Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবনসোশ্যাল মিডিয়া

খোঁজ মিলবে ফেসবুক দেওয়ালে

ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। কত সম্পর্ক তৈরি। কত ভাঙাগড়ার গল্প ! সামাজিক সুরুচি-কুরুচি থেকে রাজনীতির প্যাঁচ-পয়জার। কেউ মনের ভাব প্রকাশে, কেউ বা শিল্পচর্চায়–বাণিজ্যিক লেনদেন থেকে রেসিপি-কলা এই প্ল্যাটফর্মে সবই হাজির। আবার মানবিক মূল্যবোধের দৃষ্টান্তও স্থাপিত কখনও কখনও। এই বিভাগে থাকছে সেইসব চর্চারই  প্রতিফলন।

এটা ২০২০-র গোড়ার দিকের কথা। ‘কোভিড ১৯’-এর ব্যাপারে সবে জানকারি এসেছে আমাদের দরবারে। লকডাউনের ঘোষণা হব হব করছে। সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে শুধুই অতিমারীর পরিসংখ্যান। মানুষজনের মধ্যে একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে তুমুল উত্তেজনা। একটা কিছু পাওয়া গেছে, যা নিয়ে দিবারাত্র চর্বিত চর্বন করা যেতে পারে। এইসব বড় বড় ঘটনা ঘটবে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় তার চর্চা হবে না ? হলোও তাই। সবার পোস্টে শুধুই অতিমারী। কোথাও ব্যক্তিগত ক্ষতির কথা–সেখানে আপনজনের মৃত্যু থেকে চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং আরও নানা অঘটনের জন্য হাহুতাশ, আক্ষেপ, হতাশা। কোথাও সংক্রমণ নিয়ে আলোচনা। কয়েকদিন পর দেখা গেল, প্রায় সকলেই কোভিড বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে।

আজকের পর্বের প্রেক্ষিত এটা হলেও, বিষয় পৃথক। সেখানে নিরাশাবাদ নয়, বলবো মানুষের উত্তরণের কথা। কঠিন অবস্থা কাটিয়ে কেমন করে শুধু নিজের বাঁচা নয়, অপরকেও বাঁচতে সাহায্য করা যায়। আমার এক ফেসবুক বন্ধু, অতিমারীর অনেক আগে থেকেই তিনি খাবারের হোম ডেলিভারির কাজ করতেন। রান্না বরাবরই তাঁর প্যাশন। বাঙালি তো বটেই, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেরও বেশ কিছু পদ দিব্যি বানাতে পারেন তিনি। সচরাচর আমাদের কলকাতাবাসী মানুষজনের যেমন চাহিদা থাকে, তেমন আর কী ! স্বামীর কর্মক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হওয়ার পর ভদ্রলোক ঘরে বসে যেতে বাধ্য হন। হতাশার সঙ্গে বসে ঘর না করে নিজের রান্নার শিল্পগুণ নিয়ে ময়দানে নেমে পড়েন আমার বন্ধুটি।

Images 17

সাধারণ একজন গৃহবধূ। তাঁর কাজের বা পণ্যের প্রচারমাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া আর কীই বা হতে পারে? এক্ষেত্রে নিজের ফেসবুক দেওয়াল, সেখানেই কিছুটা বর্ণনাসহ নিত্যনতুন রান্নার ছবি দিয়ে পোস্ট করে কিছুটা ব্যবসায়ীক প্রচার করছিলেন তিনি। বলতে দ্বিধা করবো না, লোকজনের সাড়াও পাচ্ছিলেন। যা নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক দিক সমাজ ও জীবনের। অতিমারী উপলক্ষে যখন লকডাউন ঘোষিত হলো, তখন রাতারাতি বেড়ে গেল ওঁর অর্ডারের পরিমাণ। স্বাভাবিক, মানুষ ঘরের বাইরে যেতে পারছে না, বাজারহাটের সমস্যা। জোমাটো বা সুইগির পরিষেবা সকলের পছন্দ নয়। তাঁরা রান্নার ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিগত ছোঁয়ার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেন। এর ফলেই চাহিদা বাড়লো আমার বন্ধুটির তৈরি খাবারের। আর একটি কথা, তাঁর সমস্ত রন্ধনপ্রণালীর ব্যাপারটাই চলে একেবারে কাস্টমাইজড পদ্ধতিতে। কোন বাড়ির কোন রোগীর হার্টের অসুখ, কার কোলেস্টেরল হাই, কে ডায়াবেটিক, কার গ্যাস্ট্রিক–গ্রাহকদের এইসব যাবতীয় তত্ত্বতালাশ তাঁর নখদর্পণে।

Download

এরপর শুরু হলো তাঁর বিশেষ পরিষেবা। প্রথমত, লকডাউন এলাকায় প্রচুর অসুবিধার মুখোমুখি হয়েও খাবার পৌঁছে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, কোভিড আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে পরিষেবা। বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। কাজটা তাঁকে ঝুঁকি নিয়েই করতে হবে। এর জন্য তাঁকে পৃথক ডেলিভারি নেটওয়ার্ক বানাতে হলো। মেনে চলতে হলো কোভিড বিধি ও প্রশাসনিক সমস্ত বাধা-নিষেধ। এত কিছুর পরও কিন্তু থামেননি তিনি। তাঁর খাদ্য ভান্ডারের দরজা খোলা থেকেছে, রয়েছে আজও। আমার এই বন্ধুর দেওয়ালে গিয়ে যখন দেখতাম, কোথায়, কোন জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কাজ করছেন তিনি, তখন সত্যিই খুব গর্ব অনুভব করতাম।

শেষ করবো সেই সোশ্যাল মিডিয়ার কথাতেই। মাধ্যম নয় গুরুত্বপূর্ণ হলো ভাবনা। সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়েই আমার বন্ধুটি একজন গৃহবধূ হয়েও পরিবারসহ নিজের বেঁচে থাকার সুস্থ ও সুন্দর এক অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন। পাশাপাশি যথোপযুক্ত পরিষেবা দিয়েছেন অসহায় রোগাক্রান্ত মানুষকে। তাঁর যোগাযোগের ফোন নাম্বার ফেসবুক দেওয়াল থেকেই পেয়েছেন গ্রাহকরা। আমি এবং তাঁর অন্যান্য বন্ধুরা অনেকেই শেয়ার করেছি তাঁর পোস্ট। জানাজানি হয়েছে এভাবেই। এখন অনেকেই জানেন, চাহিদামতো লাঞ্চ বা ডিনারের জন্য হোক, পারিবারিক উৎসব বা রোগীর পথ্য–পরিষেবার জন্য আছেন একজন। ফেসবুকে তাঁর খোঁজ মিলবে।

**ছবি – প্রতীকী