Monday, May 12, 2025
কৃষ্টি-Culture

‘চৈতন্য বিমঙ্গল’-এ চৈতন্যের প্রেমের বাণী

সম্প্রতি নান্দীকার ৩৯তম জাতীয় নাট্যমেলায় মঞ্চস্থ  হয় ‘নদীয়া নাট্য’ প্রযোজিত নাটক ‘চৈতন্য বিমঙ্গল’। নদীয়ার ৪৮টি নাট্যদলের সম্মিলিত প্রয়াস এই নাটকের নাট্যকার চন্দন সেন। শান্তিপুর সাংস্কৃতিক দলের নির্দেশক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় মঞ্চে ৩৪ জন ও নেপথ্যে ৬ জন কুশীলব সম্বলিত এই প্রচেষ্টার সাক্ষী হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল এককথায় অতুলনীয়। মূলত চৈতন্য সমকালীন গোঁড়া বৈষ্ণব সমাজ ও মৌলবাদী মুসলিম সমাজের প্রেক্ষাপটে চৈতন্যের জীবন ব্যাখ্যায়িত হয়েছে। ধর্মের নামে রাজনীতি বা ধর্মীয় রাজনীতির আগ্রাসনে সাধারণের জীবন কতখানি অসহায় হয়ে ওঠে, সেই চিত্রই এই নাটকের ভাষ্য।

চৈতন্য ও তাঁর বাল্যসখী ও প্রথমা স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়াকে কেন্দ্রে রেখে কাহিনি এগিয়েছে। চাঁদ কাজী ও আচার্য রঘুনাথের মতো ধর্মগুরুদের ধর্মরাজ্যে চলে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতি শোষণ ও নিপীড়ন। এই সামাজিক অবস্থার মধ্যেই ধর্মীয় অনুশাসন ও জাতপাতের রাজনীতির কবলে পড়ে লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু ঘটে। যার ফলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় চৈতন্যের প্রেমজ বিবাহ। অন্যদিকে চৈতন্যকে অবতারত্বে উত্তরণ ঘটাতে ধর্মগুরুরা যে কূটনীতির আশ্রয় নেয়, তা আসলে মৌলবাদী ধর্মের অসারতাকেই সামনে আনে। লক্ষ্মীপ্রিয়ার শববাহী মিছিল যেন সমাজের শোষিত ও অত্যাচারিত মানুষের মুখ হয়ে ওঠে।

যদিও, এ নাটকে চৈতন্য কোনও অবতারত্বে বিশ্বাসী নন। ছোট্ট বোবা সঙ্গী পাখির সঙ্গে তাঁর সখ্যতা। লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ও প্রেম। এসবের মধ্যেই তিনি সাধারণ মানুষ হয়ে বাঁচতে চান। বলা যায়, এখানেই নাটকে অনুল্লেখিত ইতিহাসকে সামনে তুলে ধরা হয়েছে। আর এই ‘মানুষ’ চৈতন্যই প্রেমের বাণী কণ্ঠে নিয়ে জাতপাত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে নিয়ে এক নতুন পথের দিকে যাত্রা করেছেন। আজকের এই অস্থির সময়ে এই নাটক সত্যিই প্রাসঙ্গিক।

‘চৈতন্য বিমঙ্গল’ নাটকের প্রায় সমস্ত অভিনেতাই তাঁদের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। ছোট্ট পাখির চরিত্রে শিশু শিল্পী বিশেষভাবে নজর কাড়ে। লক্ষ্মীপ্রিয়ার চরিত্রাভিনেত্রী তাঁর সখ্যতা, প্রেম, হাহাকার নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। চাঁদ কাজী ও আচার্য রঘুনাথ চরিত্রের অভিনেতারাও তাঁদের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। শচীমাতার অন্তর্দ্বন্দ্ব অভিনয়ে আলাদা মাত্রা এনেছে। তবে গ্রামবাসীদের মঞ্চে কোরাস হিসেবে আরও অনুশীলন প্রয়োজন। এ নাটকের মূল চরিত্র চৈতন্যের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যিনি, তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়ের প্রশংসা করতেই হয়। তিনি ইতিহাসের পাতায় দেখা চৈতন্য থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ চৈতন্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

Img 20230131 Wa0003
'চৈতন্য বিমঙ্গল'-এ চৈতন্যের প্রেমের বাণী 5

নাটকের উল্লেখযোগ্য অংশ হলো, পালাগানের আদলে গান ও বাজনদারের দলের সংগীত। এ কাজ তাঁরা মুন্সিয়ানার সঙ্গেই করেছেন। আবহ ও আলো পারস্পরিক সাহচর্যে বেশ কিছু সুন্দর নাট্য মুহূর্ত তৈরি করেছে। ব্যাকড্রপে চৈতন্যের উত্তরীয় সহ উর্ধবাহুর অতি উজ্জ্বল কাট আউট যে শৈল্পিক সুষমা তৈরি করেছে, তা এককথায় অনবদ্য। এ যেন চৈতন্যের প্রেমের বাণী নিয়ে অনন্তের পথে চলার আহ্বান, যাকে দিয়ে এ নাটকের সমাপ্তি।