গন্তব্য মুর্শিদাবাদ – আজ শেষ পর্ব
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
এখন থেকে প্রতি শুক্রবার পড়বেন ঠিকানা দিকশূন্যিপুর।
আমাদের পরিক্রমা চলছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে।আজ শেষ পর্ব।
সম্রাট ঔরংজেব ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করলেন ১৭০৪ সালে ভাগীরথী তীরে। মুর্শিদাবাদ নামকরণ হলো পরে। বাংলার দেওয়ান তখন মুর্শিদকুলি খাঁ। নিজের নামে বাংলার রাজধানীর নামকরণ মুর্শিদাবাদ করলেন তিনিই। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব খেতাব পেলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। বাংলার প্রথম নবাব। আর শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তাঁর বেদনাদায়ক পরিণতির কাহিনী আগেই বলেছি। একটি জাতি ২০০ বছরের জন্য পরাধীন হয়ে গেছিল সিরাজের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে।
ফিরে আসি মুর্শিদকুলি খাঁয়ের কথায়। বাংলার সীমানা তখন বিহার ও ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই বিশাল অঞ্চলের রাজধানী মুর্শিদাবাদ। শোনা যায়, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ অত্যন্ত বিচক্ষণ, উদার ও কীর্তিমান ছিলেন। তাঁর সুশাসনে শান্তি বজায় ছিল সর্বত্র । মুর্শিদকুলি খাঁ প্রতিষ্ঠিত কাটরা মসজিদ দেখতে আসেন সারা বিশ্বের পর্যটক। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ এই সৌধটিকেও বেশ যত্নে রেখেছে দেখলাম। অসাধারণ এই সৌধটির স্থাপত্য দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। ছোট ছোট বিশেষ আকারের লাল রঙের ইট দিয়ে নির্মিত এই অতি বৃহৎ সৌধ। গাইড জানালেন, এই ইটগুলি শুধু এই মসজিদ বানানোর জন্যই তৈরি। অপরূপ এক ফুলের বাগান ও সবুজ ঘাসের গালিচায় ঘেরা কাটরা মসজিদ। এর খোলা ও বিস্তৃত ছাদে এক সঙ্গে বহু মানুষ বসে নামাজ পড়তে পারেন। এই মসজিদের ভিতরেই রয়েছে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি, যেখানে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ায় সব ধর্মের মানুষ।
মুর্শিদাবাদ বহু ইতিহাসের সাক্ষী। ভাগীরথীর দুই তীরে নবাবী থেকে ব্রিটিশ আমল, নানা ধর্ম ও জাতির মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। পুরো মুর্শিদাবাদ জুড়ে তাই অসংখ্য প্রাসাদ, মসজিদ, সমাধিক্ষেত্র, স্মৃতিসৌধ, মিউজিয়াম। দেখার মতোই লিখে শেষ করা কঠিন। তারই মধ্যে আরও কয়েকটি না ভোলা স্মৃতি দিয়ে ইতিহাসে ইতি টানবো।
মুর্শিদকুলি খাঁর দুই কন্যাকে বিয়ে করেন সুজাউদ্দিন মোহম্মদ খাঁ। অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন ইনিও। মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে বসলেন জামাই সুজাউদ্দিন। বিলাসী ও জাঁকজমকপূর্ণ মানুষটি দু হাতে টাকা ওড়াতেন। তবে, সে শুধু নিজের জন্য নয়। উৎসবে, পার্বণে প্রজারাও পেত অর্থসামগ্রী। সুজাউদ্দিনের সময় আর্থিকভাবেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো মুর্শিদাবাদ। রোশনিবাগে তাঁর সমাধি সন্নিকটস্থ মসজিদে উৎসব উপলক্ষে জ্বলে উঠত অসংখ্য আতশবাজি। তার রোশনাই দেখতে জড়ো হতো দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষ। এই মসজিদ ও সমাধি দেখতে আজও ভিড় করে উৎসাহী মানুষের দল। অনেকটা ছড়ানো গাছগাছালিতে ঘেরা সুপরিকল্পিত ভাবে প্রস্তুত এই মসজিদ ও সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ এখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বে।
সুজাউদ্দিনের বেগম, মুর্শিদকুলি খাঁর কন্যা আজিমুন্নিসা বেগম। তাঁর কথা না বললে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস অসমাপ্ত থেকে যাবে। নবাবী বিচার ব্যাবস্থার এক নিষ্ঠুর ও কঠিন রূপের দেখা মেলে এক্ষেত্রে। তবে, অপরাধের মাত্রাও কিছু কম ছিলো না, উল্লেখ প্রয়োজন সেটাও। মুর্শিদাবাদ এলে গাইড আপনাকে নিয়ে যাবেই আজিমুন্নিসা বেগমের সমাধি ও তৎসংলগ্ন মসজিদ দেখাতে। মসজিদ এখন ধ্বংসস্তূপ। শোনা যায়, তাঁকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, এই সমাধি হলো মসজিদে যাওয়ার যে পথ, তার নিচে। পথটির ওই বিশেষ অংশ, যার নিচে চিরনিদ্রায় আজিমুন্নিসা, সেটি লোহার জালে তৈরি। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষ, যারা ওই পথে যাবে, তাদের পায়ের ধুলো পড়বে আজিমুন্নিসার সমাধির ওপর।
আজ এই এত বছর পরও আজিমুন্নিসা বেগমের শাস্তি শেষ হয়নি। আজও অগণিত মানুষের পায়ের ধুলোয় স্নাত তাঁর সমাধি। এবার তাঁর অপরাধের কাহিনী। ইতিহাস তাঁকে কলজেখাকী বলে চিহ্নিত করেছে। একবার কঠিন অসুখ হয়েছিলো আজিমুন্নিসার। হাকিম নিদান দিয়েছিলো , খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে শিশুর কলজে। অসুখ সারলো, কিন্তু নেশা ছাড়লো না বেগমের। রোজই তাঁর শিশুর কলজে চাই। খবর গেলো নবাবের দরবারে। তারপরই ওই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এই শাস্তি নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। স্বামী সুজাউদ্দিন না বাবা মুর্শিদকুলি খাঁ–দুজনের মধ্যে কে, নাকি দুজনে মিলেই এই বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া সংগঠিত করেন, মতভেদ তা নিয়েই।
বিতর্ক, মতভেদ ইতিহাসের চিরন্তন অঙ্গ। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এই ব্যাপারটা বার বার অনুভব করেছি। সব তথ্যেরই দুটি/তিনটি মত আছে। তবে যাঁকে নিয়ে কোনও মতভেদ নেই, তিনি মীর জাফর আলী খান বাহাদুর। ইতিহাসে তিনি বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর হিসেবে কুখ্যাত। পার হয়েছে কয়েকশো বছর, বদনাম ঘোচেনি মীরজাফরের। তাঁর প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম ইতিহাসের চাবুকটি কতখানি শক্তিশালী। লোকে ওঁর প্রাসাদের নাম দিয়েছে নিমকহারাম দেউড়ি। অত্যন্ত ভগ্নদশা প্রাসাদের। শুনলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর রক্ষণাবেক্ষণ করতে চাইলেও রাজি হয়নি মীরজাফরের বংশধররা।
ভাঙা বিশাল গেট হা করে খোলা। দোতলার ছোট একটি জানালায় ছেঁড়া পর্দা ঝুলছে। সিরাজের সেনাদলের প্রধান। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজকে পরাজিত করেছিলেন। ধূর্ত ইংরেজ তাঁকে ব্যবহার করেছে, এটা বুঝতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল। জাফরগঞ্জে মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র। দৈন্যদশা তারও। পরিবার নিয়ে এখানেই চিরঘুমে তিনি। বাংলার মসনদে বসেছিলেন মীরজাফর। তবে সে আর কদিন ? স্বপ্ন ভেসেছে ভাগীরথীর জলে। মৃত্যু তাঁকে শান্তি দিতে পেরেছিল কিনা, কে জানে !
কলকাতা বা অন্য যে কোনও প্রান্ত থেকে পৌঁছে যেতে হবে বহরমপুর। এখান থেকেই যেতে হবে মুর্শিদাবাদ। বহরমপুরে প্রচুর ভালো হোটেল আছে। সকলেই দ্রষ্টব্যগুলি দেখার ব্যাবস্থা করে। গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে কেন্দ্রগুলি। তবে, সবটাই মুর্শিদাবাদ শহর ও শহরতলি ঘিরে, ভাগীরথীর এপারে, ওপারে। একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে যেতে পারলে ভালো। হোটেল থেকেও এ ব্যাপারে যথাযথ গাইডেন্স মেলে। প্রবল গ্রীষ্ম বাদ দিয়ে যে কোনও সময়ই যাওয়া যায় মুর্শিদাবাদ। তবে, শীতে ঘোরাঘুরি করতে সুবিধা হয় নিঃসন্দেহে।
★★ যখনই বেড়াতে যাবেন (নিয়মিত বিভাগ)
🌈 প্যাকিং ফান্ডা
🔺কি কি নিয়ে যাবেন তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলুন চটপট। এটা বেশ কয়েকদিন আগেই করুন। এতে জরুরি ও প্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
🔺ব্যক্তিগত জরুরি জিনিস, টাকাপয়সা, ট্রেন বা ফ্লাইটের টিকিট, হোটেলের বুকিং স্লিপ ইত্যাদি এমন জায়গায় রাখুন যা হাতের কাছে থাকবে অথচ বিশেষ যত্ন-খেয়ালও রাখা যাবে। ক্যামেরা, ল্যাপটপ ব্যাগের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।
🔺 ফার্স্ট এড বক্স, সাধারণ জরুরি ওষুধ এবং আপনি নিয়মিত যে ওষুধ খান তা যথাযথ পরিমানে সঙ্গে রাখুন।
🔺 টর্চ-মোম-দেশলাই অবশ্যই রাখতে হবে।
🔺সানগ্লাস, ছাতা ও বর্ষাতি রাখতে পারলে ভালো।
🔺ভাঁজ নয় জামাকাপড় ফোল্ড করে প্যাক করলে কম জায়গায় বেশি পোশাক আঁটবে। আর জামাকাপড়ের ভাঁজও নষ্ট হবে না।
🔺জামাকাপড়-জুতো ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিন কোথায় যাচ্ছেন, সেই অনুসারে। যেমন, পাহাড়-জঙ্গল-সি বিচ যেখানে, সেখানে হিলতোলা জুতো নয়, স্পোর্টস শু জাতীয় হলে ভালো। আর পোশাকও প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। প্রসাধনী ও রূপচর্চার উপকরণও যেটা না হলে নয়, ততটুকুই। মনে রাখুন, বোঝা বাড়ালে পথে চলাফেরায় কষ্ট। শীতের জায়গায় যথেষ্ট শীতপোশাক রাখুন সঙ্গে।
🔺গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে সঙ্গে রাখুন কিছু শুকনো খাবার, টি ব্যাগ, কফি পাউডার, গরমজল করার ইলেকট্রিক কেটলি, কাগজের কাপ ও প্লেট, টিস্যু পেপার।
🌈 যাওয়ার আগে কি কি করবেন
◾যথাসম্ভব জায়গাটা সম্পর্কে আগাম খোঁজখবর নিয়ে নিন। স্পটে গিয়ে কি কি দেখবেন, কিভাবে সময় কাটাবেন, তার একটা ধারণা থাকলে সুবিধা হবে আপনার। বাজেট করা ও প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রেও এটা জরুরি।
◾জেনে নিন, কাছাকাছি এটিএম, প্রয়োজনে ডাক্তারের ব্যবস্থা আছে কিনা। না থাকলে সেই অনুসারে আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
◾চেষ্টা করবেন থাকা-খাওয়া-যাতায়াত-সাইট সিয়িং-শপিং ইত্যাদি খরচাপাতির জন্য একটা নির্দিষ্ট বাজেট করে নেওয়ার।
◾বেড়াতে গিয়ে যাতে অসুস্থ না হয়ে পড়েন, তার জন্য আগে থাকতেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।
🌈 আগাম বুকিং এবং
এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত দিক। যাঁরা হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়েন, দল বেঁধে বা একা এবং বুকিংয়ের তোয়াক্কা করেন না, তাঁদের জন্য এই বিভাগ নয়। যাঁরা কিছুটা নির্ঝঞ্ঝাট বেড়ানো পছন্দ করেন, পরিবার পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাঁরা সচরাচর এডভান্স বুকিং না করে যান না। আমি নিজেও সেভাবেই সারা জীবন ঘুরেছি। এই বুকিংয়ের ক্ষেত্রে অনেকসময়ই এজেন্ট, পাহাড়ের ক্ষেত্রে হোমস্টে মালিক এবং সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে পর্যটকদের নানা বিষয়ে অশান্তির কথা শোনা যায়। এক্ষেত্রে যে সাবধানতা গুলি অবলম্বন করা যেতে পারে—
■ এজেন্ট সম্পর্কে ভালো করে আগে খোঁজ নিন
■পাহাড়ের হোমস্টে মালিকরা এমনিতে সৎ। কিন্তু ততটা পেশাদার এখনও নয়। কথাবার্তা, আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও ওদের কিছুটা সমস্যা আছে। ওদের ক্ষেত্রে বার বার জিজ্ঞেস করে, ভাষার কোনও সমস্যা থাকলে, সেটা কাটিয়ে উঠে, নিজের চাহিদা পূরণের ব্যাপারটা আগে থেকে বুঝে নিন।
■ কোনও কারণে বেড়াতে যাওয়া ক্যান্সেল হলে এডভান্স বুকিংয়ের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না, এটাই নিয়ম। একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আপনার টাকা গচ্ছিত থাকবে ওই এজেন্ট, হোমস্টে মালিকের কাছে এডভান্স হিসেবেই। সেই সময়ের মধ্যে আপনি যেতে পারবেন সেখানে। এই বিষয়টিও বুকিংয়ের সময় পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।
🌈 কি করবেন
◾মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন। যেখানে গেছেন, সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে যত বেশি মানিয়ে চলবেন, তত মজা-খুশি-আনন্দ অনন্য প্রাপ্তি হয়ে ধরা দেবে আপনার অভিজ্ঞতায়।
◾যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঘুরুন। এতে জায়গাটির সত্যিকারের এসেন্সটা পাবেন।
◾জেনে নিন এলাকার মানুষের জীবন, তাদের শিল্প-সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ইতিহাস।
🌈 কি করবেন না
◾যত্রতত্র প্লাস্টিক, আবর্জনা ইত্যাদি ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
◾লক্ষ্য রাখুন আপনার আনন্দ-উল্লাস যেন অপরের বিরক্তির কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।