কঠিন পরীক্ষায় শিল্পীর জীবন ও জীবিকা
জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।
শিলিগুড়ির রাস্তায় প্রায়ই বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রা দেখতে পাওয়া যায়, মানে, বিয়ের সিজনে। আর বলতে গেলে, আজকাল তো সারা বছরই বিয়ের সিজন। পরিস্থিতির কারণে লোকজন যাপনকলায় নতুন নিয়মকানুনকে বরণ করে নিচ্ছে যুক্তিসঙ্গত কারণেই। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য নানা উৎসবের ঘটা। এমনিতে শিলিগুড়িকে মিনি কলকাতা বলা যায়। নানা ভাষা নানা মতের শহর। তার মধ্যে এখানকার মানুষ একটু বেশি রঙিন মেজাজের। শোভাযাত্রার উপলক্ষ যাই হোক, সবাই বেশ নেচে-কুঁদে, উল্লসিত মেজাজে শোভাযাত্রার শরিক হয়। দেখতে মন্দ লাগে না।
সম্প্রতি এইরকমই এক শোভাযাত্রার মুখোমুখি হলাম রাস্তায় বেরিয়ে। বেশ বড় আর ভারী শোভাযাত্রা। ভারী বলতে যেটা বোঝাতে চাই, পরিবারটি বেশ ধনী। পুরুষ-মহিলা সকলেই উজ্জ্বল সাজপোশাকে চলেছেন। বাজনার তালে নাচানাচিও চলছে। এরই মধ্যে হঠাৎ চোখ চলে গেল একেবারে বিপরীত এক ছবির দিকে। ছবিটি এই শোভাযাত্রারই অংশ। অথচ যেন নয় ! আমি আসলে দেখছিলাম কীবোর্ড বাজিয়ে ছেলেটিকে। একটি অটোতে বসে কীবোর্ড বাজাচ্ছে সে। কী উদাস, নিরাসক্তি তার চোখে। দৃষ্টি নিবদ্ধ শূন্যে। তার আঙুলগুলি অভ্যাসেই বিচরণ করছে রিডগুলিতে।
ঠিকঠাকই বাজছে তারা। শুধু ছেলেটি যেন থেকেও সেখানে নেই। আমি জানি, সে কী ভাবছে। তার হয়তো স্বপ্ন ছিল বড় একজন যন্ত্রশিল্পী হবে। জীবিকার প্রয়োজনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন অনেক কাজ তাকে করতে হয়, যা এতটুকু শৈল্পিক নয়। এই বিয়েবাড়ির দলটির পিছনে যেতে যেতে সে হয়তো এটাই ভাবছে, এটা কী করছি আমি ? এই কী আমার করার কথা ? আমাদের অনেকের জীবনেই এটা ঘটে। সত্যি বলতে কী, বেশিরভাগ মানুষেরই স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন পূরণের মাঝে প্রায়শই সমন্বয় সাধনের ব্যাপারটা সম্ভব হয় না। আমি নিজে সারা জীবন গান আর সাংবাদিকতার টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হলাম। সাংবাদিকতার পেশায় আমি অতৃপ্ত, তা নয়। তবে, গান গাইতেও যে বড্ড ভালোবাসি। দুটো কাজের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবু, হাল না ছেড়ে চালিয়ে যাচ্ছি। তবে, সাংবাদিকতা ডাল-ভাত যোগায়, তাই, সেখানেই সময়টা বেশি চলে যায়। গানের চর্চায় অবহেলা ঘটে যায় অজান্তেই।
আমি এমন অনেক ফটো আর্টিস্টকে জানি, যাঁরা বিয়েবাড়ির অর্ডারি কাজ করে পেট চালান। এঁদের মধ্যে যাঁরা সেটাকে উপভোগ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ঠিক আছে। কিন্তু যাঁরা করেন না, তাঁদের ভিতরের শিল্পী মনটাকে ওই সমঝোতা করার বাধ্যতাটা কুরে কুরে খায়। এই যে দুর্গাপুজো বা অন্যান্য উৎসবে বহু শিল্পী ইদানীং করে কম্মে খাচ্ছেন কর্পোরেট সংস্কৃতির ফসল থিম পুজোর কারণে, তাঁরা সকলেই তাঁর শিল্পী মনের চাহিদার মর্যাদা পাচ্ছেন কি ? পাঠক মাফ করবেন, এই ‘করে কম্মে’ কথাটায় আপনাদের মতো আমারও বিপুল আপত্তি। কিন্তু এই পরিভাষাটিও ওই কর্পোরেট দানোদের উদ্ভাবনী শক্তির ফসল। একদিকে শিল্পীমনের চাহিদার অপূর্ণতা। অন্যদিকে চূড়ান্ত এক্সপ্লয়টেশন ! হরে দরে একটা রেট দিয়ে কাজ করানো। সবই ঠিক করে কর্তৃপক্ষ। শিল্পীরা সেখানে নীরব দর্শক মাত্র।
গত কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। ভারতবর্ষ তথা এই রাজ্যও তার বাইরে নয়। বিনোদন ও সাংস্কৃতিক জগতেও এর প্রভাব বিলক্ষণ ধরা পড়ে। এরপর এলো অতিমারী এবং লকডাউন। কাজকর্ম পুরো বন্ধ। অডিটোরিয়াম বন্ধ, খোলা ময়দান বন্ধ, মাচার জলসাও বন্ধ। বলা বাহুল্য, পারফর্মিং আর্ট-এর সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের একটি বড় অংশ সেদিন দারুন দুরাবস্থায় পড়েন। অর্থাৎ, যাঁদের কোনওদিনই তেমন জমা পুঁজি ছিল না, তাঁরা ঘরের ঘটি-বাটি বেঁচেও সামাল দিতে পারেন না। একটা সময়ের পর অতিমারী সংক্রান্ত পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলো। অর্থনৈতিক মন্দা কিন্তু সেভাবে কাটলো না। ফলে, পারফর্মিং আর্ট-এর শিল্পীদের জীবন ও জীবিকার হাল ফেরাও দুষ্কর হয়ে উঠলো। কিছুটা ভরসা অনলাইন শো। বাকি ওই যেখানে যেমন সুযোগ ! সে বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রাই হোক বা বিয়ের আসর।