টিভির একান্নবর্তী পরিবার
টিভি বা আজকের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম–একটা কথা উপভোক্তারা প্রায়ই বলেন, আমাদের বাবা পারিবারিক কাহিনিই ভালো। সারাক্ষণ এইসব খুন-খারাপি-সেক্স দেখতে ভালো লাগে না। অভিযোগের তিরটা মূলত ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকেই। সেখানে এখনও ‘পরিবার’ বিষয় হিসেবে তত প্রাধান্য পায় না। টিভিতে অবশ্য তাঁরা সকাল-সন্ধ্যা পরিবার সংস্কৃতিই দেখেন। তাঁদের বক্তব্যকে গুরুত্বে রেখেই একটি প্রশ্ন রাখছি, পারিবারিক কাহিনি বলতে তাঁরা ঠিক কী বোঝেন ? তার থেকেও বড় প্রশ্ন, কোন সময়ের পরিবার, প্রাচীন না আজকের ? শহর না গ্রাম ?
নাহ, শুধু এই প্রশ্নগুলিই নয়। আরও অনেক কথা ওঠে, মেগার পরিবার ঘিরে। আগে শুরুর প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা ! এই যে একটি কাহিনি পর্বে পর্বে আমরা দেখছি, সেটা কোন সময়ের, জানাটা এইজন্যই জরুরি, কেন না, সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষের যাপনকলা বদলে যায়। বদলায় পরিবেশ ও সংসার যাত্রার সবটাই। পথঘাট, গাড়িঘোড়া, বাড়িঘর, সাজপোশাক, আসবাব থেকে যাবতীয় গৃহস্থালি সরঞ্জাম ইত্যাদি। বদলে যায় কথা বলার ভঙ্গি, আচার-ব্যবহার, চলাফেরা এবং আরও অনেক কিছু।
কিন্তু আমরা কী এই সময়ের ব্যবধানের বিষয়টিকে মেগায় মান্যতা দিতে দেখি ? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখি না। পরিবারের মানুষগুলি কথা বলছে আধুনিক সময়ের মেজাজে। সাজপোশাক মান্ধাতা আমলের। আর আজকের সময়ে কোথায় এমন একান্নবর্তী পরিবার রয়েছে ? অন্তত, শহর বা শহরতলীতে তো মোটেই নেই। আর গ্রামেও শতাংশের হিসেবে ক’টা পরিবার আজ একান্নবর্তী, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। অর্থাৎ যে পরিবারগুলির গল্প আমরা ছোটপর্দায় দেখছি, সেগুলির কোনও অস্তিত্বই বাস্তবে নেই। একটা লম্বা সময় পুরোনো বাংলা ছবিতে আমরা প্রচুর পরিবারিক গল্প দেখেছি। সেসব গল্প কতখানি বাস্তবসম্মত, পাঠককে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। যেসব ছবি উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ, তার কথা ছেড়েই দিলাম। যেসব ছবি মানের দিক থেকে তেমন উন্নত নয়, কিছুটা সস্তা মেলোড্রামা যুক্ত, সেগুলিও এতটা অবাস্তব নয়।
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বলবো। সেটা হলো কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে প্রেম, দাম্পত্য, বাৎসল্য, বন্ধুত্ব–যাবতীয় মানবিক আবেগই যেন ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপে আচ্ছন্ন। সারাক্ষণ কেউ না কেউ প্লট করছে অন্যের বিরুদ্ধে। যে নেগেটিভ চরিত্রগুলিকে আমরা দেখি, তারা চূড়ান্ত পর্যায়ের ‘কালো’ আর অসম্ভব চতুর। এতটাই যে, বাকিরা দিন-মাস-বছর পার করেও এই ষড়যন্ত্রকারীদের চিনতে পারে না। বোকা বনতেই থাকে। আর একটি বিষয়, নারী-পুরুষের সম্পর্ক চিরজটিল, আমরা সকলেই জানি। তা সত্বেও এমন অসৎ, মানসিকভাবে অসুস্থ সম্পর্কের ছবি, যা আমরা অহরহ মেগার গল্পে দেখি, তেমনটা কী আদৌ বাস্তবে ঘটে ?
প্রশ্নগুলো পাঠকের সামনেই রাখলাম। শেষ সিদ্ধান্ত তো তাঁদেরই। তাঁরাই ঠিক করবেন, গ্রহণ ও বর্জনের নীতি ! পরিবার আমাদের আশ্রয়। দিনের শেষে সেখানেই যেতে হয় আমাদের। সেই প্রেক্ষিতে, ঘরের ভিতরের পর্দায় তার প্রতিচ্ছবি দেখতে চাওয়াটা দোষের নয়। তথাকথিত ক্রাইম ও সেক্স (এটাও জীবনের বাইরে নয় যদিও) ইত্যাদি দেখতে না-ই চাইতে পারেন তাঁরা। কিন্তু যে অবাস্তব ও অসুস্থ পরিবারকেন্দ্রিক কাহিনি তাঁরা দিনের পর দিন দেখছেন, সেগুলো তাঁদের ওপর ক্রাইম-সেক্স ভিত্তিক সিরিজের থেকেও বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না তো ?