কাজ আমার জীবনের একটা অংশ মাত্র
আকারে ছোট হলেও বিনোদন ক্ষেত্রে টেলিভিশনের গুরুত্ব আজ অসীম। মেগা থেকে রিয়ালিটি, গেম শো থেকে ম্যাগাজিন–টিভি শোয়ের চাহিদা ছিল, আছে, থাকবে। এই বিভাগে তারই খবর প্রতি সপ্তাহে। ‘জবা’ থেকে ‘পর্ণা’ হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা এবং নিজের জীবনকেন্দ্রিক নানা ভাবনার কথা সোমনাথ লাহাকে অকপটে জানিয়েছেন পল্লবী শর্মা।
এই ধারাবাহিকের সৌজন্যে লিলি চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করলে প্রথমবার। কেমন সেই অনুভূতি ? ধারাবাহিকে দুটি চরিত্রের মধ্যে সম্পর্কই বা কী ?
সকলেই জানে ‘নিম ফুলের মধু’-তে ঠাম্মি (লিলি চক্রবর্তী) হচ্ছেন পরিবারের একজন স্তম্ভ। সবাই তাঁর আশ্রয়ে থাকে। দত্ত পরিবারে ঠাম্মি যা বলে, তাই হয়। এই পরিবারে আমি অর্থাৎ পর্ণার সবথেকে বড় সাপোর্টার যদি কেউ থেকে থাকেন, তিনি ঠাম্মি। কারণ, ঠাম্মিই পর্ণাকে পছন্দ করে দত্তবাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছেন। এটা হল অনস্ক্রিন সম্পর্ক। আর পর্দার বাইরেও আমাদের দারুণ বন্ড। আমি লিলিদির সঙ্গে মেকআপ রুম শেয়ার করি। আমরা একঘরে বসি। লিলিদি অসম্ভব মিষ্টি একজন মানুষ। বলাই বাহুল্য যে ওঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। জীবনে অনেক কিছুই দেখেছেন। সেটা ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের অভিজ্ঞতা বলুন বা বাইরের ! সেইজন্য লিলিদির সঙ্গে থেকে আমিও অনেক কিছু শিখতে পারছি, জানতে পারছি।
দর্শক তোমাকে ‘জবা’ (কে আপন কে পর) চরিত্রে দারুণভাবে গ্রহণ করেছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ‘নিম ফুলের মধু’-র ‘পর্ণা’ চরিত্রে তাঁরা কতখানি গ্রহণ করেছে তোমায়?
দর্শক কতটা গ্রহণ করেছেন, সেটা আমাদের টিআরপি বলবে। আমরা প্রথম সপ্তাহেই সারা বাংলায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলাম। এখনও আমরা কিন্তু সেরা পাঁচের মধ্যেই রয়েছি। অবশ্যই আমি পাঁচ বছর ধরে ‘জবা’ চরিত্রটির একটা গ্রাফ তৈরি করেছি। ‘পর্ণা’ চরিত্রটায় আমি অভিনয় করছি সবেমাত্র দু’মাস হয়েছে। তাই আমি যদি ভাবি ‘জবা’-কে এক্ষুনি টেক্কা দিয়ে দেবে ‘পর্ণা’, সেটা তো সম্ভব নয়। তার জন্য একটু সময় লাগবে মানুষজনের। তবে এটাও ঠিক আমি যতটা প্রত্যাশা করেছিলাম, দর্শক কিন্তু তার থেকে বেশি ‘পর্ণা’-কে গ্রহণ করেছে। প্রমাণ, আমাদের টিআরপি। প্রথম থেকেই প্রচন্ড ভাল টিআরপি পাচ্ছি। রাস্তায় বেরোলেও আগে যেমন লোকজন ‘জবা’ বলে চিনতে পারত, এখন ‘পর্ণা’ বলে চিনতে পারছে।
‘পর্ণা’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া কেমন ছিল ? এক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের সাহায্য ছাড়া আর কী কী ভাবে নিজেকে তৈরি করেছ ?
প্রথমত, আমি যখন ‘জবা’-র চরিত্রে অভিনয় করতাম, তখন কিন্তু আমি খানিকটা ওজন বাড়িয়েছিলাম। আমার চরিত্রটা যেহেতু দেখানো হয়েছিল যে আমি ঠাম্মা হয়ে গেছি–অনেকটা বয়স্ক একটা চরিত্র ছিল। সেদিক থেকে যদি বলো, আমি অনেকটা আমার ওজন কমিয়েছি। আর ‘জবা’-র চরিত্রটার একদম বিপরীতধর্মী চরিত্র হচ্ছে ‘পর্ণা’। কারণ, এই চরিত্রটা ভীষণ হাসিখুশি একটা মেয়ে। সে প্রচন্ড হইহই করতে ভালবাসে। চরিত্রটা এতটাই ভালো যে আলাদা করে আমাকে খুব একটা খাটতে হয়নি। ‘পর্ণা’ চরিত্রটাই আমাকে সাহায্য করেছে ‘জবা’ থেকে বেরিয়ে আসতে। এছাড়াও, এই চরিত্রটা যেহেতু আমার বয়সী একটা মেয়ের চরিত্র, তাই প্রত্যেকটা মেয়েই নিজেদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। এখনকার দিনে আমরা সিরিয়ালে সাধারণত দেখে থাকি, চরিত্রগুলো হয় ভীষণ সাদা, নাহলে কালো। কিন্তু এই ধারাবাহিকের প্রত্যেকটা চরিত্রই ভীষণ ধূসর। মানুষ তো আসলে তা-ই হয়। এখানে চরিত্রগুলোর এটাই একটা প্লাস পয়েন্ট–এরা রক্তমাংসের মানুষ। সেই কারণেই দর্শক তাদের এত কমদিনে এত বেশি আপন করে নিয়েছেন।
মাঝখানে দু’বছরের বিরতি নিয়েছিলে তুমি কাজে, এর কারণ কী ?
এটা সচেতন ভাবেই নেওয়া। আমাদের সিরিয়ালগুলো যেহেতু নারীকেন্দ্রিক, একটা প্রজেক্ট যখন শুরু হয়, তারপর আমরা নিজেদের জন্য একদমই সময় পাই না। আমার কাছে আমার জীবনটা আমার। তার মধ্যে কাজটা একটা অংশ। আমার কাজটা আমার জীবন নয়। আমি আমার জীবনটায় বাঁচতে চাই, তার সঙ্গে কাজটাও করবো। তাই নিজেকে ও পরিবারকে একটু সময় দিলাম। সিরিয়াল চলাকালীন আমি যেগুলো করতে পারি না–এই ঘুরতে যাওয়া, ব্রেক নেওয়া, সেগুলো এই মাঝখানের বিরতির সময় করি। আমি যেহেতু পাঁচ বছর ধরে একটা চরিত্র করে এসেছি, আমার মনে হয়েছিল, এবার নিজেকে একটু সময় দেওয়া জরুরি। একটু পল্লবী হয়ে বাঁচা দরকার। আমি কোনও চরিত্র হয়ে কতদিন বাঁচব ? নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল। সেইজন্যই এই দু’বছরের বিরতি নিয়ে নিজেকেও একটু সময় দিয়েছিলাম। তার সঙ্গে আরও একটা কারণ–’জবা’ চরিত্রটা মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল, তাকে সেখান থেকে বের করা, ভোলার জন্যও একটু সময় দেওয়া খুব দরকার ছিল। নাহলে আমি তখনই যদি ফিরতাম, লোকে আমাকে ‘জবা’ বলেই ভাবতেন।
সহ অভিনেতা হিসেবে রুবেল কেমন? ওর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা একটু বলো।
রুবেলের সঙ্গে আমার এটা প্রথম কাজ। তবে, আমাদের কারও ক্ষেত্রেই এটা প্রথম কাজ নয়। সেইজন্যই আমরা দুজনেই জানি যে কাজটা কিভাবে করতে হয়। একজন সহ-অভিনেতার প্রতি ন্যূনতম যে সন্মান, কো-অর্ডিনেশন, কমিউনিকেশনটা থাকা দরকার–সেটা প্রথম দিন থেকেই আমাদের মধ্যে খুব ভালো ছিল। তাই কোনও সমস্যা হয়নি। আসলে কী হয়, যখন নতুন কারওর সঙ্গে কাজ করতে যাই, তখন একটা বোঝাপড়ার সমস্যা হয়। সে সংলাপটা কীভাবে বলবে বা আমি কীভাবে সেই সংলাপটা নেব। আমার আর রুবেলের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা হয়নি। শুধু রুবেল নয়, আমাদের এখানে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের বন্ডিংটা খুব ভালো। অফস্ক্রিন আমরা সবাই খুব ভালো understanding-এর একটা space শেয়ার করি বলে, আমার মনে হয়, অনস্ক্রিন আমাদের কাজটা করতে খুব সুবিধা হচ্ছে।
পর্ণার সঙ্গে পল্লবীর কতটা মিল বা অমিল ?
পর্ণার সঙ্গে আমি যেটা বললাম– মিল শুধু পল্লবীর বলবো না, এখনকার দিনের প্রত্যেকটা মেয়েই নিজেদের মিল খুঁজে পাবে। কারণ, আমরা স্বাধীনচেতা হয়ে বাঁচতে চাই। আমরা সংসার করবো, তার সঙ্গে বাইরে কাজটাও করবো। নিজের একটা পরিচিতি থাকবে। সেই মিলটা রয়েছে আমার সঙ্গে। তেমনই আবার কিছু অমিলও রয়েছে। আমি যেরকম ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে নিয়ে থাকতে ভীষণ ভালোবাসি। আমি শান্ত পরিবেশ পছন্দ করি। কিন্তু পর্ণা সবাইকে নিয়ে হইহই করে থাকতে ভালোবাসে। সে হয়তো একা এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না। কিন্তু আমি একা বছরের পর বছর থাকতে পারি।
ছোটবেলাটা বাবা-মা ছাড়া কেটেছে তোমার। একার এই লড়াই কতখানি কঠিন ছিল?
প্রত্যেকটা সন্তানের কাছেই বাবা-মায়ের জায়গাটা একেবারে অন্যরকম। কঠিন তো অবশ্যই ছিল। কিন্তু, তার সঙ্গে সঙ্গে ভগবান বলো বা আশেপাশের মানুষ, আমাকে কিন্তু সবটাই জোগান দিয়ে গেছে, যাতে আমার রাস্তটা মসৃণ হয়ে যায়। আমার emotionally হয়তো একটু ওঠা-পড়া গেছে। কিন্তু কখনও আর্থিক দিক থেকে বা অন্যান্য জাগতিক কারণে আমি খুব একটা কষ্ট পাইনি। আমি আমার পিসির বাড়িতে থেকে বড় হয়েছি। পিসি অনেকটাই আমার মায়ের জায়গা নিয়েছিকেন। তবে, একটা ফাঁকা জায়গা তো সবসময়ই ছিল, আছে, চিরকাল থাকবে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বলব, যে, ভীষণ স্ট্রাগল করতে হয়েছে, একদম খেতে পেতাম না, শুতে পারতাম না–এরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও যেতে হয়নি কখনও। আমি emotionally একটু বেশি suffer করেছি, বলতে পারো।
পল্লবীর কি মনের মানুষ আছে? নাকি সে এখনও সিঙ্গল ?
আমি এখনও সিঙ্গল। তার কারণ হচ্ছে, আমি ছোট বয়সেই আমার সব আশ্রয়গুলোকে হারিয়েছি। তাই আমি চাই যে মানুষটা আমার জীবনে আসবে, সে যাতে আমার সেই জায়গাগুলো ভরতে পারে। আমি কোনও তাড়াহুড়ো করতে চাই না। আমার কাছে সবসময় সুখের থেকে শান্তি বেশি priority ছিল। লোকজনকে দেখাতে হবে বলে আমাকে কারওর সঙ্গে প্রেম করতে হবে বলে আমি মনে করি না। যদি আমার জীবনে সেরকম কেউ আসে, তখনই আমি সিদ্ধান্তে যাব।
দর্শক তোমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে। বিনিময়ে কী বলতে চাও তাদের ?
তাঁদের উদ্দেশ্যে এটাই বলব, আমি যত না deserve করি, তার থেকে আমি অনেক বেশি পেয়েছি–দর্শকের থেকে, ভগবানের থেকে, জীবনের থেকে। এটাই প্রত্যাশা করব এখনও পর্যন্ত যতটা ভালবাসা পেয়েছি, ভবিষ্যতে তাঁদের আশীর্বাদের হাতটা এভাবেই আমার মাথার উপরে থাকবে। আমাকে আশীর্বাদ করবেন তাঁরা। ভালোবাসা দেবেন। আর এভাবেই জীবনটা কেটে যাবে তাঁদের ভালোবাসা নিয়ে।