ওয়েবসিরিজে বলিউড বার্তা
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। ‘জুবিলি’-র হাত ধরে ওটিটি অঙ্গনে পা রাখলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
বলিউডে নিজের কাজের সূত্রেই এক স্বতন্ত্র নাম পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতয়ানি। বরাবরই দর্শকের সামনে নতুন ও ব্যতিক্রমী কিছু উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর হাত থেকেই বেরিয়ে এসেছে ‘উড়ান’, ‘লুটেরা’, ‘ভবেশ যোশী’, ‘ট্র্যাপড’-এর মতো ছবি। শুধুমাত্র বড়পর্দায় নয়, ওটিটি অঙ্গনেও রীতিমতো নিজের দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন এই পরিচালক। বিক্রমাদিত্যের ‘সেক্রেড গেমস’, ‘একে ভার্সেস একে’ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন ওয়েব দর্শক। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এবার বলিউডের স্বর্ণযুগ নিয়ে এলেন তিনি, ওয়েব সিরিজ ‘জুবিলি’র মাধ্যমে।
সিনেমা তৈরির পিছনে থাকা কাহিনি, পর্দার সামনে আমরা যে নাটক দেখি, তার থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর হয়। সেইসব কাহিনি নিয়েই তৈরি রীতিমতো পিরিয়ড পিস এই ওয়েবসিরিজ। প্রেক্ষাপট ১৯৪৭-এর বম্বে। বম্বে তখনও ঝাঁ চকচকে মুম্বইয়ে পরিণত হয়নি। সেই সময়, অর্থাৎ, বলিউডের স্বর্ণযুগের প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই পল্লবিত হয়েছে এই সিরিজের কাহিনি। ভারতীয় সিনেমার স্বর্ণযুগের পাশাপাশি সিরিজের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একজন স্টুডিও কর্ণধারের জীবনের নানা দিক ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মানুষের জীবনের গল্প নিয়েও।
সেই সময়কার বম্বের বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা ‘বম্বে টকিজ’, যার অন্যতম কর্ণধার ছিলেন প্রযোজক-নায়ক হিমাংশু রায়। তাঁর স্ত্রী দেবিকা রাণী বড়পর্দায় প্রথমবার চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। বলিউডের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, এই প্রযোজক-নায়কের ছায়া কোথাও যেন চোখে পড়ছে ‘জুবিলি’ নামের এই ওয়েবসিরিজের কাহিনিতে। বিক্রমাদিত্য মোতয়ানির এই সিরিজের হাত ধরেই প্রথমবার ওটিটি প্ল্যাটফর্মে পা রাখছেন টলিউডের ‘ইন্ডাস্ট্রি’ বলে পরিচিত প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সিরিজে তাঁকে দেখা যাবে প্রযোজক শ্রীকান্ত রায়ের ভূমিকায়, যিনি গ্ল্যামার দুনিয়ার এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাঁর স্টুডিওর নাম ‘রয় টকিজ’। সিরিজে এই রয় টকিজের কর্ণধারের স্ত্রী অভিনেত্রী সুমিত্রা কুমারী। চরিত্রটিতে অভিনয় করছেন অদিতি রাও হায়দারি।
সিরিজে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে এইভাবে, যেখানে আমরা দেখি, রয় স্টুডিওর প্রযোজকের স্ত্রী তখনকার জনপ্রিয় উঠতি তারকা মদন কুমারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। ঘটনাচক্রে বিশ্বস্ত অনুচর বিনোদ মারফত খবরটি জানতে পারে শ্রীকান্ত এবং তাকে দিয়েই মদন কুমারের অ্যাক্সিডেন্ট ঘটায় সে। বিনোদের সিনেমায় কাজ করার ইচ্ছে ছিল। তাই বিনোদ ধীরে ধীরে মদনের জায়গা নেয়। পরবর্তীতে সেও হয়ে ওঠে সুপারস্টার। তাঁর সংলাপ, স্টাইল রীতিমতো কপি করতে শুরু করে তরুণ প্রজন্ম ! কিন্তু কোথাও গিয়ে স্টারডমের আলোয় তার অভিনেতা সত্ত্বা ঢাকা পড়ে যায়। অথচ বিনোদ একসময় অভিনেতাই হতে চাইত। সে যখন সেই ইচ্ছেপূরণের পথে এগোতে চায়, তখনই তৈরি হয় সমস্যা।
এক অর্থে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির গ্ল্যামারের আড়ালে থাকা অন্ধকার দিকটির প্রতিই এখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে ‘জুবিলি’-র ট্রেলার। পিরিয়ড পিস এই সিরিজের লুক,কস্টিউম এবং সেই সময়টিকে অসাধারণ দক্ষতায় মেলে ধরেছেন বিক্রমাদিত্য। সিরিজের পিছনে ক্রিয়েটিভ টিমের রিসার্চের বিষয়টি যে অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপ্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ট্রেলার দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এই সিরিজের প্রতিটি পর্ব জুড়ে প্রেম, ভালবাসা, খ্যাতির চাহিদা রয়েছে–তেমনই হিংসা, দুর্নীতি, সুযোগের সদ্ব্যবহারের মতো বিষয়গুলিও দেখা যাবে। রয়েছে রহস্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও। সিরিজের ক্রিয়েটিভ পরিচালনার দায়িত্বটি সামলেছেন ‘গুলাব গ্যাং’, ‘মহালয়া’ খ্যাত পরিচালক সৌমিক সেন।
সিরিজে বিনোদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন হিন্দি বিনোদনের এই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা অপারশক্তি খুরানা। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন রাম কাপুর, সিদ্ধান্ত গুপ্তা, ওয়ামিকা গাব্বি প্রমুখ। সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব সামলেছেন প্রতিভাবান ও স্রোতের বিপরীতে চলা অমিত ত্রিবেদী। ইতিমধ্যেই সিরিজে নিজের রেট্রো লুকে নজর কেড়েছেন প্রসেনজিৎ। রীতিমতো হিরো সুলভ লুক তাঁর। চোখে দামী চশমা ও পরনে স্যুট, মুখে পাইপ। তাঁর এই চরিত্রটি নিয়ে একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রসেনজিৎ বলেছেন, “শ্রীকান্ত রায় এক কথায় গডফাদার। তারকা গড়ে তোলার বিষয়টা তার নখদর্পণে। ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম স্টুডিও কনসেপ্ট নিয়ে আসে সে-ই। প্রথম প্লে-ব্যাক সিঙ্গিংয়ের বিষয়টাও তারই ভাবনাপ্রসূত। হাবভাব বলে, সিনেমার জন্য লোকটা খুন পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। ধূসর চরিত্র। একজন উওম্যানাইজার। তারকা গড়ার খেলাটা খেলছে সর্বক্ষণ।”
সিরিজের প্রচারপর্বে নিজের চরিত্র নিয়ে অদিতি রাও হায়দারির মন্তব্য ”সুমিত্রা কুমারীর চরিত্রটা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ছিল। তিনি একজন তারকা ছিলেন, তাঁর ক্ষমতা ছিল। তাঁর কাছে সব ছিল কেবল একটা জিনিস ছাড়া, যা তিনি চাইতেন।” সেটা কী, তা অবশ্য খোলসা করেননি তিনি। সেটা পর্দায় দেখবেন দর্শক। সম্ভবত, খাঁটি ভালোবাসা ! বিনোদের চরিত্রে অভিনয় করা প্রসঙ্গে অপারশক্তি খুরানার কথায়, “যখন বিনোদের গল্প শুনি, তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, আমি এই চরিত্রটা করব। এটা আমার কেরিয়ারের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং চরিত্র ছিল।”
সিরিজ প্রসঙ্গে পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতয়ানি জানিয়েছেন, “দুরন্ত ক্রু, অসামান্য স্টুডিও আর কিছু অসাধারণ অভিনেতাদের সঙ্গে এটা একটা অবিশ্বাস্য জার্নি ছিল আমার কাছে। শুটিং ও অন্যান্য কাজ নিয়ে অতিবাহিত প্রতিটা দিন দারুণ আনন্দ করে কেটেছে।” তাঁর আরও দাবি, ‘জুবিলি’ ভারতীয় ছায়াছবির কথা বলবে, যা দেখে ভারতবাসী হিসেবে প্রত্যেক দর্শক অত্যন্ত গর্ব অনুভব করবেন। ‘জুবিলি’-র হাত ধরে ভারতীয় সিনেমার একটা কাব্যিক কাহিনিকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন নির্মাতারা।
আমাজন প্রাইম ভিডিও ইন্ডিয়া অরিজিনালস-এর প্রধান অপর্ণা পুরোহিত এই সিরিজ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, “এই দশ পর্বের সিরিজ তুলে ধরবে তিন তরুণের গল্প। যাঁরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নিতে চায়। সর্বোপরি সিনেমার ম্যাজিককে তুলে ধরতে চলেছে এই কাহিনি। থাকছে প্রেম, ঈর্ষা, বিশ্বাসঘাতকতাও।” নির্মাতাদের দাবি, এই সিরিজের জন্য অমিত ত্রিবেদী যেরকম সুর করেছেন এবং বিক্রমাদিত্য যে সৃজনশীলতার নজির রেখেছেন, তা দর্শকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সিনেমার স্বর্ণযুগে। প্রসঙ্গত ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে এই সিরিজে সুনীধি চৌহানের গাওয়া ‘বাবুজি ভোলে ভালে’ গানটি, যেটি রীতিমতো প্রশংসিত হয়েছে দর্শকমহলে। ভারতের সঙ্গে সারা বিশ্বে মুক্তি পাবে ‘জুবিলি’। বিশ্বের মোট ২৪০টি দেশে স্ট্রিমিং হবে এই সিরিজ। দুটি ভাগে প্রাইম ভিডিওতে প্রিমিয়ার হবে সিরিজের। প্রথম ভাগে পাঁচটি পর্ব। শুরু হচ্ছে আজ। আগামী ১৪ই এপ্রিল দ্বিতীয় ভাগে স্ট্রিমিং হবে বাকি পাঁচটি পর্ব।
ষাট বছর বয়সে পৌঁছে যাওয়ার পরও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ের খিদে সাংঘাতিক ! তা অতনু ঘোষের ‘শেষ পাতা’ হোক বা অঞ্জন কাঞ্জিলালের ‘সাজঘর’ অথবা শুভ্রজিৎ মিত্রের ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবিতে ভবানী পাঠকের চরিত্র ! বিক্রমাদিত্য মোতয়ানি ‘জুবিলি’-তে যেরকম একটি মলাট চরিত্র তাঁকে দিয়েছেন, তাতে মুম্বইয়ে তাঁর না পাওয়া আক্ষেপগুলো মিটিয়ে নতুন জার্নি শুরু করতে প্রস্তুত হতেই পারেন প্রসেনজিৎ। নতুন এই সফর যে তাঁর কাছে বেশ রোমাঞ্চকর হতে চলেছে, তা সিরিজের ট্রেলার শেয়ার করে নিজেই জানিয়েছেন তিনি। এই সিরিজকে ঘিরে বাংলার ওটিটি দর্শকের অপেক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতেও যে প্রসেনজিতই থাকবেন, সে কথাও বলাই বাহুল্য।