চপল ঝর্নার দেশে কয়েকদিন
দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। পর্যটন আকর্ষণে অতুলনীয় ওড়িশার কেওনঝর নিয়ে লিখছেন লিপি চক্রবর্তী। তিন পর্বে প্রকাশিতব্য এই ধারাবাহিক ভ্রমণ রচনার তৃতীয় ও শেষ পর্ব আজ।
গত সপ্তাহে লেখা শেষ করেছিলাম মা তারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠার গল্প দিয়ে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার ফলে মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাইরের কারুকার্য দেখেই পান্থনিবাসে ফিরে আসতে হয়েছিল আমাদের। সেই কারুকার্যও অপরূপ। কত যত্নে ও নিষ্ঠায় যে এইসব মন্দির গড়ে তোলা হয়েছিল সেকালে, দেখলে একই সঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে হয়। যাই হোক, পান্থনিবাসে ফেরার পর কথা-গল্প-আড্ডায় সন্ধেটা ভালোই কেটে গেল। ডিনারের পর এই রাতে একটু তাড়াতাড়ি নিদ্রাদেবীর আরাধনায় ধ্যানমগ্ন হলাম। কারণ, পরেরদিন অনেকটা বেড়ানো আছে।
পরেরদিন ভোর ভোর বের হলাম। প্রথমে যাব গোনাসিকা। এটি বৈতরণী নদীর উৎস। জঙ্গল ঘেরা এই জায়গায় বেশ অনেকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। সিঁড়ির মুখেই ছোট্ট এক শিবমন্দির। জঙ্গলের ঘেরাটোপে মায়াময় পরিবেশ। আগের দিন অত বৃষ্টি হওয়ায় সিঁড়িপথে কলকল করে নামছে জলের ধারা। পিচ্ছিল পথে পা টিপে টিপে উঠে গেলাম ওপরে। ছোট্ট এক মন্দির, ব্রহ্মশ্বর মন্দির। স্বয়ং ব্রহ্ম নাকি এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। জনশ্রুতি যাই থাক, মন্দিরটি যে শতাব্দী প্রাচীন, সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মন্দিরের ভিতরে গরুর নাকসদৃশ পাথরের ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসছে বৈতরণী নদী। সাধুসন্তদের কাছে এই স্থান খুব আদরণীয়। আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকা আমাদের কাছে পাহাড়, জল-জঙ্গল, মন্দিরের মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ, যেখানে শান্তির কোনো অভাব নেই।
চারিদিকে ঘন জঙ্গল। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে থাকা পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে কোনও রকমে দ্রুত নেমে এলাম। এবার দৌড় খণ্ডাধার জলপ্রপাতের দিকে। খণ্ড অর্থাৎ ওড়িশার ভাষায় তলোয়ার আর ধার অর্থ ধারা বা স্রোত। কথিত আছে, এই স্থানে রামচন্দ্রের হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ে পাহাড় দু’টুকরো হয়ে জলধারা বেরিয়ে এসেছিল। তাই এই প্রপাতের নাম খণ্ডাধার। ভূগোল বলে, কোনও এক আগ্নেয়গিরি থেকে বহুযুগ পূর্বে এর সৃষ্টি। তা সৃষ্টিরহস্য যাই হোক না কেন, প্রায় আটশো ফুট ওপর থেকে সোজা সে ঝাঁপ দিয়েছে সমতল লক্ষ্য করে। গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি যখন এঁকেবেঁকে উঠছিল, তখন বারবার সে দৃশ্যমান হচ্ছিল। কিন্তু সে যে এমন আহ্লাদী, কী অসম্ভব তার ঝরে পড়ার গতি, তার এতটুকু কাছে গেলেই ঝরঝরিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সকলকে, সামনে না গেলে বোঝাই যাবে না।
অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছতে হলো তার কাছে। কোপ্রানি নদী থেকে উদ্ভুত হয়ে নিচে গিয়ে মিশেছে ব্রহ্মণী নদীতে। প্রকৃতি প্রেমিকদের স্বর্গরাজ্য এই খণ্ডাধার ফলস। এখানে নেচার ক্যাম্প করার জন্য অনেকেই আসেন। অতি উৎসাহীরা প্রপাতের একদম ওপরে উঠে যান, আরও খানিক অ্যাডভেঞ্চারের আশায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি। জলপ্রপাতেরাও তাদের রূপরাশি মেলে দিয়েছে আমাদের সামনে। তবু ফিরতে হয়। আরও দেখা আছে বাকি। এবার যাব বড়া ঘাগড়া ড্যাম আর প্রপাত।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লালমাটির রাস্তা। দু’দিকে সবুজের ঘের। এত সুন্দর, শুধু রাস্তা দিয়ে চললেই মন ভরে যায়। সোজা গিয়ে উঠলাম বড়া ঘাগড়া বাঁধের ওপর। বিশাল জলাধার। বাঁধানো পাড়। কিন্তু বাইক যেতে পারলেও গাড়ি যাবে না। না যাওয়াই ভালো। প্রকৃতিকে দুরমুশ না করাই উচিত। এই জলাধারটি হলো কেওনঝরের লাইফ লাইন। এখানেও চারদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। জলাধারের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে নেমে এলাম বড়া ঘাগড়া প্রপাতের কাছে। নেমেই সামনে একটা ছোট্ট শিব মন্দির। পাহাড় প্রমাণ উঁচু বাঁধ, সামনে বিশাল জলপ্রপাত, সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তরের মাঝে এই একলা মন্দিরটি এক অপরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সামনেই বিশাল উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া জলরাশি আর উল্টোদিক থেকে তিরবেগে বয়ে আসা জলধারা গভীর খাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে আনন্দ আর ভয় যেন পরস্পর একসঙ্গে জড়িয়ে ধরল আমাদের।
এই জায়গাটি পিকনিক স্পট হিসেবেও বহুল প্রচারিত। কেমন যেন আবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। তখনও জানি না, আরও এক বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে হল সানা ঘাগড়া। সানা অর্থে ছোট। কিন্তু ছোটর যে এত গতি তা জানা ছিল না। পান্থনিবাসের দিকে তখন ফিরছি আমরা। চালক ভাইকে জিগ্যেস করলাম, সানা ঘাগড়া দেখব না? সে বলল, ওখানেই তো যাচ্ছি। ওমা! নিয়ে এল এক বিনোদন পার্কে। একটা জলাশয় পার্কের মাঝখানে। সেখানে বিশাল শিবের মূর্তি। অনেকে জলবিহার করছে বোটে চড়ে। বাচ্চারা খেলছে পার্কে। অনেক ফুলের গাছ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি কই। এরকম পার্ক তো বহু দেখেছি !
আমাদের মনোভাব বুঝেই বোধহয় গাড়ির চালক বলল, পিছন দিকে যান। সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি উঠে আবার খানিক নেমে সানা ঘাগড়া দেখতে পাবেন। সিঁড়ি উঠছি তো উঠছিই। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে। পার্কের বাচ্চাদের কলকল আর শোনা যাচ্ছে না, জলের আওয়াজও নয়। নিস্তব্ধ চারদিক। অনেকটা ওঠার পর সিঁড়ি এবার নামছে নিচের দিকে, অতএব আমরাও নিম্নগামী। হঠাৎ, একদম আচমকা এসে পড়লাম তার পায়ের কাছে। এই বিশালত্ব বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। কী তার গর্জন, সবকিছু ভাসিয়ে নেবে যেন। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হলো, আমিও ঝাঁপ দিই তার উত্তাল গর্ভে। মায়া নেই তার, দাম্ভিক, অকরুণ। প্রবল বেগে নিম্নগামী। প্রতিটা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ফুলে ফেঁপে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল আমাদের। ওই টান উপেক্ষা করে ফেরা যে কী আনন্দময় যন্ত্রণার তা লিখে বোঝানো যাবে না।
তবু ফিরতে হয়। ওড়িশা এসেছি আর জগন্নাথদেব দর্শন করব না, তা আবার হয় নাকি! ফেরার পথে কেওনঝর শহরের মাঝখানে অপূর্ব জগন্নাথ দেবের মন্দিরটি ঘুরে, ঠাকুর দর্শন করে ফিরে এলাম পান্থনিবাসের ঘরে। এই ট্যুর যাতায়াত নিয়ে পাঁচদিনের হলে ভালো হয়। আমরা চারদিন ছিলাম। আক্ষেপ, হাতে আরও একদিন বেশি না থাকায় হান্ডিভাঙা আর কিচকেশ্বরী দেখতে পারিনি আমরা। পরদিন কলকাতায় ফেরা।
কেওনঝরে থাকার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হলো ওড়িশা পর্যটন নিগমের অন্তর্গত পান্থনিবাস। বেড়ানোর গাড়ির জন্য পান্থনিবাসের ম্যানেজারের সাহায্য নিতে পারেন। সেটাই সুবিধেজনক। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে পান্থনিবাসের যাবতীয় ব্যবস্থা খুবই পরিচ্ছন্ন ও তৃপ্তিদায়ক। কর্মীদের ব্যবহার একই সঙ্গে পেশাদারি ও আন্তরিক। খরচাপাতিও মধ্যবিত্তের আয়ত্তের মধ্যেই। কলকাতার উৎকল ভবনে ওড়িশা পর্যটন নিগমের অফিস–যোগাযোগ ইন্টারনেট সার্চ করলে পেয়ে যাবেন। এদের অনলাইন পেমেন্টের সুযোগ নেই। ক্যাশে বুকিং হয়। এছাড়া শহরের মধ্যে অনেক হোটেলও আছে। প্রয়োজনে সেখানেও থাকা যেতে পারে।
◾ছবি : লেখক