‘দিল্লি ক্রাইম’-এ এবার চাড্ডি বেনিয়ান গ্যাংয়ের মুখোমুখি বর্তিকা
হাতে হাতে স্মার্টফোন। তরুণ প্রজন্মের চোখ ইদানীং নিত্যনতুন ওয়েব সিরিজে। সারা বিশ্বের স্ট্রিমিং বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। সেইসব সিরিজ নিয়েই নানাকথা এই বিভাগে। আজ ‘দিল্লি ক্রাইম’ সিজন ২ নিয়ে লিখেছেন অজন্তা সিনহা।
যদি বলি ভারতীয় ওয়েব দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন ডিসিপি সাউথ বর্তিকা চতুর্বেদী আর এর অন্যতম প্রধান কারণ, শেফালি শাহের দাপুটে অভিনয়, তাহলে, একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। তার সঙ্গে এটাও বলতে হয়, দেশের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অপরাধের কাহিনিগুলির অন্যতম নির্ভয়া কেস ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কোনও রকম অতি নাটকীয় মোড়ক ছাড়াই হাজির করা–এও এক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ‘দিল্লি ক্রাইম’ নির্মাতাদের পক্ষে। সচরাচর এদেশে রিয়েল লাইফ স্টোরি নির্ভর ফিকশনের ক্ষেত্রে প্রায়ই উল্টোটাই দেখা যায়। এক্ষেত্রে ভাবাবেগ জাতীয় বস্তুটিকে সুড়সুড়ি হিসেবে ব্যবহার করে বিষয়ের গভীরতা ও গুরুত্ব–দুইই নষ্ট করার প্রবণতা প্রায়ই দেখি আমরা। এ বাবদ সিরিজের লেখক ও পরিচালক রিচি মেহতা (সহ পরিচালক তনুজ চোপড়া) নিশ্চয়ই পৃথকভাবে কুর্নিশযোগ্য।
প্রথম সিজন দেখানো হয় ৭টি পর্বে। শেফালির কথা তো শুরুতেই বলেছি। সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন রসিকা দুগল, আদিল হুসেন, রাজেশ টাইলং প্রমুখ। এঁরা প্রত্যেকেই ছাপ রাখেন পর্বে পর্বে। অন্যান্য অভিনেতারাও কম যান না। এই সিরিজের সম্পূর্ণ অভিনেতা টিমই এতটাই চূড়ান্ত বিশ্বাসযোগ্য নিজেদের অভিনয়ে, যে, সেই কালো দিনগুলি অতি সহজেই ভেসে ওঠে দর্শকের চোখের সামনে। এ দেশের অপরাধ দমনের ক্ষেত্রটিতে পুলিশ যে অনেক সময়েই রাজনৈতিক স্বার্থযুক্ত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, সেটা চিত্রনাট্যে খুব প্রাঞ্জলভাবে উঠে আসে। সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ কাজে লাগিয়ে রাজনীতির খেলা বহুক্ষেত্রেই অপরাধ দমনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, এখানে সেটাও সুন্দরভাবে প্রকাশিত।
আদতে সিনেমাটোগ্রাফি থেকে সেট নির্মাণ, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর থেকে কস্টিউম, সংলাপ ও চরিত্রগুলির আচার-ব্যবহারে যথাযথ গবেষনার ছাপ–’দিল্লি ক্রাইম-‘কে সহজেই আর পাঁচটি ক্রাইম সিরিজের থেকে আলাদা করা যায়। এক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় বলা উচিত, গোল্ডেন ক্যারাভান, আইভানহো প্রোডাকশন্স, ফিল্ম ক্যারাভান ও পুওর ম্যানস প্রোডাকশন্স নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৯-এর মার্চে আমরা দেখি প্রথম সিজন। ২০২০-র সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এমি এওয়ার্ড-এ ‘দিল্লি ক্রাইম’ আউটস্ট্যান্ডিং ড্রামা সিরিজের পুরস্কার পায়। উল্লেখ্য, প্রথম ভারতীয় সিরিজ, যে এই সম্মান লাভ করে।
২০১২-য় দিল্লি শহরে চলতি বাসে গণধর্ষণের শিকার নির্ভয়ার ঘটনা একদিন চমকে দিয়েছিল সারা দেশের মানুষকে। ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত প্রশাসন, মিডিয়া থেকে আম জনতার ভাবনার জগৎ উত্তাল হয়ে ছিল। ডাক্তারদের বহু চেষ্টার পরও নির্ভয়াকে বাঁচানো যায়নি। তার আগেই অবশ্য ধরা পড়ে তার অপরাধীরা। ছয় অপরাধীর একজনের আত্মহত্যা, একজন বয়সে কিশোর তাই শাস্তি কম, বাকি চারজনের ফাঁসি–সমস্তটাই এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় চলে, যা সকলেরই জানা। যদিও, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণ এখানে প্রশাসনিক গাফিলতি নয়, আইনের কূটকচালি! দিল্লি পুলিশের একটি টিম দিবারাত্র এক করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছয় অপরাধীকেই গ্রেফতার করে, সে তথ্য সকলেরই জানা। সিরিজ নির্মাতারা এই কাহিনি তদন্ত পর্ব পর্যন্তই রাখেন। আমরা প্রথম সিজনের শেষ পর্বের একেবারে শেষে জানতে পারি প্রধান অপরাধী জয় সিং জেলে আত্মহত্যা করেছে। সম্ভবত, বিবেকের জ্বালায়। এর বেশি আর সিরিজকে টেনে না নেওয়া অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। কারণ, এই সিরিজ কোনও একটি বিশেষ ঘটনার সম্পূর্ণ আত্মীকরণ নয়। এখানে পুরোমাত্রায় ফোকাস অপরাধের নিখুঁত ও নিপুণ তদন্ত, যার নেতৃত্বে ডিসিপি সাউথ বর্তিকা চতুর্বেদী ও তাঁর টিম।
নেটফ্লিক্স-এ প্রদর্শিত ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর দ্বিতীয় সিজন সেই ধারাবাহিকতা মেনেই নিয়ে এসেছে আর একটি রিয়েল লাইফ ক্রাইম স্টোরি। কুখ্যাত চাড্ডি বেনিয়ান গ্যাং এবার বর্তিকার রাডারে। শেফালি শাহ, রসিকা দুগল, রাজেশ টাইলংয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় সিজনে যোগ দিয়েছেন তিলোত্তমা সোম, দানিশ হুসেন, যতীন গোস্বামী, ভ্যোম যাদব ও অঙ্কিত শর্মা। এই সিজন প্রিমিয়ার হয়েছে গত ২৬ আগস্ট। বিষয় বিন্যস্ত ৫টি পর্বে। টিম বর্তিকার পক্ষ থেকে নির্ভয়া কেসের অপরাধীদের কাস্টডিতে নেওয়ার পর্ব শেষ। সবকিছু মোটামুটি শান্ত। তখনই বোঝা যায়, অপরাধ বহুল দিল্লিতে শান্তিও এক আপাতলব্ধ বিষয়। হঠাৎ করেই খবর আসে, আক্রান্ত সিনিয়র সিটিজেন অর্থাৎ সমাজের কিছু প্রবীণ মানুষ ! একের পর এক খুনের ঘটনায় আবার কেঁপে ওঠে দিল্লি শহর।
পুলিশ কমিশনার বর্তিকাকে ইন্সপেক্টর বীরেন চাড্ডার সঙ্গে কথা বলতে বলেন তদন্তের স্বার্থে। সেখান থেকে বর্তিকা ও তাঁর টিম হাতে নেয় বিষয়টি। যথারীতি কেউ একজন মিডিয়ার কাছে খবর ফাঁস করে দেয়। প্রথম সিজনে নির্ভয়া কেসে আমরা দেখেছিলাম, মিডিয়ার কাছে তথ্য চলে গেলে, পুলিশের পক্ষে কাজটা সঠিকভাবে করা কতটা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরাধীরা সাবধান হয়ে যায়। তাদের গা ঢাকা দিতে সুবিধা হয়। শুধু তাই নয়, মিডিয়া তাদের ব্যবসার খাতিরে জনতার আবেগ নিয়ে খেলতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। এই কারণেই বর্তিকার নৈতিক অবস্থান, মিডিয়ায় অপরাধ নিয়ে হইচইয়ের বিরুদ্ধে। এবারও বর্তিকা কঠোরতা অবলম্বন করেও বিষয়টা আটকাতে পারেন না। আদতে পুলিশের ভিতরেই যে রয়েছে মিডিয়ার কাছে খবর ফাঁস করার লোকজন।
মিডিয়ায় খবর চলে যাওয়ার পরই সেটা অতিরঞ্জিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অপরাধ বিজ্ঞানের গতি-প্রকৃতি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ নিয়ে একদিকে চূড়ান্ত টেনশনে প্রহর কাটাচ্ছে টিম বর্তিকা। অন্যদিকে মিডিয়ার কারণেই শুরু অহেতুক চাপ সৃষ্টি। এরই মধ্যে সন্দেহভাজন দুটি মানুষকে নিয়ে দোদুল্যমান বর্তিকা। এরা কি সত্যিই যুক্ত অপরাধের সঙ্গে? নাকি ভুল হচ্ছে কোথাও ! এমতাবস্থায় তাদের ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় কী ? ঠিক তখনই আসল অপরাধীরা নতুনভাবে খুনের ছক সাজায়। তদন্ত এগিয়ে চলে। বর্তিকা তদন্তের গতিপথে পরিবর্তন আনেন। টিমের অন্যতম সদস্য নীতি খুনগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে পায়। এদিকে লতা এখনও হাতের বাইরে। এই কাহিনির সঙ্গে লতা ওরফে করিশ্মার কী সম্পর্ক, সেও এক রহস্য। এই সবকিছু জানার জন্য আপনাকে চোখ রাখতে হবে নেটফ্লিক্স-এর পর্দায়।
শেষ করবো বর্তিকা চতুর্বেদী প্রসঙ্গেই। ‘দিল্লি ক্রাইম’ দর্শকদের মধ্যে অনেকেরই মনে এই প্রশ্নটা বার বার উঁকি দিয়েছে এই চরিত্রটি নিয়ে–এমন কেউ সত্যিই কি আছেন ? তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, হ্যাঁ, আছেন। বর্তিকার চরিত্রটি প্রাক্তন ডিসিপি ছায়া শর্মার অনুপ্রেরণায় তৈরি। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ছায়া। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক তিনি। ১৯৯৯-এর আইপিএস ছায়া দিল্লি সাউথের প্রথম মহিলা ডিসিপি। পরবর্তীকালে আরও নানা উচ্চপদে আসীন ছায়াই ২০১২-য় নির্ভয়া কেসের তদন্ত টিমের প্রধান ছিলেন। শোনা যায়, তাঁর কাছে যখন এই সিরিজ নির্মাণের ব্যাপারে রিচি মেহতা যোগাযোগ করেন, প্রথমে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তই ছিলেন ছায়া। পরে তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করান তাঁর প্রাক্তন বস নীরজ কুমার (সিরিজে যিনি কুমার বিজয়)। ইনি সেই সময় দিল্লির পুলিশ কমিশনার ছিলেন। জানা গেছে, রিচির কাজের ডিটেল দেখে তৃপ্ত হয়েছেন ছায়া।
এমন এক চরিত্রে অভিনয় করার আগে শেফালির মতো সিরিয়াস অভিনেত্রী যে ছায়া শর্মার সঙ্গে একবার দেখা করবেনই, সে তো বোঝাই যায়। শেফালির কথায়, উনি অসাধারণ এবং আশ্চর্যজনক একজন মানুষ। কতখানি অনুপ্রেরণাদায়ক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওঁর মতো একজন মানুষের মুখোমুখি হওয়া মানেই বিশাল সমৃদ্ধ হওয়া। উনি নির্ভয়ার হয়ে যুদ্ধ করার পথটা বেছে নেন, এবং সেটা কি প্রতিকূলতার মধ্যে, আমরা সবাই জানি। বর্তিকা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ওঁর কথা শোনা, পরামর্শ পাওয়া, আলোচনা আমাকে অনেকটাই সাহায্য করেছে।