Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

ঝরা পাতা গো…

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই  নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

চুইখিমের বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছে, সেই সময় প্রথমেই যাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় রূপা তাদের মধ্যে একজন। রূপা একজন নেপালি গৃহবধূ, দরকার মতো মজুরের কাজও করে। আমার চুইখিমের বাড়ির নানা কাজ সে করেছে। মাটির দেওয়াল লেপা, ছাঁকনি দিয়ে বালি ছেঁকে তোলা, বাঁশ কেটে খুঁটি বানানো এমন নানাবিধ কাজে রোজ সকালে এসে নিয়ম করে লেগে পড়তো সে। রূপার কথা এখনও অনেক বাকি। পরে আবার আসবে সে। এখন বিমলার কথা।

বাড়ির কাজ চলাকালীন বিমলা এল রাজমিস্ত্রির কাজে। মূলত মেঝের সিমেন্ট পালিশের কাজটা করবে সে। একটা কথা বলা জরুরি। চুইখিম এক প্ৰত্যন্ত গ্রাম। আর আমার বাড়িটা হলো গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো বাড়ি। প্রায় খন্ডহর সেই বাড়িকে রেনোভেট করে নিজের থাকার উপযুক্ত করে নিয়েছি। বিচিত্র সেই রেনোভেশন পর্ব। মাটি, কাঠ, টিন, বালি, সিমেন্ট, প্লাই, টাইল, বাঁশ, গাছের খুঁটি, রং কি নেই তাতে ? প্রাচীন ও নবীন উপকরণ, প্রাচীন ও নবীন পদ্ধতি মিলিয়ে মিশিয়ে কাজ। এর মধ্যে বেশ কিছু উপকরণ সমতল মানে সবচেয়ে কাছের শহর ওদলাবাড়ি থেকে বহন করতে হয়েছিল।

বিমলার কথায় ফিরে আসি। বিমলা বয়সে আমার থেকে বছর দশেকের ছোট হবে। ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরপুর সংসার তার। নিতান্তই এক গ্রাম্য ছাপোষা গৃহবধূ বিমল। কিন্তু, পেশার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত। বিমলার সহকর্মীরা এ ব্যাপারে রীতিমতো সমীহ করতো তাকে। অত্যন্ত মিষ্টভাষী বিমলার সঙ্গে গ্রামের সকলেরই সুসম্পর্ক। আমিও যতদিন চুইখিম থেকেছি, যোগাযোগ বজায় থেকেছে । শিলিগুড়ি চলে আসার পরও গ্রামে গেলেই কোনও না কোনও ভাবে দেখা হয়েই যেত। এহেন বিমলার আচমকা সেরিব্রাল অ্যাটাকে মৃত্যু আমার চুইখিমবাসের ইতিহাসে প্রথম বেদনার অধ্যায়, যা কখনও ভোলার নয়।

এবার রূপার কথা। স্বভাবে একেবারে বিমলার বিপরীত সে। স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে গ্রামের সবার সঙ্গে রূপার ছত্রিশ আখড়া। ঝগড়াঝাঁটি লেগেই আছে। আমার চুইখিমে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু হয়ে যাওয়ার পর রূপাকে রীতিমতো সমঝে চলতাম আমিও। এক তো সে আমার নিকটতম প্রতিবেশী। তার মধ্যে সরকারি জল সাপ্লাইয়ের পাইপ আমার ট্যাঙ্কে পৌঁছবে কিনা, সেটাও নির্ভর করে রূপার মেজাজ-মর্জির ওপর। তার তিন ছেলেমেয়ের সকলেই কর্মসূত্রে বাইরে। মেয়ে বড়, বিউটিশিয়ানের কাজ করে চেন্নাইতে। ভাইরা স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর সে তাদেরকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।

ছেলেমেয়ে কাছে নেই । বাকিদের সঙ্গে বনিবনা হয় না। প্রবল হতাশা। ক্রমশ নেশার দাস এই নেপালি বধূর জন্য মায়া লাগলেও কিছু করার থাকতো না। একে তো সে নিজেই নিজের ভালো চায় না। তার মধ্যে পারিপার্শ্বিকও প্রতিকূল। তারই মধ্যে কখনও সখনও মুড ভালো থাকলে জমি থেকে রাইশাক, স্কোয়াশের ডগা এনে দিত সে আমায়। চোখের সামনে চেহারাটা হাড্ডিসার হয়ে যেতে দেখলাম। শেষের দিকে ঘুম থেকে উঠেই নেশা করে ফেলতো এবং তার প্রভাব মতোই শুরু হয়ে যেত আচরণ।

তখন ঝগড়ার জন্য আর লোকের দরকার হতো না রূপার। একা একাই চিৎকার করে যেত শেষের দিকে। হ্যাঁ, শেষের দিকেই চলেছিল সে। তীব্র ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ কার বিরুদ্ধে সে নিজেও বোধহয় জানতো না। একদিন শিলিগুড়িতে বসেই ফোনে রূপার আত্মহত্যার খবর পেলাম। তারপর কয়েকমাস গেল। গ্রামে গিয়ে শুনি রূপার স্বামী মনোজ আবার বিয়ে করেছে। বেশ লক্ষীমন্ত বউ, রূপার মতো ঝগড়ুটে নয়। তুলনা থাক। বউটি সত্যি বেশ শান্ত দেখলাম। তবু, কোথাও এক শূন্যতা। আশপাশের মাঠেঘাটে গাছপালার আড়াল থেকে, তার বাড়ির উঠোন থেকে রূপার চিল-চিৎকার আর কোনও দিন শোনা যাবে না।

চুইখিম যাওয়ার পর কাজের সূত্রে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কিন্তু একেবারে নিজে থেকে গ্রামের যে মেয়েটি আমার সঙ্গে পরিচয় করতে এগিয়ে এসেছিল, সে গঙ্গার বউ। হ্যাঁ, এটাই তার পরিচয়। নাম আর জানা হয়ে ওঠেনি। ছোট দুটি বাচ্চার মা, বয়স একেবারেই কম। এখানে সবাই খুব পরিশ্রমী। এই বউটিও। স্বামী কখনও জঙ্গলে, কখনও পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে কাজ করে। আর বাড়ির সব কাজ, সঙ্গে সামান্য যে জমি, গাছপালা তাই নিয়ে ব্যস্ত গঙ্গার বউ।

ফাঁকফোকড়ে সে আমার কাছে আসতো। নানা গল্পে কেটে যেত প্রহর। অল্প বয়সে মাতৃহারা। তবে, সৎমা খুব ভালো। তাকে কখনও মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। বাপের বাড়ি অনেকটা দূর বলে যাওয়া হয় না। স্বামী এখানে একা পড়ে যাবে। এই সব তুচ্ছ কথাবার্তায় নিজের মনকে খানিকটা আরাম দেওয়ার চেষ্টা করতো সে। স্বামী ছিল তার এক বিশাল অধিকারের বস্তু, এটা বার বার উঠে আসতো গঙ্গার বউয়ের কথায়। আমি চুইখিম থেকে শিলিগুড়ি চলে আসার আগে তার মন খারাপ। বলে, কাকে আর বলবো এসব কথা। তুমি আমার মায়ের মতো ছিলে।

এহেন গঙ্গার বউও প্রবল অভিমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে, এটা বড়ই অপ্রত্যাশিত এক আঘাত। চুইখিমে আছি তখন। কিছুদিন থাকবো। বাড়ির কয়েকটি রিপেয়ারিং-এর কাজ করাতে হবে। এক সকালে হঠাৎ শুনি, গঙ্গার বউ আত্মহত্যা করেছে। স্বামী অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, এই সন্দেহেই এমন চরম হটকারী সিদ্ধান্ত। সবাই বলতে লাগলো, বাচ্চাদের কথাও ভাবলো না গো ! আমার মনে পড়ছিল তার নানা কথা। স্বামীকে নিয়ে তার চূড়ান্ত অধিকারবোধ। সেখানে ধাক্কা লাগাটা নিছক সন্দেহ হলেও মেনে নিতে পারেনি সে। ভুল সিদ্ধান্ত তো এভাবেই নেয় অভিমানী মানুষ !

এক ফেব্রুয়ারির সকালে প্রথম পা রেখেছিলাম চুইখিমে। ঝরাপাতার আলপনা তখন গাছের তলায়, পথের ধারে। তখনও জানি না এই সব মানুষের সঙ্গে এমন অদৃশ্য এক বন্ধনে বাঁধা পড়ে যাব। প্রকৃতির শরীর জুড়ে তখনও শিশির ভেজা, কুয়াশা মাখা শীত প্রহরের আনাগোনা। দিন শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামে দ্রুত। কাজ শেষে ঘরে ফেরে মানুষ। কুলায় ফেরে পাখির দল। শুধু ফেরে না তারা, যারা চলে গেছে পরপারে। দিন যায়, দিন আসে। পাতাঝরার কাল আসে-যায়। পাতারা খসে পড়ে। এমন করেই খসে পড়া পাতাদের দলে আমিও নাম লেখাবো কোনও একদিন। উড়ে যাব বহুদূরে। দিকশূন্যিপুরে।