এ কোন শ্রীকান্ত !
মৃণালিনী ঠাকুর
সাহিত্যের সিনেমা রূপায়ন দেখেছি আমরা সিনেমার আদি যুগ থেকেই। একটা সময় ছিল, অধিকাংশ বাংলা ছবি ছিল সাহিত্যনির্ভর। পাশাপাশি রেডিও নাটক। আকাশবাণীর কল্যাণে অসংখ্য সাহিত্য নির্ভর নাটক আমরা শুনেছি। থিয়েটার বা যাত্রাও এর বাইরে নয়। এরপর এল টিভি সিরিয়াল। প্রথমে সাপ্তাহিক ধারাবাহিক, তারপর মেগা। সেখানেও সাহিত্য নির্ভরতা দেখেছি আমরা। শেষে পডকাস্ট এবং ওয়েব সিরিজ। এই সবক্ষেত্রেই মাধ্যম বিচারে সাহিত্যের যে ফর্ম, তার রূপান্তর বা পুনর্নির্মাণ ঘটানো হয় যুক্তিসংগত কারণেই। এ এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এটা যেমন অপরিহার্য, তেমনই সমস্যাটাও ঘটে এখান থেকেই। হইচই চ্যানেলের ওয়েব সিরিজ ‘শ্রীকান্ত’ দেখার পর বড্ড প্রকট হলো, এই সমস্যার জায়গাটা। দেখতে দেখতে একটাই প্রশ্ন মনে জাগছিল, কেন ???
মানছি, বইয়ের পাতায় বন্দি শব্দদের সেলুলয়েড মুক্তির ক্ষেত্রে পরিচালককে এক নতুন ছন্দে বিষয়টিকে প্রকাশ করতে হয়। পুরোনো রূপকে ভেঙে এক নতুন ভাষা ও আঙ্গিকে তাকে গড়তে হয়। কিন্তু সেটা এই মাত্রায় ? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ নিছক উপন্যাসের এক ক্লাসিক চরিত্র নয়। এ এক সময়ের দলিল। পরিচালক সানি ঘোষ রায় যেন সময়কেই অস্বীকার করেছেন মনে হলো। রাজলক্ষ্মী, অভয়া ও শ্রীকান্ত–সম্পর্কের যে রসায়ন, সেখানে মরমি কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের যে অনুভব, সেটা এখানে কোথায় ? চার পর্বের বৃহৎ আখ্যানে লেখা ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ তিন চরিত্র শ্রীকান্ত, রাজলক্ষ্মী ও অভয়া। সেই সময়কে তথাকথিত সময়োপোগী করতে গিয়ে গল্পের ও চরিত্রগুলির খোলনলচেই যদি বদলে ফেলতে হয়, তাহলে তিনি ‘শ্রীকান্ত’র অনুপ্রেরণায় এক নতুন কাহিনি সৃষ্টি করলেই তো পারতেন। সম্ভবত, কাহিনির সঙ্গে ‘শ্রীকান্ত’ ব্র্যান্ডটিও দরকার ছিল আমাদের পরিচালক মশাইয়ের।
২০০৬, ২০০৮, ২০২০ ও বর্তমান সময়–এই চার টাইমলাইনে বলা হয়েছে নতুন শ্রীকান্তের গল্প। শুরুর পটভূমি হালিশহর, সেখানে কিশোর শ্রীকান্ত ও তার ইন্দ্রজিৎদার কথোপকথন। পাড়ার রাজলক্ষ্মীদির প্রেমে উথাল-পাথাল কিশোর শ্রীকান্তের হৃদয়, যে কিনা বয়সে তার থেকে বছর কয়েকের বড়। মনের কথা বলবেই, এটা যেদিন সে ঠিক করে, সেদিনই বাবার বদলির কারণে রাজলক্ষ্মীর পাড়া ত্যাগ। এরপর দুজনের দেখা বহু বছর পর। ততদিনে দু’জনের জীবনেই নানা নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে।
শ্রীকান্ত এখন এক বুটিকের ডিজাইনার। রাজলক্ষ্মী তার ক্লায়েন্ট। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে পুরনো সম্পর্ক জাগে, জেগে ওঠে প্রেম, এখানে যা নিতান্তই শারীরিক। প্রেম যৌনতা বহির্ভূত নয়। তবে, শুধু যৌনতাই প্রেম নয়। এখানে যৌনতাই প্রাধান্য পেয়েছে, যা শরৎচন্দ্র সৃষ্ট শ্রীকান্তের অন্তরছবি নয়। অন্য দিকে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্তর প্রেমের সমান্তরালে আমরা পাই রাজলক্ষ্মীর অ্যাসিস্ট্যান্ট অভয়াকে। অভয়া গল্পে আসে অনেকটা পরে। দুই নারীর টানাপোড়েনে উদভ্রান্ত শ্রীকান্ত। যৌবন থুড়ি যৌনতার এই খেলা শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় শ্রীকান্তকে ? সেসব নাহয় পাঠক সিরিজেই দেখবেন। তবে, উপন্যাসটি পড়া থাকলে অস্বস্তি লাগবে, এটা নিশ্চিত বলা যায়।
অভিনয়ে ঋষভ বসু (শ্রীকান্ত), সোহিনী সরকার (রাজলক্ষ্মী), মধুমিতা সরকার (অভয়া)। পরিচালকের চাওয়া যেমন তেমনই যৌনতার গন্ধ মাখানো অভিনয়ে সোহিনী ও ঋষভ। এ প্রসঙ্গে একটা কথা, সোহিনী এই সময়ের ক্ষমতাশালী অভিনেত্রীদের একজন। কিন্তু কোথাও তিনি যেন কিছুটা বিশেষ এক ধারার মোড়কে ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন। বিষয়টা ভেবে দেখতে অনুরোধ করি তাঁকে। শ্রীকান্তর চরিত্রে ঋষভ বসুর সুযোগ পাওয়াটা অবাক হওয়ার মতোই। এমন এক আইকনিক চরিত্রে পরিচালক তাঁর মতো দুর্বল ও আড়ষ্ট অভিনেতাকে কী করে ভাবলেন, এটাই প্রশ্ন ! এদিকে মধুমিতার অভিনয় ক্ষমতাকে কাজেই লাগালেন না পরিচালক। তাঁর মতো ভার্সাটাইল একজন অভিনেত্রী দুর্বল চিত্রনাট্যের শিকার হলেন, এটা কাম্য ছিল না। অভিনয়ে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন অঙ্গনা রায়, জুন মালিয়া, গায়ত্রী শঙ্কর, সুকৃত সাহা প্রমুখ।
যদি নিছক অ্যাডপ্টেশনের কারণে পরিবর্তনের দিক থেকেও বিষয়টা বিচার করি, সেখানেও শ্রীকান্ত কী এক নারীর প্রেমপ্রত্যাশী যুবক মাত্র ? সেটাই তার একমাত্র সংকট ? আর কোনও সমস্যা নেই তার ? এই নতুন গল্পে ভীষণভাবে প্রত্যাশিত ছিল তার রিহ্যাবের লড়াই। যেটা সেভাবে পাওয়াই গেল না। রাজলক্ষ্মীর জীবনও কেন অন্যখাতে বইলো, তারও কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। আর অভয়ার উপস্থিতি যেন প্রায় না থাকারই মতো। অথচ, শরৎ উপন্যাসে অভয়া একেবারে সমান্তরাল গুরুত্বে বলা যায়।
গত ১৪ এপ্রিল হইচই চ্যানেলে মুক্তি পায় এই ওয়েব সিরিজ। মোট ৯ পর্বের এই সিরিজ না শরৎসাহিত্য অনুসারী, না এর মধ্যে কোনও মৌলিক এসেন্স মেলে ! বাংলার দর্শক এখন ক্রাইম, সেক্স ইত্যাদি দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু সাহিত্য নিয়ে ছেলেখেলা সম্ভবত বরদাস্ত করবেন না তাঁরা। আর যদি শুধু জেন ওয়াইকে টার্গেট করে এই সিরিজ বানানো হয়, তারা তো এই ছেলেখেলা আরওই দেখবে না !