ক্যালকাটা কয়্যারের ‘যমপুরীতে জমজমাট’
নাচ, গান, মাপেট, পাপেট মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত অপেরা পরিবেশিত হলো, গত ১৬ অগাস্ট পাইকপাড়ার মোহিত মৈত্র মঞ্চে। প্রযোজনা ক্যালকাটা কয়্যার। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে, সংস্থার মূল কাণ্ডারী স্বনামধন্য সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব কল্যাণ সেন বরাট দর্শকদের উদ্দেশ্যে জানালেন, “এই সময়ে আমাদের যে কথাগুলো বলা দরকার, সেগুলো মজার ছলে বলার চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে কেউ যেন কোনও দলীয় রাজনীতি না খোঁজে। আসলে সারা পৃথিবী জুড়ে যে অরাজকতা চলছে, তার বিরুদ্ধে এই প্রযোজনা এক সহাস্য প্রতিবাদ।”
বাস্তবিকই নিছক বিনোদনের জন্য সৃষ্টি নয়, সেই ‘বর্ণ পরিচয়’ থেকেই পরম্পরাকে পরোক্ষভাবে ধরে রেখেছে ক্যালকাটা কয়্যার গ্রুপ। তাঁদের মঞ্চ উপস্থাপনায় আমরা পেয়েছি একের পর এক সমাজমনস্ক ও অর্থবহ প্রযোজনা। নির্মাণের এই ধারাবাহিকতা মেনেই নবতম প্রযোজনা স্যাটায়ার-ধর্মী ‘যমপুরী জমজমাট’-ও পরিবেশিত। প্রথম শো ‘ক্লোজড শো হিসেবে থাকলেও, হলের দর্শক সংখ্যা ছিল সীমাহীন। প্রায় আট মাস আগে থেকে ৮০ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তৈরি সুব্রতনাথ মুখোপাধ্যায় এবং কল্যাণ সেন বরাটের সৃজনের ফসল ‘যমপুরী জমজমাট’।
সঞ্জীব মিত্রর দুর্দান্ত মঞ্চ সজ্জাকরণে যমলোক, আকাশযান, শিবলোক, লক্ষ্মীধাম, সরস্বতী অঙ্গন, মর্ত্যলোক–আমাদের রূপকথার শৈশবে নিয়ে যায়! শুরুতেই আমাদের গল্প বলার আজীবন সাথী ঠাকুরমার প্রবেশ–
আমরা শুনি…
এক যে ছিল জ্যান্ত মানুষ,
বীরপুরে তার বাড়ি।
গবুচন্দ্র নাম ছিল তার,
পশু আর পাখিদের ভালবাসে ভারী…!
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গবুচন্দ্র ঢোল বা গবেন্দ্র একজন সরল সাধাসিধে মানুষ। সঙ্গী ছোট্ট এক ছেলে, নাম টুবলু আর ভুলো (কুকুর) ও ভোম্বল (ষাঁড়)। একসঙ্গে আনন্দে থাকে তারা। একদিন বিশেষ ঘোষণা হলো–শহর পরিস্কার করা হবে। তাই অবাঞ্ছিত নেড়ি বা কুকুর রাখা যাবে না। তারা ভুলোকে নিয়ে গেল। শোকে প্রাণ হারাল টুবলু। এরপর ঘনিষ্ঠ একজনের কাছে ভোম্বলকে রেখে, গবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে একটি গাছতলার নিচে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে যমদূতরা সেদিন কোনও মৃতদেহ না পেয়ে, ঘুমন্ত গবুকে কাঁধে নিয়ে তিন ভুবনের পারে রওনা দিল।
এরপর শুরু হলো গবুচন্দ্রর আক্রমণাত্মক প্রশ্ন। উঠে আসে স্বৈরতন্ত্র, টিআরপি তত্ত্ব, অনাচারী শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি প্রশ্ন। একের পর এক দৃশ্য দর্শককে শুধু হাস্যরসেই প্লাবিত করে না, গ্লানিকর জীবনের বিরুদ্ধে একটি আশার আলোয় উদ্ভাসিত করে। আমরা দেখি, মর্ত্যে ফিরে আসার পর গবুচন্দ্র ‘টুবলু রে…’ বলে আর্তচিৎকার করার পর টুবলুর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ! ‘আমাদের ইস্কুল ডাকছে…’ সমবেত গানে বাচ্চাদের নৃত্যছন্দে স্কুলে প্রবেশ মনকে বিশুদ্ধ করে তোলে। জীবনটাকে স্বচ্ছতায় নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখায়। গ্রামে-গঞ্জে গবুচন্দ্র নিরক্ষরতা দূর করার অভিযানের শপথ নেয়। মুখ্য চরিত্রে নৃত্যশিল্পী কবীর সেন বরাট এতটাই সহজ ও সাবলীল–কোথাও মনে হয়নি, উনি অভিনয় করছেন! তবে, মাঝে মাঝেই পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় কথা বলা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এই বয়সেই টুবলুর ভূমিকায় ছোটো ছেলে আলাপ রায়ের নিবেদন বুঝিয়ে দেয়, সহজাত অভিনয় কাকে বলে। আর গোটা কর্মকাণ্ডের যিনি অক্সিজেন–তিনি হলেন বাংলা সংগীত, সংস্কৃতি ও শিল্প সৃজনের পুরোধা কল্যাণ সেন বরাট। নির্দেশনা ও সামগ্রিক সৃজনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর নান্দনিক হস্তক্ষেপ এক বর্ণময় ও অর্থবহ অভিজ্ঞতা দেয় উপস্থিত সকল শ্রোতা-দর্শককে।