এসো হে বন্ধু গানে গানে…
নিজস্ব প্রতিনিধি
২০১১ সালের ২০শে আগস্ট ‘গণসংগীত সংগ্রহ’ শিরোনামে একটি গ্রুপ তৈরি হয় ফেসবুকে। উদ্দেশ্য, হারিয়ে যাওয়া ও নতুন গণসংগীত আদানপ্রদান ও নতুন করে সংগ্রহ করার একটা উদ্যোগ নেওয়া। গণসংগীতের পরিবেশনা, নির্মাণ ও সংগঠিত করার প্রচেষ্টায় যুক্ত বহু মানুষ দ্রুত এই গ্রুপের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। অনেক পুরোনো গান সংগৃহীত হয়। তেমনি নতুন নতুন গণসংগীত এই গ্রুপের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এটা অস্বীকার করা যাবে না, গণ চেতনাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক কর্মীরা বাংলা তথা গোটা ভারতেই বহুধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই পুরোনো বিভেদ ভুলে, হাতে হাত ধরে চলার প্রয়োজন অনুভব করতে শুরু করেন। অনেকেই হয়তো অতীতেও ঐক্যবদ্ধভাবে চলার কথা ভাবতেন। কোনও কারণে, হয়ে ওঠেনি। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তাঁদের সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার পথকে ত্বরান্বিত করেছে। ঠিক এই ভাবনাকেই আঁকড়ে ধরে, শুধু গণসংগীত নয়, গণসংগীত শিল্পীদের ভাবনাকে একত্রিত করতে পরিপূরক ভূমিকা পালন করার পথেই ‘গণসংগীত সংগ্রহ’ গ্রুপের উত্থান ও এগিয়ে যাওয়া।
২০১৩ সালের ১৭ই নভেম্বর কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে এই গ্রুপের উদ্যোগে গণসংগীত শিল্পীরা মিলিত হয়ে গানে ও কথায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেন। সেখানে অনেকে ব্যাক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন, অনেকে নিজেদের সংগঠনের পক্ষ থেকে উপস্থিত হন ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তী বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি ঘরোয়া সভা হয় এইসব বিষয় নিয়ে আরও এগিয়ে যেতে। ২০১৫ সালের ২৮শে নভেম্বর দেশবন্ধু পার্কে খোলা মঞ্চে সলিল চৌধুরীকে স্মরণ করে আয়োজিত হয় আবার একটি গণসংগীত শিল্পীদের মিলিত অনুষ্ঠান–’এখানে থেমো না’।
এরপর ২০১৯ সালের ২রা জুন কলকাতার বিধাননগরের রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে আয়োজিত হয় ‘বিরুদ্ধতার গান’ শীর্ষক গণসংগীতের অনুষ্ঠান। ২০২০ সালের মে দিবসে ও পরে আগস্ট মাসে চারদিন ধরে সজীব সামাজিক মাধ্যমে আয়োজিত হয় গণসংগীতের অনুষ্ঠান, ‘ঘুম ভাঙ্গার গান’। এগুলো ছাড়াও এই গ্রুপের উদ্যোগে নানা প্রতিবাদ সভা, পদযাত্রা, যুদ্ধ বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ করা হয়। এই ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও এটা বলা যাবে না, যে লক্ষ্য নিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল, সেই চলা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলেছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতা তো আছেই। উদ্যোগেও জোয়ার ভাটা আছে, থাকে, বাস্তব কারণেই।
আজ সারা দেশ জুড়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের উপর আক্রমণ আরও তীব্র হয়েছে। সর্বত্র সমাজ সচেতন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বাধা আসছে। মানুষের মত প্রকাশের, আপন ভাবনা প্রকাশের অধিকার খর্ব হচ্ছে। শিক্ষা ব্যাবস্থায় অনৈতিক হস্তক্ষেপ করে পাঠ্য বিষয়ে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, মানুষের চিন্তার জগতকে বিপথে চালিত করার জন্য। ক্রমাগত ভারতের ইতিহাস নিয়ে বিকৃত কাহিনির প্রচার চালানো হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনকে ভ্রান্ত পথে নিয়ে গিয়ে সমাজের উন্নতিকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে।
মানুষের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে, জাতপাতের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। হিংসা আর লাগামহীন দুর্নীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। এই পরিস্থিতিতে সমাজ সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মীরা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। তাঁদের সমস্ত রকম সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে হাতে হাত ধরতেই হবে। ফ্যাসিবাদী শক্তি, দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরাচারী শক্তির আক্রমণ প্রতিহত করে পথ দেখাতে শতফুল বিকশিত আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হতে হবেই। সামাজিক মাধ্যমের প্রচারের সাথে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও নিজেদের কথা বলতে হবে।
এই ভাবনাতেই দীর্ঘ অতিমারি পর্ব কাটিয়ে আবার ‘এসো হে বন্ধু গানে গানে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে গণসংগীত শিল্পীরা কলকাতার রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে মিলিত হচ্ছেন আগামী ২৪শে আগস্ট, বিকেল ৫টায়। বাংলা সংস্কৃতি জগত অতিমারী কালেই কোভিডের ছোবলে হারিয়েছে গ্রুপের তথা বাংলার গণসংগীত জগতের অন্যতম শিল্পী, সুরকার শ্রদ্ধেয় অনুপ মুখোপাধ্যায়কে। আমরা হারিয়েছি বাংলার কিংবদন্তি গীতিকার-সুরকার শ্রদ্ধেয় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনিও ছিলেন সংগঠনের অন্যতম উপদেষ্টা ও গ্রুপের সদস্য। এঁদের এই সন্ধ্যায় স্মরণ করা হবে। তার সঙ্গেই স্মরণে উল্লেখিত হবে ১৯৭০ সালে বাংলার ছাত্র আন্দোলনের শহীদ অসীম গাঙ্গুলির নাম। অসীম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এই অনুষ্ঠানের আয়োজনে অন্যতম সহযোগী। অনুষ্ঠানে শুধু বিভিন্ন গণ সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরাই যোগ দিচ্ছেন না, যোগ দেবেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেশ কয়েকজন নবীন শিল্পীও। কথায়-গানে সাজানো এই অনুষ্ঠানে প্রবেশ অবাধ। সমস্ত সমাজ সচেতন মানুষ সামিল হবেন এমন এক উদ্যোগে, প্রত্যাশিত এটাই।