জন্মান্তরেও সিনেমাকেই সঙ্গী হিসেবে চাইবো
সিনেমা ওঁদের প্যাশন। প্রতিভা, মেধা, দক্ষতা আর নতুন নতুন ভাবনার আলিঙ্গনে বিচিত্র পথগামী ওঁরা। কেউ পূর্ণদৈর্ঘের ছবি নির্মাণে ব্যস্ত, কেউ তথ্যচিত্র বা ছোট ছবি। কখনও স্বাধীনভাবে, কখনও সামান্য বিনিয়োগ―স্বপ্নের কারিগররা ব্যস্ত তাঁদের নিজের ভুবনে। এইসব সিনেমা পরিচালক ও তাঁদের কাজ নিয়েই এই বিভাগ। আজ সব্যসাচী ভৌমিক। ধারাবাহিক রচনার চতুর্থ ও শেষ পর্ব আজ। আলাপচারিতায় অজন্তা সিনহা
◆ প্রমোশন ও সোশ্যাল মিডিয়া
সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শেষপর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়াই দাঁড়িয়ে থাকে এই লড়াইটায়। যদিও ডিপেন্ড করছে কিভাবে লড়াইটা এক্সপ্লোর করা হচ্ছে। অধিকাংশই কিন্তু খুব বেশি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে ফেলছেন এবং সামগ্রিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় অধিকাংশ লোকজন যেভাবে মুভ করছে সেটা বেশ দুর্ভাগ্যজনক। তবু, ভালো দিকটাই দেখা যাক। ধরুন, একটা ছোট বা বড়ো ছবি আপনি বানালেন, আপনি যদি গোটা শহরও পোস্টারে ভরিয়ে দেন, লোকে তাকিয়েও দেখবে না। যদি না তাতে প্রসেনজিৎ বা দেবের মতো জনপ্রিয় তারকার ছবি থাকে। সেক্ষেত্রে একটা পোস্টে আপনি প্রচুর মানুষকে রিচ করতে পারবেন এবং নির্লজ্জের মতো হ্যামারিং করে যেতেই হবে। তারপর আছে সেই পদ্ধতি, যা পৃথিবীর সব ছবির সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার–হুইস্পারিং ক্যাম্পেন। এটাও সোশ্যাল মিডিয়ার বেসেই হয়ে থাকে।
তবে, পুরো approachটার মধ্যে একটা সংগঠিত কাঠামো থাকতেই হবে। এটাও ঠিক, ডিজিট্যাল যুগে এতো ভুলভাল ছবি হচ্ছে, এতে আসল ছবিগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ইউটিউবে দশ মিনিটের ছবি বানিয়ে, তার প্রচার চলছে এবং ভুয়ো ফেস্টিভ্যালের পুরস্কারের লরেল জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে, মুড়ি-মিছরির একদর হয়েই যাচ্ছে। তবু, আশা ছাড়লে চলবে না। এই প্ল্যাটফর্মটাই এখন সবচেয়ে ইনটেন্স। একে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। শুধু ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি নয়, বিগ বাজেটের ছবিও কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি নির্মাতাদের সেখানেও একটা লড়াই করতে হয়।
◆ জীবনবোধসম্পন্ন, গবেষণালব্ধ, ব্যতিক্রমী ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নির্মিত বাহুল্যহীন স্বল্প বাজেটের ছবি ও দর্শকের মানসিক প্রস্তুতি
কোনও দিনই প্রস্তুত ছিল না। ঋত্বিক ঘটক বা অন্য কোনও নাম ড্রপ না করেই এটা বলা যায়। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দর্শকের পারফরম্যান্স প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে যায়। মার্কেটিং-ও একটা ফ্যাক্টর। টার্গেট ভিউয়ার নিয়ে যদি পরিচালক শিওর থাকেন, ছবিটা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি সেই উদ্যোগ থাকে, দর্শকও পজিটিভলি রিয়াক্ট করে। মোদ্দা কথা, দর্শক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাইন্ডসেট নিয়ে ছবি দেখে। এই OTT-র যুগে দুমিনিট খারাপ লাগলে, দর্শক মার্সিলেসলি অন্য কনটেন্টে চলে যাচ্ছে। কখনও কখনও এমনও দেখা যাচ্ছে, ছবির গুণগত মূল্যের চেয়ে তার লুক এন্ড ফিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি কখনও কখনও লুক এন্ড ফিলটাই গুণগত মূল্যের মাপকাঠি হয়ে যাচ্ছে। এটা মারাত্মক খারাপ একটা ট্রেন্ড। এটা হতে থাকলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি তার কৌলিন্য হারাবেই। অর্থাৎ, দর্শককেও অনেক বেশি প্রস্তুত হতে হবে, এজাতীয় ছবি দেখার জন্য। মুশকিল হলো, সেই প্রস্তুতির স্পেসটাও কমছে। ফিল্ম সোসাইটিগুলো মোটামুটিভাবে হাত তুলে নিয়েছে। এই OTT জমানায় তাদের পক্ষে আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সম্ভব নয়। জানি না কি হতে চলেছে। কিন্তু সাধারণ দর্শক ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার দূরত্ব বাড়ছে, বেড়েই চলেছে। এটা alarming !
◆ স্বল্প বাজেটের ছবি ও দর্শকের মশলাদার চাহিদা
ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির আসল চ্যালেঞ্জ তো এখানেই। আর মশলারও কোনও সংজ্ঞা নেই সেই অর্থে। অনেক ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেকারকেও দেখেছি খুব সিরিয়াস সাবজেক্ট-এ কিছু কম্প্রোমাইজ করতে। হয়তো বাধ্য হয়েই করেছেন। বাণিজ্যর বাইরে একটা কথা বলি–প্রাসঙ্গিক বলেই। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নামে একটা ছবি দু’কোটি মানুষ দেখেছিল। ঠিক ওই সময়ই মলয় ভট্টাচার্য একটা পাথব্রেকিং ছবি করেছিলেন–’কাহিনী’। ওরকম আন্তর্জাতিক মানের ছবি খুব কম হয়েছে। কিন্তু, ছবিটা তখন দুহাজার লোক দেখেছেন কিনা সন্দেহ। মজার কথা হলো ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ এখন কেউ দেখে না। মলয়দার ‘কাহিনী’ এখনও ফিল্ম বাফরা খুঁজে খুঁজে দেখে। ছবিটা এখনও OTT-তে পাওয়া যায়। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার, মলয়দা ওই ছবিটার পর আর প্রোডিউসার পাননি। পরে ‘তিন এক্কে তিন’ নামে একটা আধা কমার্শিয়াল ছবি বানান। চলেনি ছবিটা। আমাদের মনে রাখতে হবে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির মহানতা কালজয়ীতায়।
এটাও বলবো, বাণিজ্য একটা বিশাল ফ্যাক্টর। সেটা কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায়না। কারণ, যে ধরণেরই ছবি হোক না কেন, তার জন্য অনেক টাকা লাগে। সে টাকা ফেরৎ দেওয়ার তাগিদ থাকা চাই অবশ্যই। নাহলে, ব্যাপারটা অসততা হয়ে যাবে। যেহেতু, কম বাজেটে তোলা হয়, টাকাটা তুলে দেওয়াটাও একটু সহজসাধ্য হয় তুলনামূলকভাবে। সিনেমা হল রিটার্ন, OTT সেল, স্যাটেলাইট সেল–সব নিয়েই ভেবে রাখতে হয়। তবে, যেহেতু বাণিজ্যিক মশলা কম, তাই, সবকিছুতেই অনেক obstacle আসে। সবটা নিয়েই এগোতে হয়। খুব অনির্দিষ্ট যাত্রা। কিন্তু, আর তো কিছু করার নেই।
◆ উৎসবে ছবি নির্বাচন, স্বচ্ছতা ও সঠিক বিচার
সবসময়েই যে এটা পাওয়া যায়, তা নয়। অনেক সময় এমন কিছু ছবি উৎসবে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখি, যার কোনও কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আর হাতে গোনা কয়েকটা ফেস্টিভ্যাল বাদ দিলে, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তো এখন একটা ব্যবসা। বেশ ভালো অঙ্কের এন্ট্রি ফি লাগে। অনলাইন ফেস্টিভ্যালগুলো চালানোর খরচ কম। কিন্তু এন্ট্রি ফি কম হয় না। ফেস্টিভ্যালে পাঠানোরও প্রফেশনাল লোক থাকে। আর পুরো ছবির ফাইনাল আউট পাওয়ার পর প্রোডিউসারের পকেটে টান পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ফেস্টিভ্যালে পাঠানোর ব্যাপারটা বিশেষ গুরুত্ব পায় না। কিন্তু ফেস্টিভ্যাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবির একটা বিরাট প্ল্যাটফর্ম চিরদিনই ছিল। একটা সময় সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেনদের এটা নিয়ে বেশি ভাবতে হতো না। এখন দালাল, অন্যান্য করাপশন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটা।
◆ পেশাগত ঝুঁকি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রাইভেট স্পনসর
নেই বললেই চলে। NFDC একটা সময় পর্যন্ত বেশ কিছু ছবি স্পনসর করেছে। এখন তো আর দেখিই না। স্পনসর মানে ওই ফাইন্যান্সার। সে যেটুকু টাকা দেয়, তার মধ্যেই নির্মাতার দক্ষিণা–এর বেশি কিছু না। অপর্ণা সেন একবার একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তরুণ ফিল্মিমেকারদের একটা কোনও কাজ করার পাশাপাশি ছবি বানানো উচিৎ। এর ফলে সে রুটিরুজির প্রশ্নে আটকে যাবে না, আপোষও কম করতে হবে। কথাটার মধ্যে মেরিট আছে। কারণ, এমন প্রপোজালও আসে–ঠিক আছে, ছবিতে পয়সা ঢালবো কিন্তু একটা বার ড্যান্স রাখতে হবে বা নায়িকা অমুককে করতে হবে। সে নায়িকাকে আপনি হয়তো চেনেনই না। তিনি ফাইন্যান্সরারের ‘স্নেহধন্য’। এগুলোর বিরুদ্ধে সহজে না বলা যায়। আমি নিজে একটা কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করে যাচ্ছি। আজও ছাড়তে পারলাম না। এর একটাই advantage–আপোষ করে কাজ করতে হয়নি।
কিন্তু, উল্টোদিকেও একটা সত্যি আছে। এত বেশি যোগাযোগনির্ভর হয়ে গেছে এই ফিল্মিদুনিয়া, একজন হোলটাইমারের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। সে একদিনে যে সময়টা দিচ্ছে, আমার মতো যারা চাকরি ক’রে কাজ করছে, সারা সপ্তাহে সেটা দিতে পারছে না। এই ফারাকটা খুব ইম্পরট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে, ওই না বলার স্বাধীনতা আর যোগাযোগে পিছিয়ে পড়া–দুয়ের মধ্যে লাট খেতে হচ্ছে আমার মতো অনেককেই।
◆ অন্তহীন লড়াই ও দিনশেষে সৃজনশীল তৃপ্তি
এই দিনের শেষটার জন্যই তো এই ধন্যবাদহীন যুদ্ধ। এই মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, এক আঁকাড়া জেদ নিয়ে। এই তৃপ্তির ভাষা এক একজনের কাছে এক একরকম। আমার কাছে ভাষাধিক কোনও আবেগ! সিনেমা তো আমার কাছে জীবনের অনন্ত শুশ্রুষা। সিনেমা আমায় অশেষ করেছে–এমনই তার লীলা। সিনেমায় বাঁচি, সিনেমাই আমার পোশাক, আমার অন্তরীণ অনুভবের একমাত্র জানলা। আর কোনও অক্সিজেন এতো অনিবার্য নয় আমার কাছে, এই গ্রহে। যদিও একটা ক্লিশে কথা নিজেকে বলি মাঝে মাঝেই–এই জার্নিটাই টার্গেট, গন্তব্য নয়। তবু, একটা ছবি যখন কোথাও একটা পৌঁছয়, সেই মুহূর্তে আমি বুঝি, জীবনের অধিকার তার প্রাপ্য ওয়ালেটটি বুঝে নিয়েছে সচেতনভাবে। পুনর্জন্মও যদি সম্ভব হয়, সিনেমাকেই সঙ্গী হিসেবে চাইবো, আমার পাপপুণ্যের মধ্যস্থতার জন্য।