নাচানাচি গাছের ডালে, পাতার আড়ালে। কাঠবিড়ালিরা একেবারে নির্ভয়ে কাছে চলে আসে। সমগ্র পরিবেশেই অপার শান্তি। দর্শকরাও তার শরিক। কোথাও কোনও হট্টগোল নেই। পুরো আশ্রম ঘুরে দেখলাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কক্ষগুলি। প্রাচীন স্থাপত্যের মাঝে ইতিহাস গুঞ্জরিত। সাদা আর ঘিয়ে রঙের দেওয়াল ও ছাদ। পুরোনো আমলের কড়িবরগা, বড় বড় জানালা। খুব সুন্দরভাবে বিষয় অনুসারে বিন্যস্ত রয়েছে ছবি ও নিদর্শন–দেওয়ালে টানানো রয়েছে কাগজে ছাপা ফ্রেমে বাঁধানো ঘটনাপ্রবাহ, সাল-তারিখ মেনে।
যেটা নিবিষ্টভাবে লক্ষ্য করলাম, মহাত্মা গান্ধীর কর্ম ও জীবনে কস্তুরবার প্রভাব। যথার্থই অর্ধেক আকাশ হয়ে ছিলেন তিনি মহাত্মার জীবনে। দেখলাম, একটি বারান্দায় চরকা নিয়ে বসে কাজ করছেন দুজন মহিলা। কথা বলে জানলাম, ওঁরা নিয়মিত আসেন। কর্মী হিসেবে আসা-যাওয়া করেন আরও অনেকেই। চরকায় সুতো কাটা, কাপড় তৈরির কাজটি এখনও সমান গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে চলছে এখানে। আশ্রমের মধ্যেই সেসব বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে। এছাড়াও আছে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম। ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত হয়ে বসলাম গাছের ছায়ায়। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো সুন্দর বসার জায়গা। সবরমতি বয়ে চলেছে আশ্রমের শরীর ঘেঁষে। শান বাঁধানো পাড়ে রোদ্দুর ঝলকায়। সূর্য মাথার ওপর উঠেছে। এবার ফিরতে হবে। সামান্য দূরত্বের পথ। সবে ফেব্রুয়ারির শেষ। গাড়ির কাঁচ নামানো। অন্দর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তবু ঘেমে উঠি। স্বাভাবিক। চওড়া পথের দুপাশ শুনসান। সবুজের লেশমাত্র নেই। এমনিতেই উষ্ণ এই শহর, তার ওপর গাছপালাবিহীন হয়ে গেলে পথিকের পক্ষে কষ্টদায়ক তো হবেই।
পরদিন গিয়েছি খুড়তুতো বোনের বাড়িতে। প্রচুর খাওয়াদাওয়া আর ভরপুর আড্ডা হলো। ফেরার পথে একটি কালী মন্দির পড়ল। অঞ্চলটির নাম বোপাল। মন্দির যেমন হয়, এটা তেমনই। আদলে দক্ষিণেশ্বরের কালী মূর্তি। ছিমছাম, সুন্দর পরিবেশ। দূর প্রবাসে মা কালীর মন্দির ও মূর্তি দেখে কেমন একটা ঘরের অনুভূতি হয়। এই আবেগটা নিশ্চয়ই সঙ্কীর্ণতা নয়! আহমেদাবাদ শহরে প্রচুর বাঙালি, যেমন দেশ-বিদেশের সর্বত্রই আছেন। এই কালী মন্দির শুধু তাঁদের নয়, সব রাজ্যের মানুষেরই ভক্তির কেন্দ্রে আছে। আর সেই ভক্তি ও ভালোবাসার স্বীকৃতিতেই বোধহয় মন্দির সংলগ্ন ৩ কিমি রাস্তার নামকরণ হয়েছে কালী মন্দির রোড, যার উদ্বোধন করেন আহমেদাবাদের মেয়র স্বয়ং।
বিশেষ দ্রষ্টব্যগুলি দেখার মাঝেই একদিন কেনাকাটার জন্য গেলাম ন্যাশনাল হ্যান্ডলুমে। জামাকাপড়, উপহার সামগ্রী, জাঙ্ক জুয়েলারি থেকে গার্হস্থ্য জীবনযাপনের যাবতীয় উপকরণ হাজির সেখানে। শপিং মল তেমন টানে না আমায়। সেই আমিও মুগ্ধ এখানে এসে। কারণ রাজ্যের শিল্প সম্ভারকে কী নিপুণ ভাবনা ও যথাযথ পরিকাঠামোয় এক ছাদের নিচে এনেছেন এঁরা। বাণিজ্যে বাণিজ্য হলো, আবার শিল্পের প্রচার ও প্রসারও হলো। সংস্কৃতিকেও তুলে ধরা গেল। আর কী নিপুণ ব্যবস্থাপনা ! এত বড় শপিং কেন্দ্র। ছোটবড় প্রচুর দোকান। বিশাল সংখ্যক ক্রেতা ঘোরাঘুরি করছেন। কিন্তু কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই।
প্রসঙ্গত, আহমেদাবাদের ‘অটো ওয়ার্ল্ড ভিন্টেজ কার মিউজিয়াম’টি অসাধারণ। ইতিহাস আছে এখানেও। সেকালের ধনী ও সৌখিন রাজরাজড়া, জমিদার থেকে ব্যবসায়ী, সকলের গাড়ি ব্যবহারের একটা নমুনা পাবেন। সময়াভাবে আমার অবশ্য দেখা হয়নি। দেখা হয়নি ‘গুজরাত সায়েন্স সিটি’ও। সময়ের অনেকটা রাখতে হয়েছিল আত্মীয়দের জন্য। এঁদের সকলের সঙ্গেই দীর্ঘ বছরের অদর্শন ! ভাই-বোন, ভাইপো-ভাইঝি, তাদের সূত্রেই নাতি-নাতনি–সে এক লম্বা তালিকা। পাঠক মাফ করবেন, কিছু ব্যাক্তিগত অনুভূতি ভাগ করে নেওয়াটা স্বতস্ফূর্ত ভাবেই ঘটে। আপনজনদের সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর মিলিত হওয়ার যে আবেগানুভূতি, তা দ্রষ্টব্য দেখে বেড়ানোর থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না সেই সময় আমার কাছে !
ভোজনরসিক তো বটেই, যে কোনও পর্যটকের জন্যই আকর্ষণীয় গুজরাতের ‘মানেক চক’। দিবারাত্র খোলা এই বাজার। বেশ মজাদার এই বাজারের বিকিকিনি। বিক্রিবাটার ক্ষেত্রে সকালে মেলে সবজি, দুপুরে জরি আর রাতে খাবারদাবার। এটি হলো, যাকে বলে, স্ট্রিট ফুডের স্বর্গ। স্থানীয় ভাষায় নাইট মার্কেট ইটস। পুরোনো আহমেদাবাদের একটা ঝলক খুব সহজেই পাবেন এখানে। পাওয়া যায় গুজরাতের নানা আঞ্চলিক খাবার থেকে শুরু করে পাও ভাজি, স্যান্ডউইচ, পিৎজা, দোসা, ইডলি এবং কুলফি। কিছু পুরোনো হিরের গহনার দোকান আজও রয়েছে মানেক চকে। আর আছে সবরমতি রিভারফ্রণ্ট। নদীর ওপর দিয়ে সেতু বরাবর বাঁধানো পথ, পার্ক, যা-ই বলি। নতুন প্রযুক্তির অভিনব প্রয়োগ, তরুণ প্রজন্মের জন্য যা অবশ্যই বেশ আকর্ষণীয়। (চলবে)