Monday, February 3, 2025
দর্পণে জীবন

তোমার নিখিল বিশ্বে কিছুই ফেলা যায় না…

জীবন নিজেই এক রঙিন জলছবি। চলার পথে কত না বাঁক! প্রতি মুহূর্তে জীবন নিজেই  নিজের রঙ বদলায়। সেই বিচিত্র জীবনের কথা এই বিভাগে। পড়ছেন অজন্তা সিনহার কলমে।

এটা কয়েক বছর আগের কথা। কিছু কাজে কলকাতায় গিয়েছিলাম। প্রায় সপ্তাহখানেক পরে বাড়ি ফিরেছি। শিলিগুড়ির এক চিলতে ফ্ল্যাট। ঢুকেই দমবন্ধ লাগে। কিন্তু জানালা খোলার উপায় নেই। খুললেই ঝাঁকে ঝাঁকে মশা। যাই হোক, ফ্ল্যাটে ঢুকে ব্যাগপত্র রেখে সাফসাফাই শুরু করেছি। ঘরের জানালা না খুললেও রান্নাঘরের জানালা খুলতেই হয়। নাহলে ঘর ধোঁয়ায় ভরে যায়। ফ্রেশ হয়ে চা খাবো। রান্নাও বসাতে হবে–সেই হিসেব করে জানালা খুলতেই শুনি খুব মিহি গলায় কেউ বলছে, “এতদিন কোথায় ছিলে শুনি ?” অবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাই। জানালার ওপাশে চলাফেরার একটা সরু প্যাসেজ। তারপরই ড্রেন ও পাঁচিল। প্যাসেজে সচরাচর লোক চলাচল করে না। ন’মাসে-ছ’মাসে যারা আসে, তারা ওই ড্রেন ও প্যাসেজ পরিষ্কারের জন্য। আর যাই হোক, তাদের গলার আওয়াজ এত মিহি কখনওই নয়। তাহলে কে ?

Images 10 1
তোমার নিখিল বিশ্বে কিছুই ফেলা যায় না… 5

পাঁচিলের ওপর একটা চড়াই বসেছিল। কিছুক্ষণ পাঁচিলের ওপরেই তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে আমার জানালায় এসে বসলো সে। বসেই, “আমি গো, আমি ! আমি বলছি ।”

মানে ? ভিরমি খেতে খেতে কোনওক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, ” আমি, মানে, তুমি, মানে… !” আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “অবাক হওয়ার কি আছে শুনি ? চড়াই বলে কি আর নিজের মনের কথাও বলতে পারবো না ?”

এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছি। বলি, “সে বলতেই পারো। সবারই বাক স্বাধীনতা আছে !”

“আগে তুমি বলো, এতদিন কোথায় ছিলে ?”

“একটু বাইরে গেছিলাম কাজে।”

“হুঁ। বুঝলাম। কিন্তু তুমি এত ঘন ঘন বাইরে গেলে,

আমাদের কি চলে ?”

“এই ‘আমাদের’ বলতে তুমি কাদের কথা বলছো ? আর আমার বাইরে যাওয়ার সঙ্গেই বা তার কিসের সম্পর্ক ?”

“বলছি। বলছি। আমরা মানে হলাম–আমি, আমার কর্তা আর আমার দুই ছানা।”

“বুঝলাম। এবার বলো আমি বাইরে গেলে তোমাদের কি সমস্যা ?”

“এই যে ড্রেনের জলের সঙ্গে দু’টো-একটা করে ভাতের টুকরো বেরিয়ে আসে, তা খেয়েই তো এই ছোট পেটগুলো ভরে। তুমি গেলে তোমার রান্না-খাওয়া বন্ধ। আমাদেরও ওই উপোস।”

শুনে একই সঙ্গে দুঃখিত ও ভাবিত হই। সত্যিই তো ! এও মনে হলো, আমি তো মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক চলে যাই। আহারে বেচারা ! এভাবে তো কখনও ভাবিনি। বরং কার্যকারণে যখনই মাড় গালতে গিয়ে ভাত পড়েছে, হায় আফসোস করেছি। আজকাল চালের কি দাম !

“কি ভাবছো শুনি ?” চড়াই চোখ ঘুরিয়ে, ঘাড় নাড়িয়ে বলে !

“না, ভাবছি, আরও তো অনেক রান্নাঘর আছে পাড়ায়। তাদেরও তো ভাত-টাত পড়ে নাকি ?”

“কই আর পড়ে ? দেখি না তো ! পড়লেও সে কদাচিৎ।”

“স্বাভাবিক। আমার মতো আর অকর্মণ্য ক’জন ? সংসারের কোনও কাজটাই তো ঠিকঠাক করতে পারি না।”

Images 8 1
তোমার নিখিল বিশ্বে কিছুই ফেলা যায় না… 6

এরই মধ্যে পাঁচিলের ওপর এসে বসেছে একটি শালিক ও একটি পায়রা। দু’জনে নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করে যেটা করছে, সেটা ভাষা না জানলেও বুঝি। নিপাট ঝগড়া যাকে বলে। এপাশ থেকে চড়াইও দু’কথা শুনিয়ে দেয়। স্বাভাবিক। শালিক-চড়াইয়ের মধ্যে তো চিরকালের ঝগড়া। পায়রাও কিছুটা নিজের দলে থাকতেই পছন্দ করে। কিছুক্ষণ পর চড়াই দু’জনকেই ধমকে থামায়। শালিক-পায়রা থেমে যায়।

এবার  চড়াই পরিস্কার আগের মতো কণ্ঠ ও ভাষায়

( মানে শুরু থেকে যেভাবে বলছিল ) বলে, “সবারই কষ্ট

তুমি না থাকলে । কোথাও কিছু ঠিকঠাক জোটে না। এখানে এখন আর গাছপালাও নেই। গাছপালা থাকলে একটা-দু’টো পোকামাকড় তবু পাওয়া যায়। এইজন্যই বলছি, আমাদের কথা ভেবে অন্তত এখানেই থাকো। ফুরুত ফুরুত এদিক সেদিক পালিও না।” বলেই নিজে ফুরুত করে উড়ে যায়। শালিকও নিজের পথ দেখে। পায়রা উড়ে পাশের বাড়ির কার্নিশে বসে। সেখানে তার দলের আরও কয়েকজন জমায়েত হয়েছে আগে থেকেই। ইনি যাওয়া মাত্রই জোরদার মিটিং শুরু হয়ে যায়। সমস্যাটা খাদ্য নিয়েই, বুঝতে অসুবিধা হয় না।

Images 11
তোমার নিখিল বিশ্বে কিছুই ফেলা যায় না… 7

কিছুদিন ঘর ছেড়ে বাইরে থাকার পর ফিরে এলে বেশ কিছু বাড়তি পরিশ্রম জোটে কপালে। ব্যাগ আনপ্যাক থেকে ঘরসাফাই । রান্না করে, খেতে খেতে বেলা বাড়ে। একটু বিশ্রামের জন্য বিছানায় যেতেই ঘুমে চোখ বুজে আসে।

কতক্ষণ সেভাবে গেছে জানি না। হঠাৎ দেখি ভোর হয়েছে। আমার চুইখিমের বাড়ির রান্নাঘরের জানালা খুলে দিনের প্রথম আলো দেখছি মুগ্ধ হয়ে। চমক ভাঙে মুরগি ব্রিগেডের কুকুরু কু আওয়াজে। ঝুঁটি বাঁধা মোরগ, তার গৃহিণী এবং কুঁচোকাঁচারা। দল বেঁধে সামনে দাঁড়িয়ে তারা বলতে শুরু করে, “সেই যে গেলে, আর এই এলে। তোমার দেখছি আজকাল আর মনই টেঁকে না এখানে ! আরে আমাদের যে কি দশা ! একটু ভাত, দু’টো মুড়ি, তুমি না থাকলে কে দেবে শুনি ?” রীতিমতো অভিযোগের সুর গলায় ! জবাব দিতে যাব। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল। তখনও কানে বাজছে মুরগিবাহিনীর কথা।

এরপর অনেকক্ষণ ডুবে থাকি ভাবনায়। সবটাই স্বপ্ন না সবটাই সত্যি ! মনে পড়ে , অনেকদিন আগে পরিচিত এক ভাতৃসম তরুণের কথা। এক বিয়েবাড়িতে আলাপ। দু’জনে পাশাপাশি বসে খাচ্ছি। নেমন্তন্নবাড়িতে  অনেকেই খাবার নষ্ট করে। এটা উচিত নয়, একথা বলায় সে বলেছিল, “কিছুই নষ্ট হয় না দিদি। এই পথের কুকুর-বেড়াল, পাখপাখালি তো এসব খেয়েই বাঁচে। কোথাও কোথাও মানুষও।” বড় নির্মম এ সত্যি। হে ঈশ্বর, আমরা তো নিমিত্ত মাত্র। তোমার নিখিল বিশ্বে কিছুই হারায় না থুড়ি ফেলা যায় না। কোনও না কোনও প্রাণীর বেঁচে থাকার কাজে লেগেই যায়। সে মানুষ হোক বা মনুষ্যেতর।

ছবি : প্রতীকী