এবার যাত্রা গঙ্গামাইয়ার দেশে
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ লখনউ-এলাহাবাদ-বেনারস ঘিরে চলছে এই ভ্রমণ ধারাবাহিক। লিখছেন লিপি চক্রবর্তী। আজ তৃতীয় পর্ব।
আনন্দ ভবন ও স্বরাজ ভবন দেখার পরও মনে হচ্ছিল, এলাহাবাদকে যেন ঠিক পুরোপুরি দেখা হলো না। কী যেন বাদ পড়ে গেল ! নতুন যমুনা ব্রিজ হয়েছে, সেটা দেখা হলো না। প্রয়াগের যে রূপ এর আগের পূর্ণকুম্ভ দেখতে এসে পেয়েছিলাম, তার সঙ্গেও এবারের মিল পেলাম না। আসলে দোষ আমাদেরই। আমরা এলাহাবাদ দেখার জন্য মাত্র দুটো দিন রেখেছিলাম। আবার কোনওদিন আসব এখানে নিজেকেই নিজে কথা দিলাম।
এবার যাতায়াত ও থাকার জায়গা প্রসঙ্গে কিছু তথ্য। এখানে কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের থাকার জায়গাটি বেশ ভালো। এছাড়াও আছে প্রচুর হোটেল। রামকৃষ্ণ মিশনেও থাকার ব্যবস্থা আছে। খরচ সাধ্যের মধ্যেই। হোটেলের চেক ইনের সময় অনুযায়ী বিভূতি এক্সপ্রেস বা মুম্বই মেল ভায়া এলাহাবাদ সব থেকে ভালো। এছাড়াও আরও ট্রেন আছে কলকাতা থেকে।
শুধু এদিক ওদিক যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় একটু যাচাই করে নেবেন চালককে। নয়তো গাড়িতে ওঠার পর দুটো সংলাপ শুনতে পাবেন–’কাঁহা যানা হ্যায়, জিপিএস অন করো’ এবং ‘মালুম নেহি’। এইসব যাবতীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এবং নিজের কাছে আবার আসার প্রতিশ্রুতি রেখে এবার আমরা চললাম বারাণসীর দিকে।
ছোট থেকে শুনে আসছি ‘গঙ্গার পশ্চিম কুল বারাণসী সমতুল’। তাই মানুষ নাকি গঙ্গার পশ্চিম কুলে বসতি স্থাপন করতে পারলে ধন্য হয়। বিকেল চারটে নাগাদ আমরা এসে পৌঁছলাম সেই পুণ্যধাম বারাণসীতে। আমাদের এবারের সফরে সব থেকে বেশি সময় এখানে বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু প্রথমেই একটি বিশাল হোঁচট। ফোনের ম্যাপ অন করে আমরা হোটেলের দরজা খুঁজছি। ম্যাপ বলছে আর পঞ্চাশ মিটার দুরত্বেই হোটেলের অবস্থান। কিন্তু যেদিক দিয়েই পৌঁছনোর চেষ্টা করছি, পুলিশ গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে, ‘ইধারসে রাস্তা বন্ধ’ ব’লে। শেষ পর্যন্ত গাড়ি ছেড়ে রিকশা নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দেখি, আমরা মোটামুটি আর তিরিশটা স্টেপ ফেললেই গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকে পড়তাম। দুর্ভোগ থাকলে যা হয় আর কি!
বারাণসীতে আমাদের সাময়িক বাসস্থান গোধূলিয়া মোড়ের একদম কাছাকাছি। সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে বিশ্বনাথ মন্দিরে। ডানদিকের রাস্তা গিয়েছে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। রাস্তায় লেখা ফলক অনুযায়ী দুটো আকর্ষণই এক কিলোমিটারের কম দূরত্বে। তবে যেখানে থাকা বা যে রাস্তায় আসা–সেটাকে কলকাতার বড়বাজারের একটি অবিকল প্রতিরূপ বলা যেতে পারে। পোশাক পরিবর্তন আর উদরের দাহ মিটিয়ে সন্ধের সময় পথে নামলাম কাল ভৈরবের মন্দিরে যাব বলে। আমাদের এক বন্ধু বলে দিয়েছিল, বারাণসীতে গিয়ে প্রথমেই কালভৈরব দর্শন করে তাঁর কাছে নাকি জানাতে হয়, ‘আমরা বারাণসী দর্শনে এসেছি। ভালো ভাবে দর্শনের অনুমতি দাও। সম্ভব হলে ফেরার পথে তোমায় আবার দর্শন করে যাব’।
আমরা তেমন ঈশ্বরবিশ্বাসী নই বটে। কিন্তু, কতশত বছর পুরোনো এই দেবমন্দির ঘুরে আসতে আপত্তি থাকার কোনও কারণ নেই। বারাণসী মন্দিরময় স্থান জেনেই তো আসা। বিশ্বাসে মিলায়…। যাই হোক, কালভৈরবকে মনে করা হয় এই পৃথিবীর ‘কোতোয়াল’ (chief police officer)। জন্ম এবং মৃত্যুর (কাল) ধারক। প্রতিটি মানুষের এবং দেবতারও টিকে থাকা তাঁরই অনুমতি সাপেক্ষ। এক হাতে তাঁর ব্রহ্মার পঞ্চম মুণ্ড এবং অপর হাতে একগুচ্ছ ময়ূরের পালক। মানুষের পাপ খণ্ডনের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের নির্দেশে তাঁর বারাণসীতে বাস।
এখানে জানাই, কালভৈরবে পুজো দিয়ে ফেরার পথে সেই বন্ধুরই নির্দেশিত দোকানে মন এবং জঠর শান্ত করা রাবড়ির স্বাদ নিতে ভুল হয়নি আমাদের। পরদিন খুব সকালে পৌঁছলাম বিশ্বনাথ মন্দিরে। বারাণসীর অবস্থান নাকি শিবের ত্রিশূলের ওপর। ত্রিশূলের তিনটি ভাগ হল কালভৈরব, বিশ্বনাথ এবং খিচুড়ি কেদার। বিশ্বনাথ মন্দিরে যথেষ্ট ভিড় এবং সিকিউরিটির সাংঘাতিক কড়াকড়ি সত্বেও পুজো দেওয়ার জন্য ঠেলাধাক্কা নেই। বিশাল চত্বর পরিষ্কার ঝকঝকে। লাইন সুশৃখল। মনপ্রাণ ভরে দর্শন এবং পুজো সারা গেল।
জগৎ পিতার দর্শন সেরে পাশেই মা অন্নপূর্ণার মন্দিরে গেলাম। পুরাণে দেবী অন্নপূর্ণার কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে এই স্থানে ভবানীগৌরীর মন্দির ছিল বলে জানা যায়। যেটি কাশীর অন্যান্য অনেক মন্দিরের মতো বিভিন্ন শত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে এই মন্দিরটি অন্নপূর্ণা (দেবী পার্বতীর এক রূপ) মন্দির বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। মায়ের এক হাতে হাতা এবং অপর হাতে অন্নের বাটি। দূর থেকে পুজো এবং দর্শন সারা যায়। এখানে পুরোহিতের ঝোলায় দেওয়া কিছু কাঞ্চন মূল্যের বিনিময়ে মায়ের কোলে শাড়ি মিষ্টি ইত্যাদি রেখে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, একটু বাড়তি শান্তি পেয়েছিলাম। কারণ, এই অর্থ প্রতিদিন প্রচুর মানুষের অন্নসেবায় ব্যয় হয়। আমরাও এখানে অন্নগ্রহণ করেছি পরে–কুপন সংগ্রহ করতে হয় শুধু।
ফেরার পথে দশাশ্বমেধ ঘাটে আরতির সময় এবং গঙ্গার ঘাট ঘোরানোর জন্য নৌকা ভাড়া জেনে এলাম। কিন্তু বিকেল চারটের সময় গিয়ে, জানা আর বাস্তবের মধ্যে বিরাট ব্যবধান দেখে সব গোলমাল হয়ে গেল। সিঁড়ির ধাপে সার সার প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। সেই চেয়ারে সামনে বসার জন্য অনুদান আদায় হচ্ছে। ভাড়া নয় কিন্তু! তবে ওখানে বসে আরতি দেখা সম্ভব বলে মনে হলো না। যাই হোক, গঙ্গার ঘাট ঘোরার জন্য এবং গঙ্গার বুক থেকে আরতি দেখব আশায় নৌকা ভাড়া করা হলো। নৌকা আমাদের অসি ঘাট পর্যন্ত ঘুরিয়ে এনে যখন দশাশ্বমেধ ঘাটের সামনে দাঁড়াল আরতি দেখার জন্য, তখন অনেকগুলি যাত্রীভর্তি নৌকাও এসে ভিড়েছে সেখানে।
এইসময় কিছু রক্ষী (খাকি পোশাক পরা) নৌকা চেপে এসে বেছে বেছে কয়েকটি নৌকাকে কিছুতেই দাঁড়াতে দিল না। এর মধ্যে আমরাও আছি। পাড়ে নামতে বাধ্য হলাম। তখন দোতলা সমান উঁচু কয়েকটি নৌকা থেকে ডাকাডাকি শুরু করেছে, নাকি মাথাপিছু দুশো টাকার বিনিময়ে উঁচুতে চেয়ারে বসে গঙ্গা আরতি দেখা যাবে ! এক জীবনে আর ক’বার বারাণসী আসা হবে! তাই এভাবেই আরতি দেখা ঠিক করলাম। তবে এই সব হেনস্থা মনে রইল না, যখন গঙ্গা আরতি শুরু হলো। শাঁখে ফুঁ দিলেন পূজারী। আহা, এমন দৃশ্যকেই তো স্বর্গীয় বলে! গুরুগম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণ, লক্ষ প্রদীপের আলোয় আলোকিত চারদিক। এমন এক সন্ধ্যার জন্য একজীবন অপেক্ষা করা যায়।
রাতে আর এক অভাবনীয় দৃশ্য যে অপেক্ষা করছে, আগে বুঝিনি। আগাম বুকিং অনুযায়ী বিশ্বনাথ মন্দিরে ঠাকুরের শৃঙ্গার আর ভোগ আরতি দেখতে গেলাম রাত সাড়ে নটায়। ফুলের সাজে সাজানো হলো বাবা বিশ্বনাথকে। তারপর আরতি। ভোগ দিলেন পূজারী। একঘণ্টা যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেল। এরপর ভোগের পাত্র নিয়ে পূজারী মূল মন্দির থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়ালেন। যতজন উপস্থিত ছিল, আমরা সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে ভোগের প্রসাদ পেলাম। কী আনন্দ যে হচ্ছিল তা বর্ণনাতীত।
পরদিন যাব ইতিহাস আর ভক্তি–দুটোরই খোঁজে। তার আগে কিছু জরুরি তথ্য। কলকাতা থেকে অনলাইনে অথবা বারাণসী পৌঁছে ‘সুলভ দর্শন’ বুকিং করে নিতে পারেন। তাহলে অনেক বড় লাইনে দাঁড়াতে যাঁদের কষ্ট হয়, তাঁদের বাবা বিশ্বনাথ দর্শনে সুবিধে হয়। এছাড়া আরতি বুকিংও অনলাইনে হয়। আপনার সুবিধে অনুযায়ী সময় বুক করতে পারেন। কলকাতা থেকে বহু ট্রেন যায় বারাণসী। লিস্ট দেখে বুকিং করে নিন। হোটেলের চেক আউট ১১টা, চেক ইন ১২টা। সেই বুঝে ট্রেন নির্বাচন করে টিকিট কাটুন। থাকার জন্য গোধূলিয়া মোড়ের কাছে সাধ্যের মধ্যে অনেক হোটেল আছে। অনলাইনেও বুকিং হয়। ওখানে থাকা সুবিধেজনক। একটু বেশি আরামদায়ক হোটেল হলে শহরের বাইরের দিকে হবে। (চলবে)
ছবি : লেখক