Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

ঐতিহ্যের হাত ধরে প্রয়াগের পথে

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। ইতিহাস প্রসিদ্ধ লখনউ-এলাহাবাদ-বেনারস ঘিরে চলছে এই ভ্রমণ ধারাবাহিক।লিখছেন লিপি চক্রবর্তী। আজ দ্বিতীয় পর্ব।

বহু শতাব্দীর গন্ধমাখা লখনউয়ের পাট চুকিয়ে সাত সকালের লখনউ-এলাহাবাদ ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসে চড়ে রওনা দিলাম এলাহাবাদ বা প্রয়াগের উদ্দেশে। চারঘণ্টার জার্নির শেষে যা হলো, সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড ! আমরা জানতাম না, ওইটুকু ছোট্ট শহরে ছয়খানা জংশন স্টেশন পর্যটকদের গুলিয়ে দেবার  জন্য অবস্থান করছে। প্রয়াগ জংশনে নামার সময় আমার পতিদেব লাগেজ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা দিতে না দিতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। গতিও নিল সঙ্গে সঙ্গেই। আমি নামতে পারলাম না। দুজনের দুটো মোবাইলই আমার কাছে। তাই যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এরপর কোনও এক সহৃদয় ভদ্রলোকের ফোন থেকে আমার পতিদেব ফোন করে আমায়। তারপর নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্য দিয়ে কীভাবে আমাদের যোগাযোগ সম্ভব হলো, সেসব গল্প এতটাই জটিল, সে কথা বলতে গেলে আর ভ্রমণ কাহিনি লেখা হবে না। শুধু এইটুকু না বললেই নয়, উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আর রেল কর্মচারীদের সহযোগিতা কোনওদিন ভুলব না।

Img 20230330 Wa0055
ঐতিহ্যের হাত ধরে প্রয়াগের পথে 13

কয়েক ঘণ্টার এইসব গোলমাল শেষে ঠিকঠাক ভাবেই পৌঁছে গেলাম আগাম নির্দিষ্ট সাময়িক বাসস্থানে। পরদিন আমাদের পুণ্যলোভাতুর মন প্রথমেই ছুটল প্রয়াগের দিকে। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর সঙ্গম এই প্রয়াগ। ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর বর্তমান এলাহাবাদ শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। এলাহাবাদ শব্দের অর্থ হল ‘city of God’। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রধান কার্যালয়ও ছিল এই শহর। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতেও মৌর্যদের শাসনকালে এই স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্রাট অশোকের তৈরি বৌদ্ধধর্মের প্রতীক হিসেবে একটি স্তম্ভ রয়েছে এলাহাবাদের পুরোনো কেল্লার প্রবেশ দ্বারে। প্রয়াগরাজ শহর থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেখানেও অনেকাংশে অক্ষত রয়েছে সম্রাট অশোকের তৈরি একটি স্তম্ভ।

সঙ্গমে প্রতি বছর মাঘ মাসে মেলা বসে। পুণ্যস্নান করতে আসেন ভক্তরা। বারো বছরে একবার পূর্ণকুম্ভ মেলা বসে এখানে। সারা ভারত শুধু নয়, সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এসে তখন ভিড় করেন এই ছোট্ট শহরে। আমরা অবশ্য সঙ্গমে তেমন জলের দেখা পাইনি। যেটুকু পেয়েছি তাকে বড়জোর নালা বলা যায়। সারা শহরের বর্জ্য বয়ে চলেছে সেই নালা দিয়ে। এত যে মা গঙ্গাকে নিয়ে আমাদের সারা ভারতের মানুষের গর্ব, এলাহাবাদের মানুষের মধ্যে কিন্তু তাকে আগলে রাখার তেমন চেষ্টা চোখে পড়ল না। সরকারকে সব সময় দোষ দিলে হবে না। সাধারণ মানুষ নিয়েই সরকার। নগরবাসী সচেতন হলে, গঙ্গার চেহারা অমন বর্জ্য বহনকারী হতো না।

এলাহাবাদ কেল্লায় সাধারণ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এখন প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্বে কেল্লা। তবে, নৌকা করে ওই পাড়ে গিয়ে বাইরে থেকে অনেকটাই ঘুরে দেখা যায়। যাঁরা প্রয়াগ-স্নানে ইচ্ছুক, তাঁরা এখানেই স্নান সেরে নেন। উল্লেখ্য, এখানে বাঁশের পল্টুন ব্রিজের (ভাসমান সেতু) ওপর দিয়ে গাড়ি করে পারাপার হওয়া কিন্তু বেশ মজার। তীর্থক্ষেত্র মানেই মন্দিরের সমাহার। পায়ে হেঁটে ইচ্ছে হলে বেশ কয়েকটি মন্দির দেখে নেওয়া যায়। আমাদের আবার ভক্তির খানিক অভাব তৈরি হয়েছিল এই কারণে যে মন্দিরের সেবায় যারা নিয়োজিত, তারা বড় জ্বালাতন করছিল অর্থের জন্য। এ সমস্যা অবশ্য কমবেশি সর্বত্র। তবে, এখানে অর্থমূল্য কিছু কম হলেই শুনতে হয়–বাঙালি লোক এইসাই হোতা হ্যায় ! অপ্রিয় সত্য হলো, এই সফরে এমন কথা বারবারই শুনতে হয়েছে।

দিনের বাকিটুকু কাটল কৌশাম্বীতে, বৌদ্ধ বিহার আর সম্রাট অশোকের পিলার খুঁজতে। সন্ধেবেলা ফেরার পথে পড়ল একটি শক্তিপীঠ–শ্রী অলোপ শঙ্করী দেবী, অষ্টাদশ মাধেশ্বরী। অপূর্ব সুন্দর আরতি দেখে মন ভরে গেল। রাতটুকু বিশ্রাম। তার পরদিন রওনা বারাণসীর দিকে। আরও বিশেষ কিছু দেখা বাকি ছিল তখনও। আনন্দ ভবন আর স্বরাজ ভবন। একটি বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতৃত্ব, মূলত নেহরু আর গান্ধী পরিবারের বিশিষ্ট জনেদের ব্যবহার্য জিনিসের সংগ্রহালয়। আর একটি শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মস্থান। তাঁর জীবনযাত্রার বিশেষ বিশেষ ছবি, তাঁর ব্যবহারের জিনিসপত্র, থাকার ঘর এই সমস্ত কিছু। যেমন সুন্দর ভাবে সাজানো রয়েছে সব, মনে হচ্ছে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে দর্শনার্থীদের। ঘণ্টা তিনেক সময় চোখের পলকে অতিবাহিত হয়ে গেল। এবার রওনা বারাণসীর দিকে। (চলবে)

ছবি : লেখক