Monday, February 3, 2025
ঠিকানা দিকশূন্যিপুর

চোখ মেললেই কাঞ্চনজঙ্ঘা

দিন যাপনের একঘেয়েমি আর ক্লান্তি দূর করতে পর্যটনের বিকল্প নেই। চার দেওয়ালের গন্ডি ছাড়িয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঝোলা কাঁধে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন যাঁরা, তাঁদের জন্যই এই কলম। লিখেছেন অজন্তা সিনহা

উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে থাকার পাগলামি তখন তুঙ্গে। তেমনই একটা সময়ে আমি প্রথমবার পেডং যাই। তারপর তো একাধিকবার যাওয়া–একা এবং দলে। পেডংকেই জীবনের শেষ ঠিকানা করবো, এমন একটা সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়ে গেছিল। পরে কার্যকারণে সেটা হয়নি। কিছু ঘটনা আমাদের হাতে থাকে না। সিদ্ধান্ত যেটাই থাক, ঘটে অন্য কিছু। যাকে বলে ডেসটিনি, সেই অঙ্গুলিহেলনেই আমি চুইখিমকে বেছে নিলাম। এ নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ যেমন নেই। তেমন পেডংয়ের প্রতি আমার টান বা আকর্ষণ আজও এতটুকু কমেনি।  তার কারণ নিশ্চয়ই এখানকার দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতি, ঐতিহাসিক গুরুত্ব আর পূর্ণ তামাং ও তাঁর পরিবার।

প্রথমবার এসে সেই যে পূর্ণজির হোমস্টে-তে দুদিন থেকে অতুলনীয় আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা হলো, সেই যে ওঁর সঙ্গে পারিবারিক এক বন্ধনে জড়ালাম, সেই বন্ডিং আজও অব্যাহত। সম্প্রতি এক অমল শারদ সকালে পেডং চার্চের সামনে থেকে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার অন্তর্ভূক্ত চড়াইগামী পিচ ঢালা সুন্দর পথ ধরে আপার পেডং যেতে যেতে সেইসব পুরোনো স্মৃতি তাজা হয়ে উঠছিল। আপার পেডং তৈরি হওয়ার সময় থেকেই এর অসাধারণ ভিউ সম্পর্কে শুনেছি পূর্ণজির কাছে। এবার তা প্রত্যক্ষ করলাম। গতকাল ব্রেকফাস্ট করে তেন্দ্রাবং থেকে পেডংয়ে পূর্ণজির হোমস্টে-তে এসেছি ঘোর বৃষ্টি মাথায় করে। কে বলবে এটা শরৎকাল। তা হোক। পাহাড়ে বৃষ্টিও বড় নান্দনিক, সে তুমুল হোক বা টিপটিপ–সবই যেন কবিতার মতো।

তেন্দ্রাবংয়ের গল্প আগের সপ্তাহেই বলেছি আপনাদের। পেডং খুব বেশি দূর নয় সেখান থেকে। তবে, প্রাকৃতিক বৈচিত্রে অনেকটাই পৃথক। সামাজিক দিক থেকেও অঞ্চলটি এগিয়ে। আপার পেডং, পেডং থেকে অনেকটা ওপরে। তাই প্রকৃতিগত ভাবেও আর একটু আলাদা। আজ সকালে পূর্ণজির বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট সারার পর রিচার্ড এলো তার গাড়ি নিয়ে। পূর্ণজির স্নেহধন্য এই তরুণ আপার পেডংয়ে একটি হোমস্টে চালায়। গাড়িটি তার নিজেরই। পর্যটকদের ছোট দলের ক্ষেত্রে সে নিজেই পিক আপ বা ড্রপের কাজটি করে। পুরো নাম রিচার্ড কুলুং রাই। হোমস্টে-র নাম পাম প্যারাডাইস হোমস্টে। যথার্থই স্বর্গ যেন ছোট্ট গাছপালা ও বাহারি ফুলে সাজানো এই বাড়িটি।

একটু অবাক হয়েছিলাম পাম ট্রি প্রসঙ্গে শুনে। পাম ট্রি বললেই আমাদের সমুদ্রের অনুষঙ্গ মনে আসে। আসলে এ একান্তই আমার অজ্ঞতা। হিমালয়ান পাম ট্রি-র অপার ঐশ্চর্য ছড়ানো অঞ্চলটিতে। রিচার্ডের হোমস্টে তো পুরোপুরি এই গাছের সৌন্দর্যে আকির্ণ। সেই সূত্রেই তার হোমস্টে-র এই নামকরণ। বাড়ির ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে রিচার্ডের মা ও আর এক আত্মীয়া এগিয়ে এলেন হাসি মুখে, যেন কতদিনের চেনা ! তারপর গ্রিন টি ও কুকিজ সহযোগে আড্ডা ও ফটো সেশন। এবারটায় শুধু তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে যাওয়া। পরের বার এসে থাকবোই, কথা দিলাম রিচার্ড ও তার মাকে।

ঘরগুলি ঘুরে দেখলাম। খুব সুন্দর ভাবে সাজানো আর দারুন পরিচ্ছন্ন। মোট দুটি ঘরে একসঙ্গে ৭ জন অতিথি থাকতে পারবেন এমন ব্যবস্থা। ফুল ও লতা-পাতায় সাজানো বাইরের ছোট্ট ডাইনিং স্পেসটিও আকর্ষনীয়। ঘরগুলিতে থাকা খাওয়ার রেট যথাক্রমে ১২০০ ও ১৫০০ টাকা। অভ্যন্তরের আয়োজন হিসেবে এই পার্থক্য। গিজার, ওয়াইফাই, ইনভার্টার–সবই আছে বাড়িটিতে। প্রসঙ্গত, নিজের হোমস্টে ব্যবসার পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেন রিচার্ড। এখান থেকে আমরা গ্রাম পরিদর্শনে যাব। তার আগে গ্রাম সম্পর্কে কিছু তথ্য।

আপার পেডংয়ের উচ্চতা মোটামুটি ৫৫০০ ফুট। কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্দান্ত ভিউ, যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি স্পেক্টাকুলার, পাবেন এখান থেকে। ভিউ পয়েন্টটিও দুর্দান্ত। অনেকটা বিস্তৃত ও খোলা হওয়ায় চারপাশের দৃশ্যাবলি থেকে চোখ সরানো যায় না। অঞ্চলটি সিকিম বর্ডার। তাই পূর্ব সিকিমের অনেকটা অংশ দৃশ্যমান আপার পেডং থেকে। আমি গেছি অক্টোবরের মাঝামাঝি। রিচার্ড জানায়, পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। বস্তুত এই অঞ্চলটি পক্ষীপ্রেমীদের জন্য স্বর্গ। পুরো শীতকাল জুড়ে থাকে পরিযায়ী পাখির দল। আর সারা বছর অন্যান্য পাখি তো আছেই। যেখানেই গাছপালা, সেখানেই তো পাখিদের বসবাস। অন্যদিকে জেলা কালিম্পং হলো ফুল ও অর্কিডের বৈচিত্র ও বৈভবে অপরূপ। আপার পেডংও তার ব্যতিক্রম নয়। নানা জাতের, রঙ ও বাহারের চেনা অচেনা ফুলের মধ্যে বিশেষ ভাবে বলতে ইচ্ছে করছে এজেলিয়ার (Ejeliya)  কথা–হাইব্রিড এই ফুলের চাষ হয় রডোডেনড্রন ও চা গাছ মিলিয়ে। ভারি সুন্দর দেখতে এই ফুলগুলি।

Whatsapp Image 2022 11 03 At 2.09.15 Pm
চোখ মেললেই কাঞ্চনজঙ্ঘা 18

গ্রামে মোটামুটি ৮০-১০০ ঘর লোকের বাস। পেশা মূলত চাষবাস। প্যারা মিলিটারি, মিলিটারি, পুলিশ ইত্যাদি সরকারি পেশায় আছেন কিছু মানুষ। এই মুহূর্তে হোমস্টে ব্যবসায় এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। ৩/৪টি হোমস্টে হয়েছে কিছুদিন আগেই গড়ে ওঠা এই পর্যটন কেন্দ্রে। ফসল ও ফলফলাদির মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, বার্লি, বাজরা, আলু, রাই শাক, স্কোয়াশ, বিন, টমেটো, মটরশুঁটি, বেগুন, গোল লঙ্কা, হলুদ, আদা ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী এলাকায় এখন আপেলের চাষ হচ্ছে, আগেই শুনেছিলাম। এখানেও দেখলাম আপেল চাষ প্রসঙ্গে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত রিচার্ড ও পূর্ণজি। এছাড়া ৫/৭ ধরণের পাম গাছ হয় এখানে। জীবিকার ক্ষেত্রে মৌমাছির চাষ, পোলট্রি, গো পালন অনেকেই পারিবারিক স্তরে করে থাকেন। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে পেডং তথা আপার পেডং বেশ খানিকটা এগিয়ে। বেশ কয়েকটি প্রাইমারি ও হাইস্কুল আছে। একটি সরকারি কলেজও হয়েছে সম্প্রতি। আশপাশের শহর ও গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে স্কুল ও কলেজে। রয়েছে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। পাহাড়ী অঞ্চলের তুলনায় সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু পেডং বাজার এলাকার উন্নত জীবনযাপনের পরিচায়ক।

পেডংয়ে বাস করেন সিকিমিজ ভুটিয়া, দুকপা, তামাং, রাই, শেরপা, কামি, লেপচা, লিম্বু, ছেত্রী, সন্ন্যাসী ইত্যাদি জাতির মানুষ। বৌদ্ধধর্মীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তারপর হিন্দু। শেষে খ্রিস্টান। সুন্দর সহাবস্থান এই গ্রামকে সামাজিক ভাবে সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। পূজা, দশেরা, দিওয়ালি, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা, লোসার উৎসবে মেতে ওঠেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ। গ্রাম পরিদর্শন কালে মূল রাস্তা থেকে কিছুটা উঁচুতে তামাং মনাস্ট্রি অর্থাৎ এখানকার গুম্ফাটি দেখলাম। শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। চারপাশের ভিউ অনির্বচনীয়। শুনলাম বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে দারুণভাবে সেজে ওঠে এই জায়গাটি। একটি ঝর্নাও রয়েছে কাছেই। আপেল বাগানও দেখার মতো।

আপার পেডংয়ের অনেকটা জুড়েই জঙ্গল এখনও। সেখানে পাইন, ওক, বার্চ, মেপল ইত্যাদি থেকে বেশ কয়েক প্রজাতির ওষধি গুণসম্পন্ন গাছও রয়েছে। ফুল ও অর্কিডের কথা তো আগেই বলেছি। পাখির মধ্যে উল্লেখ্য রেড পিজিয়ন, পেঁচা, কাঠঠোকরা ইত্যাদি। জঙ্গলে পশুর মধ্যে আছে বার্কিং ডিয়ার, চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন, লেপার্ড, ভালুক, বুনো খরগোশ, বুনো শুয়োর ইত্যাদি। পর্যটন আকর্ষণে কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা শুরুতেই বলেছি। ব্রিটিশ-ভুটান রাজা যুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে ড্যামসাং ফোর্ট (এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ), অতি প্রাচীন সানচেং দোরজি মনাস্ট্রি, চা বাগানের পরিত্যক্ত বাংলো, ক্রস হিল পয়েন্ট। আছে দুর্দান্ত তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট, রমিতে ভিউ পয়েন্ট। আর যেদিকেই চাও, স্তরে স্তরে ছড়ানো উঁচু-নিচু পাহাড়। সামনে ফুলের বাগান ঘেরা ছোট ছোট ঘরবাড়ি আর পথঘাটে হাসিখুশি মানুষ। পেডংয়ের বাইরে রামধুরার প্রাচীন শিব মন্দির, মনসংয়ের জলসা বাংলো, সিলেরি গাঁও যাওয়ার পথে সাইলেন্ট ভ্যালি, লাভা, লোলেগাঁও, ঋশপ, কালিম্পং শহরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য, সিকিমের কিছু অঞ্চল সাইট সিয়িংয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানায় রিচার্ড।

পাম প্যারাডাইস হোমস্টে-তে বাচ্চাদের খেলার জন্য টেন্ট এবং বার বি কিউ ও বন ফায়ারের বন্দোবস্ত আছে। লাঞ্চ ও ডিনারে ভাত/রুটি, ডাল, সবজি, ভাজি, ভর্তা, ডিমের কারি ও চিকেন থাকে। ব্রেকফাস্টে রুটি বা পুরি সবজি সহ, ফরমায়েশে ওয়াই ওয়াই এবং সন্ধ্যায় স্ন্যাকসে ভেজ বা চিকেন পকোড়া, চা দিনে ২/৩ বার। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ দেখতে হলে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি প্রকৃষ্ঠ সময়। আর ফুলের সৌন্দর্য দেখতে চাইলে মার্চ-এপ্রিল। এমনিতে অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত যে কোনও সময় যাওয়া যায়। কালিম্পং থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অবস্থিত এই অঞ্চলটিতে সেনা হেড কোয়ার্টার থাকায় বেশ কিছুটা বাড়তি নিরাপত্তা পান পর্যটকরা এখানে। নিউ জলপাইগুড়ি, বাগডোগরা বা শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া ৪৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। তবে, সবচেয়ে ভালো কালিম্পং পর্যন্ত বাস বা শেয়ার গাড়িতে চলে যাওয়া। কালিম্পং থেকে গাড়ি ভাড়া ১৫০০ (ছোট গাড়ি) ও ২০০০ (বড় গাড়ি)। এঁদের পিক আপ ও ড্রপের সুষ্ঠু ব্যবস্থা রয়েছে। প্রসঙ্গত, গাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে সিজন, অফ সিজনের কিছু ফারাক থাকে। বুকিং ও অন্যান্য তথ্য জানতে যোগাযোগ করুন এই ফোন নম্বরে : 96792 19691