দর্শককে ভাবাবে লুব্ধকের ছবি
নতুন ছবির মুক্তি হোক বা নির্মাণ। পোস্টার, ট্রেলার রিলিজ। ছবি হিট এবং ফ্লপ। তারকাদের জীবনের ওঠাপড়া। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে সিনেমার দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে নানা বৈচিত্রপূর্ণ ঘটনা। সেইসবই এই বিভাগে, প্রতি সপ্তাহে। এই বিভাগে মূলত বাংলা ছবির বিষয়ে লেখা হলেও, মাঝে মাঝে আমরা ভিন্ন ভাষা নিয়ে তৈরি ছবির কথাও জানানো হয়। কলকাতার ছেলে লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়। লোকার্নো ফিল্ম উৎসবে দেখান হলো তাঁর প্রথম ছবি ‘হুইসপার্স অফ ফায়ার অ্যান্ড ওয়াটার’। লিখেছেন সোমনাথ লাহা।
একজন শিল্পী যখন চোরা রাজনীতির মুখোমুখি হয়, তখন তার অস্তিত্বের সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। আসলে, পঞ্চভূতত্ত্ব দিয়ে গড়া মানবশরীর। সেই তত্ত্ব অনুসারে তেজ অর্থাৎ আগুন এবং অপ তথা জলকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন দার্শনিকগণ। পরিচালক লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি ‘হুইসপার্স অফ ফায়ার অ্যান্ড ওয়াটার’ মানুষের মনের সেই দ্বিধাবিভক্ত অবস্থার কথাই বলে। প্রকৃতির দুই ভিন্ন রূপকে ধরে সমান্তরাল ভাবে আবর্তিত হয় এই ছবি। জঙ্গল পরিণত হয় খনিতে। বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তনের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ছবির চিত্রনাট্য।
এহেন বিষয়কে নিয়ে তৈরি লুব্ধকের এই ছবির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হলো ৭৬ তম লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘ফিল্মমেকারস অফ দ্য প্রেজেন্ট’-এর প্রতিযোগিতা বিভাগে। ছবিটি মনোনয়ন পেয়েছে গ্রিন পারডো পুরস্কারের জন্য। প্রসঙ্গত লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বাঙালি যোগসূত্রের ইতিহাস দীর্ঘ। সত্যজিৎ রায়ের তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এখানে নির্বাচিত হয়েছিল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘দূরত্ব’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘গৃহযুদ্ধ’ উৎসবে মনোনয়নের পাশাপাশি জিতেছিল পুরস্কার। এছাড়াও এই উৎসবে বিশেষ পুরস্কার পায় গৌতম ঘোষের ‘দখল’, অপর্ণা সেনের ‘মিষ্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অন্তরমহল’। এবার সেই তালিকায় জুড়ে গেল লুব্ধক চট্টোপাধ্যায়ের ৮৩ মিনিটের ছবি ‘হুইসপার্স অফ ফায়ার অ্যান্ড ওয়াটার’-এর নাম।
এর আগে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘আহুতি’ তৈরি করেছিলেন লুব্ধক। সেটি দেখানো হয়েছিল রটারডাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ইন্দ্রাশিস আচার্য পরিচালিত ছবি ‘নীহারিকা’-র সম্পাদক লুব্ধক। উল্লেখ্য, নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির জন্য বেশ অন্যরকম এক বিষয় বেছেছেন তিনি। ঝাড়খন্ডে এই ছবির শুটিং করেছেন পরিচালক। ছবির কাহিনি শিবা নামের একজন অডিও ইনস্টলেশন শিল্পীকে নিয়ে। শব্দ নিয়েই তার কাজ। এহেন শিবা যখন পূর্ব ভারতের বৃহত্তম কয়লাখনি প্রদর্শন করে, তখন তার চোখে পড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়। কিন্তু জটিলতায় ভরা সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছে নতিস্বীকার করতে হয় তাকে।
এমতাবস্থায় খনিতে কর্মরত একজন ব্যক্তির সঙ্গে শিবা রওনা দেয় জঙ্গলের একটি উপজাতীয় গ্রামে। এখানেই ছবির আখ্যানের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হয়। শিবার মন সেই সময় শহরের সমস্ত আবরণ ঝেড়ে ফেলতে চায়। নিজের অবস্থান নিয়ে সে নিজেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত স্রোতস্বিনী নজরে পড়ে তার। একদিকে কয়লাখনির আগুন যেমন এই মানুষটিকে রাজনৈতিক করে তোলে, তেমনই জল অপর উপাদান রূপে সত্য অনুসন্ধানে তার জন্য গোলকধাঁধা তৈরি করে।
দুটি ভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বেষ্টিত ছবির প্রেক্ষাপট। একটি ধানবাদের ঝরিয়া কয়লাখনি। সেখানে একশো বছর ধরে আগুন জ্বলছে এবং একটা বড় অঞ্চল ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে। ছবির দ্বিতীয় আখ্যানপর্ব জুড়ে রয়েছে পালামৌয়ের জঙ্গল। দুই প্রাকৃতিক উপকরণ চাক্ষুষ করে, নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয় শিবা। সেখানে যেমন সামাজিক-রাজনৈতিক, অর্থনীতির প্রশ্ন রয়েছে, তেমনই নিজের বোধের জগতেও রয়েছে প্রশ্নের উথালপাথাল ঢেউ! শিল্পী হিসেবে যে আর্টফর্ম নিয়ে সে কাজ করছে, তার গুরুত্ব কতখানি, সেটা তার কাছে আয়নার মতো ধরা দেয়। এভাবেই তার মধ্যে দেখা যায় অস্তিত্বের সংকট।
ছবির মুখ্য চরিত্র অডিও ইনস্টলেশন শিল্পী হওয়ায়, চারপাশের নানারকম শব্দ দিয়ে বোনা হয়েছে চরিত্রটিকে। ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন সাগ্নিক মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রে অমিত সাহা, দীপক হালদার, সৈকত চট্টোপাধ্যায় ও রোহিনী চট্টোপাধ্যায়। ছবির কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন পরিচালক স্বয়ং। সংলাপ রচয়িতা মোনালিসা মুখোপাধ্যায় ও পরিচালক নিজে। ছবিটি মূলত হিন্দি ভাষায় নির্মিত। তবে, চিত্রনাট্য ও চরিত্রের প্রয়োজনে দু-তিনটি দৃশ্যে পুরো সংলাপ বাংলায় রাখা হয়েছে। সংগীত পরিচালনায় রোহন বসু। সিনেমাটোগ্রাফার কেনিথ সাইরাস। সম্পাদনায় অর্জুন গৌরীসারিয়া এবং পরিচালক। লিটল ল্যাম্ব ফিল্মস এবং নিভ আর্ট মুভিজের ব্যানারে নির্মিত এই ছবির প্রযোজনায় রয়েছেন বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়, মোনালিসা মুখোপাধ্যায়, শাজি ম্যাথিউ এবং অরুণা আনন্দ ম্যাথিউ।
প্রসঙ্গত, এই ছবির ভিত অবশ্যই পরিচালকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি। ২০১৮ থেকে এই অঞ্চলগুলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন লুব্ধক। যদিও এটি তাঁর নিজের জীবনের গল্প নয়। বলা যায়, এই ছবি একটা কেস স্টাডি। প্রসঙ্গত, একটি নিউজ পোর্টালকে লুব্ধক বলেছেন, “একটা তথ্যচিত্রের কাজে আমাকে ঝাড়খণ্ড যেতে হয়েছিল। ওখানে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিশতাম আর তাঁদের নিয়ে ভাবতাম। আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, যে শহরে আমি বড় হয়েছি, তার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের ওই মানুষগুলোর জীবনযাত্রার কোনও মিল নেই। আমি এগুলোই বোঝার চেষ্টা করতাম মানুষের সঙ্গে গল্প করে। জায়গাটা নিয়েও অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। জায়গাটার চরিত্র বোঝার চেষ্টা করেছি। ধানবাদে গিয়ে দেখলাম চারদিকে আগুন। ওই পরিবেশ-পরিস্থিতিগুলোই আসলে আমাকে ছবিটা তৈরির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।” গত ৮-১০ আগস্ট, লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসব প্রাঙ্গণে, বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়েছে লুদ্ধকের এই ছবি, যা নিঃসন্দেহে আমাদের গর্বিত করে।