Monday, February 3, 2025
কৃষ্টি-Culture

কালি-কলমের একক প্রদর্শনী

সম্প্রতি জলপাইগুড়ি শহরে চিত্রশিল্পী নির্মল চন্দের একটি একক চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেল। নবীন চিত্রশিল্পী হিসেবে জলপাইগুড়ি শহরে নির্মল চন্দ একটি সুপরিচিত নাম। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিধি নয়, বরং শিল্পকলার প্রতি অনুরাগ ও আনুগত্য থেকেই তিনি ধীরে ধীরে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নিজেকে এই জগতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছাত্রজীবনে বরিষ্ঠ প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী স্বপন দাসের কাছে নির্মলের ছবি আঁকায় হাতে-খড়ি। পরবর্তীকালে আর এক প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী নীহার মজুমদারের কাছেও নির্মল ছবি আঁকার পাঠ নিয়েছেন। শুরুটা এভাবেই, তারপর দীর্ঘ লড়াই। অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে নির্মল সমস্যা, বাধা-বিপত্তি একে একে পেরিয়ে, লক্ষ্যে অবিচল থেকে তাঁর শিল্পযাত্রায় এগিয়েছেন। আজও তপস্বীর মতো নিরলস শিল্প সাধনায় মগ্ন আছেন।

শুরুর দিকে নির্মলের মাধ্যম ছিল জলরং। একটা সময় পর্যন্ত তাঁর স্বচ্ছ জলরঙের কাজগুলো যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। এরপর তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন এক্রেলিক। এভাবেই সুদীর্ঘ চর্চায় নির্মল তাঁর নিজস্ব শৈলী তৈরি করেন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি অবকাশে, অবসরে কালি-কলমের (pen & ink) কাজ শুরু করেন। একরকম নেশার মতো কাজ করতে করতে তাঁর কালি-কলমের কাজের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩০০টি। এই সম্ভার থেকেই নির্মল তাঁর ৬৪টি কাজ নিয়ে গত ৬-৮ই জানুয়ারি, ২০২৩ জলপাইগুড়ি আর্ট গ্যালারির প্রদর্শনী কক্ষে উত্তরবঙ্গে প্রথম কালি-কলমের একক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন।

বিভিন্ন বিষয়–যেমন দৈনন্দিন জীবন, প্রকৃতির উপাদান, পুরাণ আশ্রিত রূপকল্প, সম্পর্কের নানা আভাষ সম্পর্কিত ছবিগুলো নিয়ে শিল্পী তাঁর শিল্পসম্ভার সাজিয়েছেন। কিছু ছবিতে অনুজ্জ্বল হালকা রঙের আভাষ নমনীয় রেখার সাথে মিলে অপূর্ব টেক্সচার তৈরি করেছে। কোথাও বলিষ্ঠ ওয়ান লাইন ড্রইং ও ডটের ব্যবহার এক মায়াচ্ছন্ন বিস্ময় তৈরি করেছে। উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে ‘মিলকিং 1’ ও ‘মিলকিং 2’ ছবিদুটোয় প্রকৃতিগত মাতৃত্বের উদ্ভাস দেখা যায়। এর বিপরীত ভাবনায় ‘অর্ফ্যান্স শ্যাডো’ অনাথ বালকের আকাঙ্খা ব্যঞ্জিত হয়েছে। ‘টমটম’ ছবিটি ছেলেবেলার আনন্দময় স্মৃতির মিষ্টিক প্রকাশ। আবার ‘তাঁতীর বাড়ি ব্যাঙের বাসা’ ছড়ার আধারে একটা মজার কম্পোজিশন। ‘এলিফ্যান্ট সাফারি’ ছবিতে দূরের গাছ আর সওয়ারী নিয়ে হাতির মধ্যকার বিস্তীর্ণ শূন্য জমি শিল্পী নিজ স্বাক্ষর দিয়ে ভরাট করে যেমন অদ্ভুত মজা তৈরি করেছেন, তেমনি অরণ্যের বিস্তারকেও ছুঁয়ে গেছেন।

পুরাণ আশ্রিত ‘দুর্গা’ ও ‘টায়ার্ড রাবণ’ ছবিদুটি শিল্পী সমকালীন ভাবনায় প্রকাশ করেছেন। জালে আটকে পরা দুটি মাছের ছবি সম্বলিত ‘দ্য লাস্ট কিস’ ছবিটি শিল্পভাষায় উজ্জ্বল। ‘প্যান্ডামিক’ ও ‘পরিযায়ী’ ছবিগুলো করোনাকালের দুঃসহ স্মৃতির শৈল্পিক প্রকাশ। ‘দ্য নেস্ট’ ও ‘কন্ডোলেন্স’ ছবিদুটোর কম্পোজিশনের অপূর্ব দ্বিমাত্রিকতা লক্ষণীয়। কয়েকটি রেখার প্রয়োগে ‘দ্য কেজ’ ছবিতে নারী স্বাধীনতার সপক্ষে তাঁর ভাষ্য রেখেছেন। শহরের বিশিষ্ট শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্মান জ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে প্রদর্শনীর সূচনা হয়। তিনদিনের এই প্রদর্শনী, শিল্প বিষয়ক আলোচনা ও আড্ডায় মেতে উঠেছিল। সর্বোপরি অনবদ্য শিল্প ভাবনা ও উৎকর্ষ কাজের গুণে নির্মলের এই প্রদর্শনী বিপুলভাবে দর্শকনন্দিত ও প্রশংসিত হয়।